চালচিত্র-রাজনীতি একটা জায়গায় থেমে আছে আবার কি ওয়ান-ইলেভেনের পদধ্বনি! by শুভ রহমান

কোনো কিছুই এগোচ্ছে না। সব কিছুর চালিকাশক্তি যে আসলে রাজনীতি, সেটাই আবার প্রমাণিত হচ্ছে। অথচ দেশে কার্যত রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে একের পর এক কিছু আপাত 'হট ইস্যু' এসে একটা আরেকটাকে চাপা দিয়ে যাচ্ছে।


ডেসটিনির উদ্বেগজনক ব্যাপারটা কয়েকদিন উত্তাপ সৃষ্টি করে 'টক্ড্ আউট' হয়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রজয়ের ব্যাপারটি বাংলাদেশের এক বিশাল জাতীয় অর্জন হিসেবে উপস্থিত হওয়ার পরও এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা পর্যন্ত সে জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানানোর পরও জাতির এমন একটি গৌরবময় সাফল্যের বিষয়টিও যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের আকস্মিক ডিগবাজি ও একে 'শুভংকরের ফাঁকি' আখ্যা দিয়ে ধন্যবাদ ফেরত নিয়ে নেওয়ার কলংকজনক ও হাস্যকর ঘোষণা দেওয়া এর চাপা পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় রকম অবদান রেখেছে। এর পর ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে খানিকটা আলোড়ন সৃষ্টি হতে হতেই তাও চাপা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। 'ওয়ার্ডের সংখ্যা, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির' পরই তো তফসিল ঘোষণার কথা; অথচ এত পরে এখন সেসব নিয়েই অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আর আগাগোড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে পরিশেষে- সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের হুংকার দিয়েও বিরোধী দল তা নিয়ে আর যেন এগোতে পারছে না। তাদের পুরো ব্যাপারটা 'বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া' হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে অবশ্য দেশজুড়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে জাতি উদ্বেল হয়ে ওঠায় অন্য কোনো কিছুই মানুষকে আকৃষ্ট করার অবস্থায় ছিল না। সেটা বরং ভালোই ছিল, গোটা জাতি বিরোধপূর্ণ রাজনীতির পঙ্কিলতার ঊধর্ে্ব উঠে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনাতেই অবগাহন করার তাগিদ অনুভব করেছে। এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ যদি শিকড় অভিমুখী থাকত এবং এর স্রোতোধারা যদি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত, তাহলে হয়তো রাজনীতির ক্ষেত্রে যা অনর্জিত থেকে যাচ্ছে, সাংস্কৃতিক অর্জনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অভিন্ন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে সেই কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। সংস্কৃতিক্ষেত্রে যতই বাঙালির আত্মবোধনের তাগিদ আসুক, তা শিকড়সন্ধানী ও শিকড়াশ্রয়ী হতে পারছে না বলেই তা কার্যত ক্ষণস্থায়ীই থেকে যাচ্ছে। আবার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ, কাদা ছোড়াছুড়ি, ক্ষুদ্রস্বার্থে মগ্ন থাকা, নানা রকম পঙ্কিলতা আর আবিলতা এসে আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রাকে কার্যত ব্যাহতই করছে।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা আক্ষেপ করেই বিরোধী দলকে জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু চিন্তা-ভাবনা থাকলে তা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। আর, মার্কিন রাষ্ট্রদূত যেন বৃহৎশক্তির আকাঙ্ক্ষাটুকুই আবারও ব্যক্ত করার জন্যই বসে আছেন, এভাবেই সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সে লক্ষ্যে সংলাপে বসার আহ্বান রেখে চলেছেন। কিন্তু কোনো মহলেরই কোনো যান্ত্রিক আহ্বান বা সদিচ্ছা ব্যক্ত করার মধ্য দিয়েই যে জাতীয় ঐকমত্যের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, এমন বাস্তবতা এখনো সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ধিক্কৃত হওয়ার মতোই নতুন নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শাসক মহাজোট যখন অব্যবস্থা, অনিয়ম, দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত; যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে বিভাজনের মধ্য দিয়ে রেল মন্ত্রণালয়কে পৃথক করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো একজন অভিজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও দুর্মুখ ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়ে দুর্নীতি-অব্যবস্থামুক্ত করার উদ্যোগ কার্যকর করেছে, তখনই দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়ে তার ভেতর থেকেই দুর্নীতির কালো বিড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। মধ্যরাতে হাতেনাতে নিয়োগ-বাণিজ্যের ঘুষের ৭০ লাখ টাকার বস্তা ধরা পড়ার নাটকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো মানুষেরও ফেঁসে যাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। এ নাটকের কোনো পরিসমাপ্তি ঘটবে, নাকি মাঝপথে তা চাপা পড়ে যাবে, সেটাও এখন দেখার বিষয়। বিরোধী পত্রিকাবিশেষ আদাজল খেয়ে লেগেছে, সুরঞ্জিত ও তাঁর ছেলে সৌমেনের দিকেই যাতে অভিযোগের তীর লক্ষ্যভেদ করে, সে জন্য তাঁদের বিত্ত-বৈভবের নাড়িনক্ষত্র টেনে বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, পিতাপুত্রের আয়ের উৎস সবই জ্ঞাত, আয়কর রিটার্নেই সব তথ্য দাখিলকৃত, কোনো কিছুই অজ্ঞাত ছিল না। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও বেশ কয়েকজন রাঘব-বোয়াল রাজনীতিকের বিরুদ্ধে লোমহর্ষক অনেক দুর্নীতির অভিযোগ খাড়া করার ও তাঁদের আগাম জেল খাটানোর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসবের কোনো কিছুই টেকেনি। গ্রেপ্তারকৃতরা যেমন বেরিয়ে এসেছেন, তেমনি তাঁদের হাঁসের মতোই অভিযোগের চিহ্নও ঝেড়ে ফেলতে দেখা গেছে। মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য রাজনীতি ও রাজনীতিকরা ধিক্কৃত হয়ে রাজনীতির অগ্রগতির পথই শুধু রুদ্ধ থেকেছে। এখন ওয়ান-ইলেভেন না আসা সত্ত্বেও কয়েকজন রাজনৈতিক মন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হতে হচ্ছে এবং তাঁদের দায়িত্ববদল হচ্ছে। অনিয়ম, অযোগ্যতা, অব্যবস্থা, দুর্নীতির অভিযোগগুলো তাঁদের চাপাই পড়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়ে রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি উন্নয়নের সহায়ক হয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটি করতে সক্ষম হচ্ছে না। মাত্র তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে না হতেই শাসক মহাজোটের ভেতর যে রকম শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে, অতীতে অন্য কোনো সরকারের সময়ে তা হতে দেখা যায়নি। শাসক মহাজোটের ভেতর অধিকতর গণতান্ত্রিকতার কারণেই এসব ঘটতে পারছে কি না, নাকি কোনো নেপথ্য ষড়যন্ত্রের কারণে মহাজোটের ভাবমূর্তিকে তথা গণতন্ত্রের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ন ও মসীলিপ্ত করে আবারও দেশে কোনো অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার দূরনিয়ন্ত্রণচালিত শক্তির এটা কারসাজি কি না, কোনো কোনো বিশ্লেষক সে প্রশ্নও রাখছেন।
এ দেশে গণতন্ত্রের মসৃণ কার্যকারিতা ও অগ্রগতিই যেন সবসময় একটা নেপথ্য অনাকাঙ্ক্ষিত অপশক্তির মাথাব্যথার কারণ হয়ে রয়েছে। বস্তুত গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা কোনো দেশেই কখনোই মসৃণ হতে দেখা যায় না। পাশের দেশ ভারতে 'রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়, অলিগলি মে শোর হ্যায়' বলে একেবারে লোকসভাতেই স্লোগান দিয়ে বিরোধীরা কংগ্রেস শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। বফোর্স কেলেঙ্কারির মতো মহাদুর্নীতির অভিযোগে রাজীবকে জড়িয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সিবিআই কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে নরসিমা রাও অপসারিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক শাসন শেষ পর্যন্ত অব্যাহতই থেকেছে।
আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর গণভিত্তি সমাজদেহের গভীরে বিস্তৃত হওয়ার তেমন সুযোগ পায়নি। পাশের দেশে যেখানে ৬৫ বছরে একবারও গণতান্ত্রিক শাসনকে হটিয়ে কেন্দ্রে সামরিক শাসন চেপে বসতে সক্ষম হয়নি, সেখানে এ দেশে অবস্থাটা তার বিপরীত। স্বাধীনতার ৪০ বছরে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময়ই এ দেশে সামরিক বা আধাসামরিক শাসনেই কেটে গেছে, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর সুযোগই পাওয়া যায়নি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও শাসকদের ভুলভ্রান্তি, এমন কি দুর্নীতির মধ্য দিয়েও দেশ এগোতে পারে, কিন্তু অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক ও তথাকথিত অরাজনৈতিক শাসকদের হাতে দেশ তো একেবারে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে এবং দেশ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। আর চুরি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার দমন ও প্রতিকারও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই তুলনামূলকভাবে বেশি সম্ভব- অগণতান্ত্রিক শাসনে তা আদৌ সম্ভবই হয় না। তার উল্টোটাই ঘটে। দুর্নীতি, লুটপাট, চুরির মচ্ছবই চলে সবার দৃষ্টির আড়ালে।
গণতান্ত্রিক শাসন না হওয়াতেই চারদলীয় জোটের শাসনামলে হাওয়া ভবনের কোটি কোটি টাকার লোমহর্ষক দুর্নীতির তথ্য, কোটি কোটি টাকার ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের তথ্য, সৌদি আরবে দুই শতাধিক বাঙ্ পাচারের তথ্য সে আমলে দেশবাসীর একরকম অনালোচিতই ও অজানাই থেকে গেছে।

১৬.৪.২০১২

No comments

Powered by Blogger.