জয়দেবপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ by এনামুল হক
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সে সময় জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টের ২৫-৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার-সৈনিক।
কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খান এবং সেকেন্ড ইন-কমান্ড মেজর কেএম সফিউল্লাহ (পরে এস ফোর্সের অধিনায়ক, সেনাপ্রধান ও এমপি)। এ ছাড়া ছিলেন আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসার_ মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এএএম নাসিম, ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। একদিকে চলছিল স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও বাঙালিদের চিরতরে দাবিয়ে রাখার জন্য এঁটে যাচ্ছিল ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। এ ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি অফিসার-সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ এলো, ১৫ মার্চের মধ্যে ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেলগুলো গুলিসহ ব্রিগেড সদর দফতরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক। ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব নিজেই ১৯ মার্চ রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসবেন। ১৯ মার্চ দুপুরের দিকে জয়দেবপুর সেনানিবাসে তিনি উপস্থিত হলেন। বাঙালি সৈন্যদের পাঞ্জাবিরা নিরস্ত্র করতে এসেছে এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার লোক জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুর। অনেকের হাতে লাঠিসোটা, তীর-ধনুক ও বল্লম। সেনানিবাসে বসেই জাহানজেব এ খবর পান। তিনি ব্যারিকেড অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেন। জনতা এতে রাজি না হলে তিনি বলপ্রয়োগ করে ব্যারিকেড অপসারণ করতে নির্দেশ দেন। এরপর জাহানজেব সামনে বাঙালি সৈন্য ও পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। কিন্তু ব্যারিকেডের জন্য এগোতে না পেরে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। কিন্তু লে. কর্নেল মাসুদ ও মেজর মইন জনতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে তারা 'ফায়ার ফর অ্যাকশন' না করে ফাঁকা গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। পাঞ্জাবি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করছে মনে করে জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সে সময় টাঙ্গাইলে রেশন পেঁৗছে দিয়ে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ট্রাক জয়দেবপুর ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ পাঁচজন বাঙালি সৈন্য ছিলেন এবং তাদের হাতে ছিল এসএমজি ও চাইনিজ রাইফেল। তারাও গুলিবর্ষণ শুরু করেন। জনতার মধ্য থেকে বন্দুক এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাল্টা গুলিবর্ষণে পাঞ্জাবি সৈন্যরা অনেকটা হকচকিয়ে যায়। এদিকে এতদিন বাঙালিরা শুধু মার আর গুলি খেয়ে এসেছে কিন্তু পাল্টা প্রতিরোধ বা গুলি করেনি। জয়দেবপুরের বীর জনতাই সেদিন প্রথম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি পাল্টা গুলিবর্ষণ করেছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। এ ছাড়া গুলিতে আহত হন ইউসুফ, সন্তোষ ও শাহজাহানসহ আরও অনেকে। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তার আরও অনেক ব্যারিকেড অপসারণ করে ঢাকার পথে চান্দনা-চৌরাস্তায় উপস্থিত হয়। এখানেও উত্তেজিত জনতা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চান্দনা-চৌরাস্তায় প্রতিরোধকালে হুরমত আলী নামে এক অসমসাহসী যুবক একজন পাঞ্জাবি সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করতে চেষ্টা করেন। সে সময় অপর একজন পাঞ্জাবি সৈন্যের গুলিতে হুরমত আলী শহীদ হন। চান্দনা চৌরাস্তায় কানু মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি গুলিতে আহত হন এবং পরে তিনি আহতাবস্থায় মারা যান। পরে জাহানজেবের বাহিনী টঙ্গীসহ রাস্তায় আরও অনেক ব্যারিকেড সরিয়ে অতি কষ্টে ঢাকায় পেঁৗছতে সক্ষম হয়।
জয়দেবপুরের বীর জনতার এই প্রতিরোধ যুদ্ধ সমগ্র বাংলাদেশে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। তাই সে সময় উত্তালমুখর বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল_ 'জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'
জয়দেবপুরের বীর জনতার এই প্রতিরোধ যুদ্ধ সমগ্র বাংলাদেশে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করে। তাই সে সময় উত্তালমুখর বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল_ 'জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।'
No comments