চরাচর-নাসিরনগরের 'বড় বাড়ি' by বিশ্বজিৎ পাল বাবু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রাম। সড়কের পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে 'বড় বাড়ি'। বাড়ির বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অনেক বড় বারান্দা ডিঙিয়ে মূল বাড়ি। দ্বিতল সুবিশাল বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই কারুকার্যখচিত দেয়াল।
এটি ছিল মন্দির। পুরো বাড়িতে সব মিলিয়ে অন্তত ১০০টি কক্ষ হবে। বাড়ির এক প্রান্তে খেলার মাঠ, আরেক প্রান্তে পুকুর। পুকুরের নাম 'মহলপুকুর'। পাশেই ঘাটলা ঘেঁষে তিতাস নদ। বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে কী সুন্দর কারুকাজ! কোথাও রডের দেখা নেই, চুন-সুরকির ভবন। একেকটি বিম দুই থেকে আড়াই ফুট চওড়া। ওপরে ওঠার জন্য সব মিলিয়ে চার-পাঁচটি সিঁড়ি। আছে রঙ্গমঞ্চ, নাটমন্দির, শয়নকক্ষ ইত্যাদি। তবে সব কয়টি কক্ষেরই পুরনো সেই দরজা নেই। বর্তমানে বসবাসকারীরা সাধারণ মানের দরজা লাগিয়ে থাকেন। সব মিলিয়ে ৩০টি পরিবার আছে এখানে। ১০ থেকে ৭০ বছর ধরে তাদের বসবাস। বাড়ির ভেতরের অংশে অনেকটা গোছালো পরিবেশ। অনেকের ভাষ্য অনুযায়ী, বাড়িটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। জমিদার গৌরপ্রসাদ রায়চৌধুরী তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন এখানে। কৃষ্ণপ্রসাদ চৌধুরী, হরেন্দ্রলাল চৌধুরী, হরিপদ রায়চৌধুরী ছিলেন তাঁর বংশধর। তবে কবে তাঁদের বংশধররা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি কারো কাছ থেকে। ওই বাড়িতে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করেন পুরোহিত আশীষ চক্রবর্তী। জানালেন, তাঁর দাদা ছিলেন এই জমিদারবাড়ির পুরোহিত। সেই সূত্রে প্রায় ৭০ বছর ধরেই এখানে তাঁদের থাকা। বাপ-দাদা নেই, তাই তিনিই এখানে পূজা-অর্চনার কাজ করে থাকেন। বাড়ির ছোট্ট উঠানে থাকা কারুকার্যখচিত তুলসীবেদিতে নিয়মিত পূজা দেওয়া হয়। আশীষ চক্রবর্তী জানান, গৌরপ্রসাদ রায়চৌধুরীর বাড়িটি এক দুন অর্থাৎ ১৬ কানি। কয়েক বছর আগে তাঁর এক বংশধর কলকাতা থেকে এসে ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশে তাঁর বংশধর আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। নাম বিমল রায়চৌধুরী। তিনি ইতিমধ্যেই নিজের অংশের জায়গাটুকু (খালি জায়গা) বিক্রি করে দিয়েছেন। স্থানীয় লোকজন জানায়, এখানে শুটিং করতে প্রায়ই সিনেমা-নাটকের দল আসে। গত বছর আসা একটি দল তাদের প্রয়োজনে বাড়িটির কিছু অংশে রং করে। এমনিতে এটি সংস্কার করা হয় না। দিন দিন বাড়িটি সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। অনেক পর্যটক এসে আফসোস করে। বিশেষ করে শীতকালে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে চোখ আটকায় একটি সাইনবোর্ডে। গাছে পেরেক ঠুকে লাগানো কালো সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা আছে, 'এই পুরাতন বড় বাড়ী খরিদ/লিজ সূত্রে মালিক মো. গাজীউর রহমান, মো. আবু লাল মিয়া'। সঙ্গে চারটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া। স্থানীয় লোকজন ও বসবাসকারীরা অভিযোগ করেন, বড় বাড়ি দখলের পাঁয়তারা চলছে। মাঝেমধ্যে বাইরের লোকজন এসে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে। হুমকিদাতারা এসে বলে যায়, বাড়িটি কেনা হয়েছে। অথচ বাড়িটি বিক্রি হয়নি বলেই সবার জানা। শুধু বিমল রায়চৌধুরী নামে জমিদারের এক ওয়ারিশ সামান্য কিছু খালি জায়গা বিক্রি করেছেন। এলাকার লোকজন দাবি করে বলেছে, আমরা চাই সরকার যেন বড় বাড়িটির দিকে খেয়াল করে। বাড়িটির ঐতিহ্য রক্ষায় সংস্কারের পাশাপাশি ভূমিদস্যুদের কবল থেকে এটিকে মুক্ত করতে সরকারের আশু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।
বিশ্বজিৎ পাল বাবু
বিশ্বজিৎ পাল বাবু
No comments