নেতৃত্ব-ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই জরুরি by মোঃ জিয়াউল হক শেখ
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা ও সৃজনশীলতার বিকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং দেশে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরিতে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সরকার পক্ষের সদিচ্ছা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকরী সিদ্ধান্ত, শিক্ষক সমাজের ইতিবাচক মনোভাব এবং সর্বোপরি আমাদের
শিক্ষার্থীদের দেশ, জাতি ও সমাজের কথা ভেবে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে তাদের সক্রিয় উদ্যোগ পারে ডাকসুকে সচল করতে
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে তাদের সৃজনশীল মনোভাব সম্পন্ন করে তৈরি করা এবং সর্বোপরি একদল দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) গঠন করা হয়। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করলেও ১৯২৫ সালে ইউনিভার্সিটি জার্নাল প্রকাশ করার মাধ্যমে সৃজনশীলতা প্রকাশের এক বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে ডাকসু। ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ে সিনেট সভায় ছাত্র প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয় ডাকসুর মাধ্যমে। প্রতিটি হলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিভিন্ন ধরনের জার্নাল ও বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে হল সংসদ লাইব্রেরি পরিচালনা, হলের ছাত্রদের সৃজনশীল লেখা সংগ্রহ করে তা নিয়ে জার্নাল প্রকাশ এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে যেমন হল সংসদগুলো কাজ করত, তেমনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এ কাজগুলো করত কেন্দ্রীয়ভাবে। এতে করে একদিকে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত পড়ালেখার পরিবেশ পেয়ে জ্ঞান সাধনায় ব্রত হতো, সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পেত এবং নিজেদের আরও সৃজনশীল করে গড়ে তুলত, অন্যদিকে এর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাই একযোগে প্রতিবাদ করত এবং নিজেরা সমাজ ও দেশের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা নিয়ে বেড়ে উঠত। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে এ বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে কল্পনাপ্রসূত বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে এক বড় ধরনের অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যের কথা বলা হয়। বিশেষ করে প্রচলিত দুর্বৃত্তায়িত অথবা ধর্মীয় বেড়াজালে আবিষ্ট ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বা সংস্কারের কথা আসলে '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির এক গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা বেশি স্মরণ করা হয়। তারা তখনকার ছাত্র আন্দোলন ও বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতিকে এক করে দেখার চেষ্টা করেন। আমি ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন দুটির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখতে পাই। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আমি ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং ছাত্র আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিবেচনা করি বা আমার মতো যারা প্রচলিত ছাত্ররাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, তারা বিবেচনা করে। কারণ, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী সাম্যবাদ বা সমাজতান্ত্রিক ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তারা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাই ভাষা আন্দোলনের সময় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দল যখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দলীয় রাজনৈতিক আদর্শ নয়, দেশ বা জাতীর স্বার্থ রক্ষার আদর্শে তারা পরিচালিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের আদর্শের কিছু ছাত্রই মাত্র ছাত্র আন্দোলনকে তাদের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দলের নির্দেশ অনুসারে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে ছাত্ররাজনীতিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিল। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ছাত্রদের আন্দোলন ছিল ছাত্র আন্দোলন। এতে ছাত্ররাজনীতির অবদান ছিল না।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের 'স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান সংবলিত ছাত্র আন্দোলন হওয়ায় পরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত চারটি সরকার শাসন ক্ষমতায় এলেও তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজ দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বীয় ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করে। এ ছাত্র সংগঠনগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মেধাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য পেশিশক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব বিকাশের পথ বন্ধ করে পেশিশক্তিভিত্তিক স্বীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য তৈরির জন্য ডাকসু নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করল সেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারগুলোর এমন আচরণ ছিল ছাত্রদের জন্য প্রহসন মাত্র।
এ কথা স্বীকার্য, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র সংসদকে নিষ্ক্রিয়করণে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজের ভূমিকাও গৌণ নয়। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের বড় বড় প্রশাসনিক পদ অলঙ্কার করা যায়। সেই দলের ছাত্র সংগঠনের প্রিয়ভাজন হলে তাদের প্রহরায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা বিরাগভাজন হয়ে আন্দোলন করতে চাইলে তাদের ন্যায্য আন্দোলনকে দমানোর জন্য বাড়তি পুলিশ বাহিনীর দরকার হয় না। নিজ দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোই তখন পুলিশ বাহিনীর ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়। ফলে আমাদের শিক্ষক সমাজও ডাকসু নির্বাচনে শুধু অনীহাই দেখায় না, পারলে বিরোধিতাও করে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আশা করি, তিনি ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ছাত্র সমাজের ভূমিকাও কম নয়। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যখন বারবার ডাকসু নির্বাচনে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবের কথা বলা হয়, তখন আমরা নীরব থাকি এবং কখনওবা আমরা প্রমাণ করি যে, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি যৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ অনেক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত। এখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তো নয়-ই বরং অনেক ছাত্রনেতাও জানেন না যে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ নামে কিছু আছে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক ছাত্রনেতারা একত্র হয়ে কখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কখনও সরব হন না।
ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের নেতৃত্বেও। হলগুলোতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতাগুলো নিয়মিত হয় না। সিনেটে ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের কথা কেউ বলতে পারে না। সরকারের দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনো দানা বাঁধে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো প্রতিবাদ হয় না। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে আজ কেউ অনুপ্রেরণা দেয় না বা তাদের সৃজনশীল লেখাগুলোকে নিয়ে কোনো জার্নাল বের হয় না। সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতা আয়োজনের ভার ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের হাতে থাকায় সেখানে ব্যক্তিবিশেষের মতের প্রতিফলনই শুধু ঘটছে না, এটি নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে বলেও অনেকে মনে কনের। ফলে ছাত্রছাত্রীরা একদিকে যেমন অধিকারবঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের কোনো ডানা তারা প্রসারিত করতে পারছেন না। তাদের আকাঙ্ক্ষা এক রূঢ় বাস্তবতার কাছে এসে পরাজিত হচ্ছে।
তবে এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত ১১ মার্চ রোববার ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সামনে এ নিয়ে লাগাতার কর্মসূচিরও ঘোষণা দিয়েছেন। এতদিন তারা মনেপ্রাণে ডাকসুু নির্বাচন চাইলেও কখনও জোর দাবি জানাননি বা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ভয়ে জানাতে সাহস পাননি। সম্প্রতি তারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনিভাবেও মাঠে নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ জন শিক্ষার্থী অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও কোষাধ্যক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ অনুরোধ কার্যকর করা না হলে এ ব্যাপারে রিট দায়েরের কথা বলা হয়েছে ওই নোটিশে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শিশুকাল থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে দেশে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে মাধ্যমিক পর্যায়েও এ ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার উদ্যোগ নেওয়া হলে ২০ বছর ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু নির্বাচন দিয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে কেন গণতান্ত্রিক চেতনা ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশকে ত্বরান্বিত করা হবে না?
তাই বলব, ডাকসু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি সাধারণ ছাত্রছাত্রীই তার হৃদয়ে লালন করছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা ও সৃজনশীলতার বিকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং দেশে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরিতে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সরকার পক্ষের সদিচ্ছা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকরী সিদ্ধান্ত, শিক্ষক সমাজের ইতিবাচক মনোভাব এবং সর্বোপরি আমাদের শিক্ষার্থীদের দেশ, জাতি ও সমাজের কথা ভেবে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীনির ঊধর্ে্ব উঠে তাদের সক্রিয় উদ্যোগ পারে ডাকসুকে সচল করতে। আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিকূল বাস্তবতার কাছে পরাজিত নয়, বরং জয় করাটাই আমাদের ঐতিহ্য। আশা করি সব পক্ষই আমাদের ঐতিহ্যেরই ধারক হবেন।
মোঃ জিয়াউল হক শেখ :শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে তাদের সৃজনশীল মনোভাব সম্পন্ন করে তৈরি করা এবং সর্বোপরি একদল দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) গঠন করা হয়। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু করলেও ১৯২৫ সালে ইউনিভার্সিটি জার্নাল প্রকাশ করার মাধ্যমে সৃজনশীলতা প্রকাশের এক বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে ডাকসু। ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ে সিনেট সভায় ছাত্র প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয় ডাকসুর মাধ্যমে। প্রতিটি হলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিভিন্ন ধরনের জার্নাল ও বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে হল সংসদ লাইব্রেরি পরিচালনা, হলের ছাত্রদের সৃজনশীল লেখা সংগ্রহ করে তা নিয়ে জার্নাল প্রকাশ এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে যেমন হল সংসদগুলো কাজ করত, তেমনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এ কাজগুলো করত কেন্দ্রীয়ভাবে। এতে করে একদিকে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত পড়ালেখার পরিবেশ পেয়ে জ্ঞান সাধনায় ব্রত হতো, সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পেত এবং নিজেদের আরও সৃজনশীল করে গড়ে তুলত, অন্যদিকে এর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাই একযোগে প্রতিবাদ করত এবং নিজেরা সমাজ ও দেশের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা নিয়ে বেড়ে উঠত। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে এ বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে কল্পনাপ্রসূত বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে এক বড় ধরনের অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যের কথা বলা হয়। বিশেষ করে প্রচলিত দুর্বৃত্তায়িত অথবা ধর্মীয় বেড়াজালে আবিষ্ট ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বা সংস্কারের কথা আসলে '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির এক গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা বেশি স্মরণ করা হয়। তারা তখনকার ছাত্র আন্দোলন ও বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতিকে এক করে দেখার চেষ্টা করেন। আমি ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন দুটির মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখতে পাই। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আমি ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং ছাত্র আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিবেচনা করি বা আমার মতো যারা প্রচলিত ছাত্ররাজনীতিতে বিশ্বাস করে না, তারা বিবেচনা করে। কারণ, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী সাম্যবাদ বা সমাজতান্ত্রিক ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তারা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাই ভাষা আন্দোলনের সময় কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দল যখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দলীয় রাজনৈতিক আদর্শ নয়, দেশ বা জাতীর স্বার্থ রক্ষার আদর্শে তারা পরিচালিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের আদর্শের কিছু ছাত্রই মাত্র ছাত্র আন্দোলনকে তাদের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দলের নির্দেশ অনুসারে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে ছাত্ররাজনীতিতে রূপান্তর করতে চেয়েছিল। তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ছাত্রদের আন্দোলন ছিল ছাত্র আন্দোলন। এতে ছাত্ররাজনীতির অবদান ছিল না।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের 'স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগান সংবলিত ছাত্র আন্দোলন হওয়ায় পরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত চারটি সরকার শাসন ক্ষমতায় এলেও তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজ দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বীয় ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করে। এ ছাত্র সংগঠনগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মেধাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য পেশিশক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব বিকাশের পথ বন্ধ করে পেশিশক্তিভিত্তিক স্বীয় রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য তৈরির জন্য ডাকসু নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করল সেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারগুলোর এমন আচরণ ছিল ছাত্রদের জন্য প্রহসন মাত্র।
এ কথা স্বীকার্য, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র সংসদকে নিষ্ক্রিয়করণে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজের ভূমিকাও গৌণ নয়। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের বড় বড় প্রশাসনিক পদ অলঙ্কার করা যায়। সেই দলের ছাত্র সংগঠনের প্রিয়ভাজন হলে তাদের প্রহরায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা বিরাগভাজন হয়ে আন্দোলন করতে চাইলে তাদের ন্যায্য আন্দোলনকে দমানোর জন্য বাড়তি পুলিশ বাহিনীর দরকার হয় না। নিজ দলের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোই তখন পুলিশ বাহিনীর ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়। ফলে আমাদের শিক্ষক সমাজও ডাকসু নির্বাচনে শুধু অনীহাই দেখায় না, পারলে বিরোধিতাও করে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আশা করি, তিনি ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ছাত্র সমাজের ভূমিকাও কম নয়। সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যখন বারবার ডাকসু নির্বাচনে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবের কথা বলা হয়, তখন আমরা নীরব থাকি এবং কখনওবা আমরা প্রমাণ করি যে, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি যৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ অনেক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত। এখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তো নয়-ই বরং অনেক ছাত্রনেতাও জানেন না যে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ নামে কিছু আছে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক ছাত্রনেতারা একত্র হয়ে কখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কখনও সরব হন না।
ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশের নেতৃত্বেও। হলগুলোতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতাগুলো নিয়মিত হয় না। সিনেটে ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের কথা কেউ বলতে পারে না। সরকারের দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনো দানা বাঁধে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো প্রতিবাদ হয় না। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে আজ কেউ অনুপ্রেরণা দেয় না বা তাদের সৃজনশীল লেখাগুলোকে নিয়ে কোনো জার্নাল বের হয় না। সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতা আয়োজনের ভার ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের হাতে থাকায় সেখানে ব্যক্তিবিশেষের মতের প্রতিফলনই শুধু ঘটছে না, এটি নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে বলেও অনেকে মনে কনের। ফলে ছাত্রছাত্রীরা একদিকে যেমন অধিকারবঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের কোনো ডানা তারা প্রসারিত করতে পারছেন না। তাদের আকাঙ্ক্ষা এক রূঢ় বাস্তবতার কাছে এসে পরাজিত হচ্ছে।
তবে এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত ১১ মার্চ রোববার ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সামনে এ নিয়ে লাগাতার কর্মসূচিরও ঘোষণা দিয়েছেন। এতদিন তারা মনেপ্রাণে ডাকসুু নির্বাচন চাইলেও কখনও জোর দাবি জানাননি বা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ভয়ে জানাতে সাহস পাননি। সম্প্রতি তারা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনিভাবেও মাঠে নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ জন শিক্ষার্থী অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও কোষাধ্যক্ষকে আইনি নোটিশ দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ অনুরোধ কার্যকর করা না হলে এ ব্যাপারে রিট দায়েরের কথা বলা হয়েছে ওই নোটিশে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শিশুকাল থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উদ্যোগে দেশে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে মাধ্যমিক পর্যায়েও এ ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার উদ্যোগ নেওয়া হলে ২০ বছর ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু নির্বাচন দিয়ে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে কেন গণতান্ত্রিক চেতনা ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশকে ত্বরান্বিত করা হবে না?
তাই বলব, ডাকসু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি সাধারণ ছাত্রছাত্রীই তার হৃদয়ে লালন করছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা ও সৃজনশীলতার বিকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং দেশে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরিতে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সরকার পক্ষের সদিচ্ছা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকরী সিদ্ধান্ত, শিক্ষক সমাজের ইতিবাচক মনোভাব এবং সর্বোপরি আমাদের শিক্ষার্থীদের দেশ, জাতি ও সমাজের কথা ভেবে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীনির ঊধর্ে্ব উঠে তাদের সক্রিয় উদ্যোগ পারে ডাকসুকে সচল করতে। আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিকূল বাস্তবতার কাছে পরাজিত নয়, বরং জয় করাটাই আমাদের ঐতিহ্য। আশা করি সব পক্ষই আমাদের ঐতিহ্যেরই ধারক হবেন।
মোঃ জিয়াউল হক শেখ :শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments