ঘটনার তদন্ত ও দোষীদের বিচার হোক-অবশেষে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ

রেলমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সাড়ে চার মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে তাঁর সহকারী একান্ত সচিব, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক ও রেলের নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট ৭০ লাখ টাকাসহ রেলমন্ত্রীর বাসভবনে যাওয়ার পথে গাড়িচালকসহ বিজিবির সদর দপ্তরের মূল ফটকে আটক হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে তাঁর পদত্যাগের যে প্রবল দাবি ওঠে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অবশেষে তার কাছে নতি স্বীকার করলেন।


তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক থেকে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ঘটনার অব্যবহিত পরেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘোষণা দিতেন, তাহলে আরও ভালো হতো। তবে দেরিতে হলেও যে তাঁর এই সুমতি হয়েছে, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।
কিন্তু মন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়টির অবসান ঘটা উচিত হবে না। প্রথমত, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের গাড়িচালক আলী আজম কোথায় ও কী অবস্থায় আছেন, তা সরকারকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। বিজিবির সদস্যরা কেন টাকাসহ অন্য তিন কর্মকর্তাকে ছেড়ে দিয়ে শুধু গাড়িচালককে আটকে রাখলেন—এ প্রশ্নের যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত টাকার উৎস কী এবং কেন সেই টাকা মধ্যরাতে রেলমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল—এসব বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। তৃতীয়ত, রেলওয়েতে সাত হাজারের বেশি লোক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক ‘নিয়োগবাণিজ্যে’র যে অভিযোগ উঠেছে, সেই নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থগিত করলেই অভিযোগের নিষ্পত্তি ঘটবে না। এই গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁদের প্রত্যেকের অর্থ-সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং সেগুলো কীভাবে কত সময়ের মধ্যে তাঁরা অর্জন করেছেন, তা খতিয়ে দেখে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। চতুর্থত, রেলওয়ের শুধু পূর্বাঞ্চলীয় শাখা নয়, পুরো রেল মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করতে হবে। এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি, হিসাব নেওয়া দরকার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর অর্থ-সম্পদ বেড়েছে কি না; বেড়ে থাকলে কী উপায়ে ও কী পরিমাণে বেড়েছে।
রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু টাকা আটক থেকে শুরু করে তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি একটা সাধারণ তাৎপর্য বহন করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে জনমনে এমন ধারণা গভীর হয়েছে যে সরকারের ভেতরে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম চলছে। ঘটনাক্রমে রেল মন্ত্রণালয়ের কজন কর্মকর্তার মধ্য দিয়ে বিষয়টির আভাস মিলেছে; এটি দুর্নীতি-সমুদ্রে ভাসমান হিমশৈলের দৃশ্যমান উপরাংশের মতো, তলের বিশাল অংশটি অদৃশ্য।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোর একটি ছিল দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। রেলমন্ত্রী হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন কি না, তা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তবে তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। সরকারের মুখরক্ষার খাতিরেই কেবল নয়, দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী যদি এটা করে থাকেন, তাহলে অন্যান্য মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ সরকারের কর্মকর্তাদের কাছে একটা সতর্কবার্তা পৌঁছে যাওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.