প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? by ইফতেখার আহমেদ টিপু

প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই এখন সময়ের দাবি। ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো জ্ঞান মানুষের অজানা। ভূমিকম্প রোধের কোনো উপায়ও আমাদের জানা নেই। আমাদের দেশের ইতিহাসে ৯৩ বছর আগে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সর্বশেষ বড় মাপের অর্থাৎ ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়েছিল।


১২৫ বছর আগে মধুপুরে আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যা ছিল ৭ মাত্রার কাছাকাছি। বলা যায়, গত ৯২ বছরে বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোনো নজির নেই। তার পরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নানা কারণে। প্রায় এক শ বছরের রেকর্ডে দেশ ভূমিকম্প থেকে নিরাপদ থাকলেও কখন যে সেই আপদ নখর বসাবে, তা আমাদের জানা নেই।
গত ঈদুল ফিতরের আগের রাতে এবং ঈদের দিন দেশে তিন দফা ভূমিকম্প হয়েছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল প্রকম্পিত হয়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করেছে। সৌভাগ্যের বিষয়, কোথাও ধস বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে এ ভূমিকম্প দেশবাসীকে সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির কথা। বড় রকমের ভূমিকম্পে দেশটির কী পরিণতি হবে, প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কেমন হবে_এসবের বিস্তারিত বিবরণ জানিয়েছেন তাঁরা। প্রকাশিত এসব বিবরণ অত্যন্ত ভয়াবহ। ঈদ ও ঈদের আগের রাতের ভূমিকম্পনগুলোর উৎপত্তিস্থল ঢাকার খুব কাছে চাঁদপুর এলাকায়। এতে সহজেই ধারণা করা যায়, রাজধানী ঢাকার জন্য কী ভয়াবহ শঙ্কা অপেক্ষা করছে। প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলগুলো নিয়ে গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই উৎপত্তিস্থলগুলো থেকে আগেকার প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের আড়াই শ থেকে তিন শ বছরের মধ্যে আবার একই ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। রেকর্ড বা নথিতে দেখা গেছে, গত বছর বাংলাদেশকে ঘিরে ১৯টি ভূমিকম্প হয়েছে। এ ১৯টির মধ্যে চারটির উৎপত্তিস্থল এ দেশেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্তি্বক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প দুর্যোগের জন্য অতিমাত্রায় ঝুঁকিপ্রবণ না হলেও এর ফাটলরেখা বরাবর ভূকম্পন সঞ্চালনশীল। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে ভারত ও বার্মিজ খণ্ডিত প্লেটের বাউন্ডারি এবং দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টি করার মতো রয়েছে তিনটি ফাটলরেখা। দেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ মধুপুর ফাটলরেখা। ভারতে উত্তর-পূর্ব মেঘালয় অঞ্চল ও বাংলাদেশের সিলেট-ময়মনসিংহ সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ফাটলরেখা। আবার দেশের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর রয়েছে প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার লম্বা পূর্বাঞ্চলীয় সুদীর্ঘ ফাটলরেখা, যা আন্দামান নিকোবর থেকে শুরু করে হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। ২৫০ বছরে এই ফাটলরেখাগুলো তিনটি বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি করেছে। পূর্বাঞ্চলীয় ফাটলরেখার দক্ষিণ প্রান্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ২ এপ্রিল ১৭৬২ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
অন্যদিকে এই ফাটলরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চল সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ৮ জুলাই ১৯১৮ সালে বেশ শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। মধুপুর ফাটলরেখা বরাবর ভূমিকম্প সংঘটিত হয় ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই, যার মাত্রা ছিল ৭.০-এর কাছাকাছি। ১৮৯৭ সালে সিলেটের উত্তর-পূর্বে ভারতের মেঘালয়ে ৮.৭ মাত্রায় ভূমিকম্পের উৎসস্থল যদিও দেশের বাইরে ছিল; কিন্তু সেই ভূমিকম্পে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ভূমিকম্পের ইতিহাসের দিক থেকে বাংলাদেশ অনিরাপদ অথবা বড় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলার অবকাশ নেই। তার পরও সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকাই বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্প হলে তা বড় ধরনের বিপদ ঘটাবে। ইমারত নির্মাণ নীতিমালা না মেনে রাজধানীতে বাড়িঘর তৈরি করা হচ্ছে। বড় কোনো ভূমিকম্পের সময় এগুলোই হবে ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান কারণ। এ ব্যাপারে নগরবাসী এখনো তেমন সচেতন নয়। ভূমিকম্প প্রতিরোধী বাড়ি-ঘর তৈরির ব্যাপারে গড়ে ওঠেনি কোনো সচেতনতা। রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশের অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব সরকারের। আর মানুষের নাগরিক দায়িত্ব সেই সচেতনতায় সাড়া দেওয়া। সেই দায়িত্বে সাড়া দিতে হবে সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায় থেকেই। দায়িত্ববোধ থাকতে হবে দুদিকেই। ভূমিকম্পের ঝুঁকি ভয়ে ভোগা নয়, নিজেদের রক্ষায় রাজধানী ঢাকার অধিবাসীদের সচেতন করে তুলতে হবে। ভূমিকম্প সম্পর্কে রাজধানীবাসীকে ধারণা দান, অগি্ননির্বাপণ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে জরুরি ভিত্তিতে কিভাবে বের হওয়া যায়, তা আগে থেকে জেনে রাখা এবং ভবন নির্মাণে যাতে সবাই বিল্ডিং কোড মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের সেবাদানের জন্য পর্যাপ্ত বার্ন ইউনিট চালু করতে হবে। ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কাজ চালানো, আগুন নেভানো, যোগাযোগব্যবস্থা পুনরুদ্ধার ইত্যাদি সম্পর্কেও আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে। জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও সংবেদনশীলতার সৃষ্টি করেছে। আমাদের সীমাবদ্ধতা প্রচুর। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সামর্থ্য খুব ক্ষীণ। এসব বিষয় আমলে নিয়ে এর মধ্যে থেকেই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা চাই।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ, chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.