মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-উত্তর রূপান্তর by সিরাজুল ইসলাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর। তার আগে পাকিস্তান আমল ধরলে আমরা স্বাধীনতা দিবসের উৎসব পালন করে যাচ্ছি গত ৬৩ বছর যাবৎ। একসময় ছিল, জগতে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হতো না। কেননা তখন রাজ্য ছিল, সাম্রাজ্য ছিল, কিন্তু স্বাধীনতা ছিল না।
স্বাধীন ছিল শুধু রাজা নিজে। ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে রাজা রাজ্য শাসন করত, প্রজারা তার গুণকীর্তন করত, কেননা তাদের মধ্যে বিশ্বাস জাগানো হতো এ মর্মে, রাজা-বাদশা ঈশ্বরেরই ছায়া। রাজা-বাদশা ঈশ্বরের ছায়া—এ তত্ত্ব প্রথম চ্যালেঞ্জ করল মার্কিনরা। ব্রিটিশদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করে মার্কিনরা প্রথম দীর্ঘ যুদ্ধের মাধ্যমে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল ৪ জুলাই, ১৭৭৬। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন তখন থেকেই শুরু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে ২৬ মার্চ।
স্বাধীনতা সুযোগ এনে দেয় অধীনতাকে উচ্ছেদ করে নিজেকে মেলে ধরার, নিজের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া জাপানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। তখন অঞ্চলটি ছিল ক্রীতদাসনির্ভর একটি সামন্ত সমাজ। ২০ বছরের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় মানবিক অধিকার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মালয়েশিয়া মুক্ত হয় ১৯৫৭ সালে। স্বাধীনতার ৩৫ বছরের মধ্যে দেশটি মূলত জঙ্গল-রাষ্ট্র থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও অর্থনীতিতে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকের নাগপাশ থেকে সিঙ্গাপুর মুক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এটি ছিল নেহাতই একটি মৎস্যবন্দর মাত্র। স্বাধীনতার ২০ বছরের মধ্যে এ মৎস্যবন্দর সিঙ্গাপুর বিশ্বের একটি বিস্ময়কর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটানা ২০ বছর যুদ্ধ করে ভিয়েতনাম স্বাধীন হয় ১৯৭৫ সালে। এর পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেই ভিয়েতনাম বিশ্বের একটি শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর এ ধরনের রূপান্তরের উপমা আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। মোদ্দা কথা, প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষের মানবিক গুণাবলি ও আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় কর্মস্পৃহা ও সৃষ্টিশীলতা। তাত্ত্বিকভাবে অধীনতা মানুষকে নিষ্ক্রিয়-নিষ্প্রভ করে তোলে, কেড়ে নেয় জীবন ও আত্মসম্মানবোধ। এর অবশ্যম্ভাবী ফল দারিদ্র্য, পরনির্ভরশীলতা ও তোষামোদী মনোভাব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরেও বাঙালির জীবনধারায় কোনো লক্ষণীয় রূপান্তর আসেনি। মার্কিন মুলুক থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব দেশ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এ ব্যতিক্রমের কারণ সমাজবিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করতে পারেন। আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আসলে শ্রেণীবিশেষের জন্য, আপামর জনসাধারণের জন্য নয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের মতো বাংলাদেশও একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হতে পারত। স্বাভাবিক কারণেই স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। যাদের শিক্ষা নেই, চাকরি নেই, রুজি-রোজগার নেই, চিকিৎসা নেই, আবাসন নেই, নিরাপত্তা নেই, অভাব ছাড়া কিছুই নেই—তারা যে পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী, পরনির্ভর। প্রকৃত স্বাধীনতার অভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি তারা। সমাজ এখন অসম দুটি ভাগে বিভক্ত—বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্রতর ধনী শ্রেণী। এ দুই শ্রেণীর মধ্যে দূরত্ব কমছে না, দিন দিন বরং বাড়ছে। যাঁরা স্বাধীনতা দিবসের উৎসবাদী ও স্লোগানবাজিতে ব্যস্ত, তাঁরা যেন মনে রাখেন, সমাজকে সমভাবে উন্নয়নের পথে ধাবিত না করতে, সমভাবে মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে এ স্বাধীনতা শক্তিহীন, আরও অর্থহীন হয়ে উঠবে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশ হয়তো নতুন কোনো রাজনৈতিক সত্তার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এ অভিমত মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটাই আমাদের কাম্য।
ড. সিরাজুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।স্বাধীনতা সুযোগ এনে দেয় অধীনতাকে উচ্ছেদ করে নিজেকে মেলে ধরার, নিজের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া জাপানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। তখন অঞ্চলটি ছিল ক্রীতদাসনির্ভর একটি সামন্ত সমাজ। ২০ বছরের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় মানবিক অধিকার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মালয়েশিয়া মুক্ত হয় ১৯৫৭ সালে। স্বাধীনতার ৩৫ বছরের মধ্যে দেশটি মূলত জঙ্গল-রাষ্ট্র থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও অর্থনীতিতে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকের নাগপাশ থেকে সিঙ্গাপুর মুক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এটি ছিল নেহাতই একটি মৎস্যবন্দর মাত্র। স্বাধীনতার ২০ বছরের মধ্যে এ মৎস্যবন্দর সিঙ্গাপুর বিশ্বের একটি বিস্ময়কর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটানা ২০ বছর যুদ্ধ করে ভিয়েতনাম স্বাধীন হয় ১৯৭৫ সালে। এর পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেই ভিয়েতনাম বিশ্বের একটি শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর এ ধরনের রূপান্তরের উপমা আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। মোদ্দা কথা, প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষের মানবিক গুণাবলি ও আত্মপ্রত্যয় বাড়িয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় কর্মস্পৃহা ও সৃষ্টিশীলতা। তাত্ত্বিকভাবে অধীনতা মানুষকে নিষ্ক্রিয়-নিষ্প্রভ করে তোলে, কেড়ে নেয় জীবন ও আত্মসম্মানবোধ। এর অবশ্যম্ভাবী ফল দারিদ্র্য, পরনির্ভরশীলতা ও তোষামোদী মনোভাব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরেও বাঙালির জীবনধারায় কোনো লক্ষণীয় রূপান্তর আসেনি। মার্কিন মুলুক থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব দেশ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এ ব্যতিক্রমের কারণ সমাজবিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করতে পারেন। আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আসলে শ্রেণীবিশেষের জন্য, আপামর জনসাধারণের জন্য নয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের মতো বাংলাদেশও একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হতে পারত। স্বাভাবিক কারণেই স্বাধীনতা দিবসের উৎসবে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। যাদের শিক্ষা নেই, চাকরি নেই, রুজি-রোজগার নেই, চিকিৎসা নেই, আবাসন নেই, নিরাপত্তা নেই, অভাব ছাড়া কিছুই নেই—তারা যে পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী, পরনির্ভর। প্রকৃত স্বাধীনতার অভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি তারা। সমাজ এখন অসম দুটি ভাগে বিভক্ত—বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্রতর ধনী শ্রেণী। এ দুই শ্রেণীর মধ্যে দূরত্ব কমছে না, দিন দিন বরং বাড়ছে। যাঁরা স্বাধীনতা দিবসের উৎসবাদী ও স্লোগানবাজিতে ব্যস্ত, তাঁরা যেন মনে রাখেন, সমাজকে সমভাবে উন্নয়নের পথে ধাবিত না করতে, সমভাবে মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে এ স্বাধীনতা শক্তিহীন, আরও অর্থহীন হয়ে উঠবে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশ হয়তো নতুন কোনো রাজনৈতিক সত্তার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এ অভিমত মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটাই আমাদের কাম্য।
No comments