সময়চিত্র-বিএনপি: এগোনোর পথ সহজ নয় by আসিফ নজরুল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিছু বিদেশি কূটনীতিক অত্যন্ত সরব ও সক্রিয় ছিলেন। এ রকম একজনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করার কারণে। তিনি আমার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও কথা বলতেন। ২০০৮-এর জানুয়ারির নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন নির্ধারিত ছিল।
তাঁর কক্ষে ঢোকামাত্র তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমিও নিশ্চয় আমাকে কোনো দুঃসংবাদ দিচ্ছ না?’
আমি অবাক হয়ে বলি, কী দুঃসংবাদ?
তিনি সোফায় বসতে বসতে জানালেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তিনি তাঁকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি জিতে যেতে পারে। তাঁর প্রশ্ন, আমার কী ধারণা?
বেগম জিয়া তখন সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। লোকে লোকারণ্য তাঁর জনসভা। দুই বছর আগে তাঁর সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা ব্যর্থ হয়েছে, তা এত দিনে হয়তো ভুলে গেছে মানুষ। কাজেই বিএনপি জিততেও পারে ২০০৮-এর নির্বাচনে, সেটা খুব অস্বাভাবিক হবে না।
আমার ব্যাখ্যা শুনে তিনি আর্তচিৎকার করে ওঠেন। বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি! মাত্র আর এক বছর আছেন তিনি বাংলাদেশে, বিএনপি জিতলে তাঁর অসুবিধা কী?
আমি দেশি-বিদেশি বহু বিএনপি-বিদ্বেষী মানুষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। দেশি মানুষের অনেকেই এ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। বিএনপির প্রতি তাঁদের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ বিএনপির সাম্প্রদায়িক এমনকি কখনো কখনো জঙ্গিবাদ-প্রশ্রয়মূলক রাজনীতি। এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, তা নিয়ে বিএনপির নেতাদের দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এই ভীতি বিএনপির ব্যাপারে রয়েছে এবং বিএনপি যে পাঁচ-দশ বছর আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, তার একটি বড় কারণ বিএনপির এই ইমেজ-সংকট। বিএনপির ইমেজ-সংকটের আরও কারণ হচ্ছে, দলটির ওপর জামায়াতের প্রভাব, হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও গোষ্ঠীপ্রীতি, তারেক রহমানের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত খবরদারি এবং ভারতকে উত্ত্যক্ত করার বিপজ্জনক রাজনীতি। এগুলো কতটা সত্যি তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এগুলো সত্যি হিসেবে সমাজের উপরিকাঠামোর বহু মানুষ এবং তরুণদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে। বিএনপি যদি এসব মিথ্যে বলে মনে করে থাকে, দলটি তা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি। ১৯৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে সাফল্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করতে পেরেছে, এ জন্য তাকে জামায়াতপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি। এবারও আওয়ামী লীগের সরকার রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ জন্য তাকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত হতে হয়নি। তুলনায় বিএনপি বরং জামায়াত ও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ব্যবহূত হয়েছে, এদের ফাঁদে পা দিয়েছে এবং নিজের ভাবমূর্তি খুইয়েছে।
বিএনপি সেই ইমেজ-সংকট আজও দূর করতে পারেনি। আড়াই হাজার বছর আগে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তির সাফল্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে চর (তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা) ও মিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। তথ্য সংগ্রহ ও অবলোকন করে মিত্র সম্প্রসারণের ক্ষমতা বিএনপির কম। তা বিদেশে যেমন, দেশেও তেমনি সত্যি। এর মূল্য বিএনপিকে এখনো দিতে হচ্ছে। বিএনপির আমলে যেকোনো অনিয়মে সরব নাগরিক সমাজ বা দাতাগোষ্ঠীর কেউ কেউ যে এই সরকারের আমলে নিশ্চুপ করে থাকেন, তার একটি বড় কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির (তথা সাম্প্রদায়িক বা জঙ্গি-সহায়ক শক্তি) ফিরে আসার ভয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির জনভিত্তি থাকলে বিএনপি-বিদ্বেষী এই দেশি-বিদেশি শক্তি কি তাকে ঠেকাতে পারে? আমার ধারণা, কিছুটা হলেও পারে। এই শক্তির নানাভাবে অব্যাহত প্রচারণা চালানোর ক্ষমতা রয়েছে, তার কিছু প্রভাব থাকে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রভাব অনৈতিকভাবে প্রয়োগ করাও সম্ভব।
জনসমর্থন যদি সুসংগঠিত করা যায় এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত করার মতো নেতৃত্ব দেওয়া যায়, তাহলে এই শক্তির প্রভাবও নাকচ করে দেওয়া যায় একপর্যায়ে। বিদেশি এবং অনুগত নাগরিক সমাজের একটি অংশের সমর্থনপুষ্ট এরশাদের পতনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা তা দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির কি জনমত সুসংগঠিত করার সাংগঠনিক ক্ষমতা রয়েছে? রয়েছে সেই নেতৃত্ব আর কর্মী বাহিনী?
২.
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকালের একটি বড় অংশে বিএনপির মূল শক্তি ছিল এর ছাত্রসংগঠন অর্থাৎ ছাত্রদল। এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে ছাত্রদলের একক জনপ্রিয়তা বাকি সব ছাত্রসংগঠনের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে বেশি ছিল। শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ছাত্রদল ছিল বিএনপির অন্যতম চালিকাশক্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ছাত্রদলের নিবেদিতপ্রাণ কিছু নেতৃত্ব সক্রিয় ছিল। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনের পর তাদের গণহারে বিদায় করে ছাত্রদলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় অছাত্র, প্রৌঢ় কিংবা মন্দ ইমেজের ব্যক্তিদের হাতে। এরপর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হয়ে ছাত্রদল বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং হতোদ্যম একটি সংগঠনে পরিণত হয়। বিএনপির একসময়ের শক্তিশালী সংগঠন যুবদলের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি কখনোই আর অটুট থাকেনি এর পর।
মূল দল গুছিয়ে নিতেও বিএনপি ব্যর্থ হয় অনেক ক্ষেত্রে। ১/১১ কেড়ে নেয় সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়ার মতো তুখোড় নেতা এবং তাঁদের অনুসারীদের। তাঁরা এবং আরও আগে দলছুট হয়ে পড়া বদরুদোজ্জা চৌধুরী বা কর্নেল অলিরাই ছিলেন বিএনপিতে তুলনামূলক উজ্জ্বল ভাবমূর্তির নেতা। বিএনপি এঁদের ফিরিয়ে আনতে পারেনি, এঁদের বিকল্পও তৈরি করতে পারেনি। বেগম জিয়ার নতুন মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং অন্য কিছু নেতা দলকে শক্তিশালী করার চেয়ে বরং নিজেদের উপদলকে প্রভাবশালী করার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও টিভি-ক্যামেরাকেন্দ্রিক নেতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে দলের নেতাদের একটি বিশাল অংশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে দলকে গতিশীল করতেও ব্যর্থ হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিথর সময়ে কে এম ওবায়দুর রহমানের পর তুলনামূলক অনুজ্জ্বল সালাম তালুকদার মহাসচিব হয়ে এই কাজটিই করেছিলেন। সারা দেশে জেলা কাউন্সিল করে তিনি বিএনপিতে নতুন প্রাণের জোয়ার সৃষ্টি করেন। এর সুফল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানকালে এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রথম দুই বছরে এই জরুরি কাজটি সুসম্পন্ন করাই বিএনপির উচিত ছিল। কিন্তু তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের যথেষ্টভাবে সম্পৃক্ত করে বিএনপি জেলা কাউন্সিল অনুষ্ঠান করতে পারেনি। আমরা বাইরে থেকে শুনি, অনৈক্যের ভয়ে নাকি বহু সিদ্ধান্ত ঢাকা থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে অনৈক্য কমেনি বরং দলের গতিশীলতা রুদ্ধ হয়েছে।
৩.
বিএনপির একটি বড় সমস্যা, দলের ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমানের ইমেজ-সংকট। তিনি নিজে দুর্নীতি করেছেন কি না বা কতটুকু দুর্নীতি করেছেন, সেটি এ মুহূর্তের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত, অনেক মানুষ তা বিশ্বাসও করে। দলের জন্য আরও যা ক্ষতিকর তা হচ্ছে, তারেক রহমানের কোটারি ও স্তাবককেন্দ্রিক রাজনীতি। তারেকের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নেতা হওয়া যায় না এবং এই গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার প্রতিযোগিতায় বহু ভদ্রলোক নামতে চান না এই ধারণা সমাজে রয়েছে। অতীতে তাঁর আশীর্বাদ যেসব নেতা বা হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা পেয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ, মেধাহীন, উদ্ধত হিসেবে পরিচিত। তারেক যে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে নিজের বন্ধু হিসেবে গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন, তিনি বিকারগ্রস্ত ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তারেককে ছাড়া নিজের বিচার-বিবেচনায় দলকে গুছিয়ে নেওয়ার মানসিকতা বেগম খালেদা জিয়ার আছে কি না, তারেকের সীমাবদ্ধতা তিনি মাতৃত্বের ঊর্ধ্বে উঠে অবলোকন করার ক্ষমতা রাখেন কি না, বা তারেক নিজেই তাঁর পরিশুদ্ধির প্রয়োজন অনুভব করেন কি না, এটি যথেষ্টভাবে পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বিএনপিতে মেধাবী, ত্যাগী ও সৎ নেতৃত্বের শক্তি জোরদার হবে না। বিএনপির গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে একমাত্র অর্জন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের উত্থান। কিন্তু দলে এমন ব্যক্তিরা যথেষ্ট সংখ্যায় ও যথেষ্ট মাত্রায় ক্ষমতাশালী হতে না পারলে দলকে বিকশিত করায় তাঁরা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।
৪.
গত ২০-২৫ বছরের রাজনীতি অবলোকনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন জনসমর্থন, সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, সংগঠিত কর্মী বাহিনী এবং দক্ষ নেতৃত্ব। প্রথম দুটি শর্ত পুরোপুরি উপস্থিত থাকলেও পরের দুটির ক্ষেত্রে বিএনপি এখনো পিছিয়ে আছে অনেক। সে কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাস তোলা বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিভিন্ন ব্যর্থতা, স্থবির সংগঠন, বিভক্ত নেতৃত্ব এবং অনভিজ্ঞ মন্ত্রিসভা নিয়েও প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জে টিকে আছে সরকার।
তাই বলে সরকারের এখনি পতন হওয়া প্রয়োজন, তা নয়। মধ্য মেয়াদে সরকারের পতন ঘটানো বা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা বিরোধী দলের একমাত্র কাজও নয়। বরং সংসদে ও বাইরে সরকারকে অনবরত জবাবদিহির মধ্যে রাখা, বিকল্প উন্নয়ন ও প্রশাসন ভাবনা উপস্থাপন করে সরকারের সঙ্গে শ্রেয়তর বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় নামা এবং জনমত সংগঠিত করা বিরোধী দলের অন্যতম দায়িত্ব। এটি করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের মতো দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে একটি সরকার আরও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে যেকোনোভাবে পরের নির্বাচনে জেতার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ এতে বিপন্ন হয়ে ওঠে।
সরকারের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতার সম্ভাবনা জোরদার হয় শক্তিশালী বিরোধী দল দেশে সক্রিয় থাকলে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশও সৃষ্টি হয় বিরোধী দল শক্তিশালী ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য থাকলে। বিএনপিকে তাই শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে দেশেরই স্বার্থে। বিদ্যমান বিশাল জনসমর্থন ও নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি নিয়ে বিএনপির পক্ষে তা হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়। তবে এ জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কঠিন আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন বিএনপির জন্য।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি অবাক হয়ে বলি, কী দুঃসংবাদ?
তিনি সোফায় বসতে বসতে জানালেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তিনি তাঁকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি জিতে যেতে পারে। তাঁর প্রশ্ন, আমার কী ধারণা?
বেগম জিয়া তখন সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। লোকে লোকারণ্য তাঁর জনসভা। দুই বছর আগে তাঁর সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা ব্যর্থ হয়েছে, তা এত দিনে হয়তো ভুলে গেছে মানুষ। কাজেই বিএনপি জিততেও পারে ২০০৮-এর নির্বাচনে, সেটা খুব অস্বাভাবিক হবে না।
আমার ব্যাখ্যা শুনে তিনি আর্তচিৎকার করে ওঠেন। বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি! মাত্র আর এক বছর আছেন তিনি বাংলাদেশে, বিএনপি জিতলে তাঁর অসুবিধা কী?
আমি দেশি-বিদেশি বহু বিএনপি-বিদ্বেষী মানুষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। দেশি মানুষের অনেকেই এ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। বিএনপির প্রতি তাঁদের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ বিএনপির সাম্প্রদায়িক এমনকি কখনো কখনো জঙ্গিবাদ-প্রশ্রয়মূলক রাজনীতি। এটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, তা নিয়ে বিএনপির নেতাদের দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এই ভীতি বিএনপির ব্যাপারে রয়েছে এবং বিএনপি যে পাঁচ-দশ বছর আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, তার একটি বড় কারণ বিএনপির এই ইমেজ-সংকট। বিএনপির ইমেজ-সংকটের আরও কারণ হচ্ছে, দলটির ওপর জামায়াতের প্রভাব, হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও গোষ্ঠীপ্রীতি, তারেক রহমানের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত খবরদারি এবং ভারতকে উত্ত্যক্ত করার বিপজ্জনক রাজনীতি। এগুলো কতটা সত্যি তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এগুলো সত্যি হিসেবে সমাজের উপরিকাঠামোর বহু মানুষ এবং তরুণদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে। বিএনপি যদি এসব মিথ্যে বলে মনে করে থাকে, দলটি তা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি। ১৯৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে সাফল্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ ব্যবহার করতে পেরেছে, এ জন্য তাকে জামায়াতপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়নি। এবারও আওয়ামী লীগের সরকার রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ জন্য তাকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত হতে হয়নি। তুলনায় বিএনপি বরং জামায়াত ও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ব্যবহূত হয়েছে, এদের ফাঁদে পা দিয়েছে এবং নিজের ভাবমূর্তি খুইয়েছে।
বিএনপি সেই ইমেজ-সংকট আজও দূর করতে পারেনি। আড়াই হাজার বছর আগে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তির সাফল্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে চর (তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা) ও মিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। তথ্য সংগ্রহ ও অবলোকন করে মিত্র সম্প্রসারণের ক্ষমতা বিএনপির কম। তা বিদেশে যেমন, দেশেও তেমনি সত্যি। এর মূল্য বিএনপিকে এখনো দিতে হচ্ছে। বিএনপির আমলে যেকোনো অনিয়মে সরব নাগরিক সমাজ বা দাতাগোষ্ঠীর কেউ কেউ যে এই সরকারের আমলে নিশ্চুপ করে থাকেন, তার একটি বড় কারণ রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির (তথা সাম্প্রদায়িক বা জঙ্গি-সহায়ক শক্তি) ফিরে আসার ভয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির জনভিত্তি থাকলে বিএনপি-বিদ্বেষী এই দেশি-বিদেশি শক্তি কি তাকে ঠেকাতে পারে? আমার ধারণা, কিছুটা হলেও পারে। এই শক্তির নানাভাবে অব্যাহত প্রচারণা চালানোর ক্ষমতা রয়েছে, তার কিছু প্রভাব থাকে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রভাব অনৈতিকভাবে প্রয়োগ করাও সম্ভব।
জনসমর্থন যদি সুসংগঠিত করা যায় এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত করার মতো নেতৃত্ব দেওয়া যায়, তাহলে এই শক্তির প্রভাবও নাকচ করে দেওয়া যায় একপর্যায়ে। বিদেশি এবং অনুগত নাগরিক সমাজের একটি অংশের সমর্থনপুষ্ট এরশাদের পতনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা তা দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির কি জনমত সুসংগঠিত করার সাংগঠনিক ক্ষমতা রয়েছে? রয়েছে সেই নেতৃত্ব আর কর্মী বাহিনী?
২.
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকালের একটি বড় অংশে বিএনপির মূল শক্তি ছিল এর ছাত্রসংগঠন অর্থাৎ ছাত্রদল। এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে ছাত্রদলের একক জনপ্রিয়তা বাকি সব ছাত্রসংগঠনের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে বেশি ছিল। শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ছাত্রদল ছিল বিএনপির অন্যতম চালিকাশক্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ছাত্রদলের নিবেদিতপ্রাণ কিছু নেতৃত্ব সক্রিয় ছিল। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনের পর তাদের গণহারে বিদায় করে ছাত্রদলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় অছাত্র, প্রৌঢ় কিংবা মন্দ ইমেজের ব্যক্তিদের হাতে। এরপর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হয়ে ছাত্রদল বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং হতোদ্যম একটি সংগঠনে পরিণত হয়। বিএনপির একসময়ের শক্তিশালী সংগঠন যুবদলের ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি কখনোই আর অটুট থাকেনি এর পর।
মূল দল গুছিয়ে নিতেও বিএনপি ব্যর্থ হয় অনেক ক্ষেত্রে। ১/১১ কেড়ে নেয় সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়ার মতো তুখোড় নেতা এবং তাঁদের অনুসারীদের। তাঁরা এবং আরও আগে দলছুট হয়ে পড়া বদরুদোজ্জা চৌধুরী বা কর্নেল অলিরাই ছিলেন বিএনপিতে তুলনামূলক উজ্জ্বল ভাবমূর্তির নেতা। বিএনপি এঁদের ফিরিয়ে আনতে পারেনি, এঁদের বিকল্পও তৈরি করতে পারেনি। বেগম জিয়ার নতুন মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং অন্য কিছু নেতা দলকে শক্তিশালী করার চেয়ে বরং নিজেদের উপদলকে প্রভাবশালী করার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও টিভি-ক্যামেরাকেন্দ্রিক নেতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে দলের নেতাদের একটি বিশাল অংশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে দলকে গতিশীল করতেও ব্যর্থ হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নিথর সময়ে কে এম ওবায়দুর রহমানের পর তুলনামূলক অনুজ্জ্বল সালাম তালুকদার মহাসচিব হয়ে এই কাজটিই করেছিলেন। সারা দেশে জেলা কাউন্সিল করে তিনি বিএনপিতে নতুন প্রাণের জোয়ার সৃষ্টি করেন। এর সুফল নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানকালে এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রথম দুই বছরে এই জরুরি কাজটি সুসম্পন্ন করাই বিএনপির উচিত ছিল। কিন্তু তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের যথেষ্টভাবে সম্পৃক্ত করে বিএনপি জেলা কাউন্সিল অনুষ্ঠান করতে পারেনি। আমরা বাইরে থেকে শুনি, অনৈক্যের ভয়ে নাকি বহু সিদ্ধান্ত ঢাকা থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে অনৈক্য কমেনি বরং দলের গতিশীলতা রুদ্ধ হয়েছে।
৩.
বিএনপির একটি বড় সমস্যা, দলের ভবিষ্যৎ নেতা তারেক রহমানের ইমেজ-সংকট। তিনি নিজে দুর্নীতি করেছেন কি না বা কতটুকু দুর্নীতি করেছেন, সেটি এ মুহূর্তের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচারিত, অনেক মানুষ তা বিশ্বাসও করে। দলের জন্য আরও যা ক্ষতিকর তা হচ্ছে, তারেক রহমানের কোটারি ও স্তাবককেন্দ্রিক রাজনীতি। তারেকের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নেতা হওয়া যায় না এবং এই গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার প্রতিযোগিতায় বহু ভদ্রলোক নামতে চান না এই ধারণা সমাজে রয়েছে। অতীতে তাঁর আশীর্বাদ যেসব নেতা বা হাওয়া ভবনের কর্মকর্তা পেয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ, মেধাহীন, উদ্ধত হিসেবে পরিচিত। তারেক যে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে নিজের বন্ধু হিসেবে গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন, তিনি বিকারগ্রস্ত ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তারেককে ছাড়া নিজের বিচার-বিবেচনায় দলকে গুছিয়ে নেওয়ার মানসিকতা বেগম খালেদা জিয়ার আছে কি না, তারেকের সীমাবদ্ধতা তিনি মাতৃত্বের ঊর্ধ্বে উঠে অবলোকন করার ক্ষমতা রাখেন কি না, বা তারেক নিজেই তাঁর পরিশুদ্ধির প্রয়োজন অনুভব করেন কি না, এটি যথেষ্টভাবে পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বিএনপিতে মেধাবী, ত্যাগী ও সৎ নেতৃত্বের শক্তি জোরদার হবে না। বিএনপির গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে একমাত্র অর্জন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের উত্থান। কিন্তু দলে এমন ব্যক্তিরা যথেষ্ট সংখ্যায় ও যথেষ্ট মাত্রায় ক্ষমতাশালী হতে না পারলে দলকে বিকশিত করায় তাঁরা খুব উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।
৪.
গত ২০-২৫ বছরের রাজনীতি অবলোকনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশে ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন জনসমর্থন, সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, সংগঠিত কর্মী বাহিনী এবং দক্ষ নেতৃত্ব। প্রথম দুটি শর্ত পুরোপুরি উপস্থিত থাকলেও পরের দুটির ক্ষেত্রে বিএনপি এখনো পিছিয়ে আছে অনেক। সে কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাস তোলা বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিভিন্ন ব্যর্থতা, স্থবির সংগঠন, বিভক্ত নেতৃত্ব এবং অনভিজ্ঞ মন্ত্রিসভা নিয়েও প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জে টিকে আছে সরকার।
তাই বলে সরকারের এখনি পতন হওয়া প্রয়োজন, তা নয়। মধ্য মেয়াদে সরকারের পতন ঘটানো বা ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা বিরোধী দলের একমাত্র কাজও নয়। বরং সংসদে ও বাইরে সরকারকে অনবরত জবাবদিহির মধ্যে রাখা, বিকল্প উন্নয়ন ও প্রশাসন ভাবনা উপস্থাপন করে সরকারের সঙ্গে শ্রেয়তর বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় নামা এবং জনমত সংগঠিত করা বিরোধী দলের অন্যতম দায়িত্ব। এটি করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের মতো দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে একটি সরকার আরও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে যেকোনোভাবে পরের নির্বাচনে জেতার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ এতে বিপন্ন হয়ে ওঠে।
সরকারের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতার সম্ভাবনা জোরদার হয় শক্তিশালী বিরোধী দল দেশে সক্রিয় থাকলে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশও সৃষ্টি হয় বিরোধী দল শক্তিশালী ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য থাকলে। বিএনপিকে তাই শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে দেশেরই স্বার্থে। বিদ্যমান বিশাল জনসমর্থন ও নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি নিয়ে বিএনপির পক্ষে তা হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়। তবে এ জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কঠিন আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন বিএনপির জন্য।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments