আন্তঃনদী সংযোগ-অহেতুক খাল কেটে কুমির ডেকে আনা by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপদের পাশাপাশি আমার আশঙ্কা হচ্ছে, দুই দেশেই দেখা দেবে রাজনৈতিক নৈরাজ্য। গত ছয় দশক ধরে নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেছে, এক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পই তা ভেস্তে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি মনে করি, সর্বনাশা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়ে দিতে হবে। এই ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরেও পাওয়া যাবে ব্যাপক সমর্থন। এর আগে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ কর্মীরা দফায় দফায় একমত হয়েছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলকর হতে পারে না
বহুল সমালোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর প্রতি নির্দেশ জারি করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আসলে একটি পরিত্যক্ত ইস্যুকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছেন। আমি মনে করি, সেখানকার সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের নির্দেশ বাস্তবতাবর্জিতও। কারণ, যদিও 'প্রকল্প' বলা হচ্ছে; আন্তঃনদী সংযোগ বা ভারতের এক অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রবাহ কৃত্রিম খাল কেটে অন্য অঞ্চলে নেওয়ার বিষয়টি বাস্তবে 'পরিকল্পনা' মাত্র। নদী সংযোগের পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায়েই থেমে ছিল। ভারতীয় সরকার এটি অবশ্য বাতিল করেনি। আবার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও ছিল না। এটা আসলে আর দশটা বাস্তবায়ন-অযোগ্য পরিকল্পনার সঙ্গে হিমাগারে পড়ে ছিল।
ওয়াকিবহালরা জানেন, কোনো পরিকল্পনা প্রকল্প হয়ে ওঠার আগে পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো ধাপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই হতে হয়। সেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অযোগ্যও বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেসব বিবেচনা না করে বাস্তবায়নের জন্যই যেভাবে সময় বেঁধে দিয়েছেন, তা আধুনিক উন্নয়ন ধারণা তা সমর্থন করতে পারে না। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ ড. রামাসোয়ামি আর আইয়ার মার্চের গোড়ার দিকে ভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। আমি আর সেদিকে যাব না।
আমি মনে করি, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যাই বলুন না কেন, আন্তঃনদী সংযোগ 'প্রকল্প' কারিগরিভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলো থেকে পানি টেনে নেওয়া কঠিন ব্যাপার। যে ১৬টি খালের মাধ্যমে পানি টেনে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা কার্যকর থাকবে আমার সন্দেহ রয়েছে। বড় কথা হচ্ছে, যে দুই প্রধান নদী থেকে পানি নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, সেই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গাতেই এখন পানি সংকট। আগে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতো, গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কথাও ভাবতে হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে হিমালয় থেকে পানির জোগান কমে যাবে। হিমবাহ ও বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের নদীগুলোর যে জীবনচক্র গড়ে উঠেছে, তা পুরোটাই ব্যাহত হতে পারে। মূল নদীতেই যদি পানি না থাকে, খাল কেটে লাভ কী? কেবল আমরা নই, ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও বারবার কিন্তু বলে এসেছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আসলে খাল কেটে বিপর্যয়ের কুমির ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতের সরকারও কিন্তু এসব দিক বিবেচনা করে তথাকথিত প্রকল্পটি হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কারিগরি অযোগ্যতা সত্ত্বেও যদি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে গিয়ে ভারতীয় সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে, সেটা তাদের জন্যই নানা দিক থেকে আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। ১৬টি খাল কাটতে গিয়ে বিস্তৃত অংশে বন উজাড় ও পাহাড় কাটতে হবে। প্রকৃতিতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। কাটা খাল ও পাহাড়ের মাটিতে খোদ নদীগুলোও ভরাট হবে। অন্যদিকে বনাঞ্চল হচ্ছে নদীর পানির উৎস। বর্ষায় এর শিকড়ের নেটওয়ার্ক পানি ধরে রাখে। শুকনো মৌসুমে সেগুলো চুইয়ে নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে। খাল কাটতে গিয়ে বন ও পাহাড় উজাড় করলে নদী পানি পাবে কোথায়? ভরাট ও প্রবাহহীন নদী থেকে কোনোভাবেই আগের মতো মৎস্যসম্পদ আহরণ ও সেচ চালানো সম্ভব হবে না। আবার নদী একটি অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে রাখে। নদী প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে ভারতের চিরসবুজ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাবে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবিকা নদী, বন ও কৃষিনির্ভর। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সব ধরনের জীবিকাতেই আঘাত হানবে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে দারিদ্র্য আরও বাড়বে। ব্যাহত হবে গোটা দক্ষিণ এশীয় অর্থনীতির গতি। বিশেষজ্ঞরা বারবারই হুশিয়ার করে দিয়ে আসছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হচ্ছে সেধে বিপর্যয় ডেকে আনা। খোদ ভারতেই দেখা দেবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
বাংলাদেশের কথা বলাই বাহুল্য। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার প্রবাহই এ দেশের ভূমি, সভ্যতা, কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, যোগাযোগ, অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। যদি দুই প্রধান নদীর পানি টেনে নেওয়া হয়, তাহলে তো এসব প্রক্রিয়া স্বভাবতই ব্যাহত হবে। এর ওপর উজানে যে বিপর্যয় দেখা দেবে সেগুলো ভাটিতেও চলে আসবে। উজানের মতো ভাটিরও প্রকৃতি, অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপদ হবে সমুদ্র উপকূল। নদীর কারণে এর লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুই প্রধান নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে মূল ভূখণ্ডের অনেক অভ্যন্তরে লবণাক্ততা চলে আসবে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপদের পাশাপাশি আমার আশঙ্কা হচ্ছে, দুই দেশেই দেখা দেবে রাজনৈতিক নৈরাজ্য। গত ছয় দশক ধরে নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেছে, এক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পই তা ভেস্তে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি মনে করি, সর্বনাশা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়ে দিতে হবে। এই ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরেও পাওয়া যাবে ব্যাপক সমর্থন। এর আগে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ কর্মীরা দফায় দফায় একমত হয়েছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলকর হতে পারে না।
আমি এও আশা করি, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববেন। কারণ, আমার বিশ্বাস হয় না যে সুপ্রিম কোর্ট সবকিছু জেনেশুনে রায় দিয়েছেন। আদালতের রায় বা নির্দেশ সবসময়ই জনস্বার্থের অনুকূলে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো কেন, তা নিশ্চয়ই আদালত খতিয়ে দেখবেন। ভৌগোলিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বিশ্বের কোনো দেশের আদালতই প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যয়কর, অর্থনৈতিকভাবে বিপজ্জনক, রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতে পারেন না।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
বহুল সমালোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর প্রতি নির্দেশ জারি করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আসলে একটি পরিত্যক্ত ইস্যুকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছেন। আমি মনে করি, সেখানকার সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের নির্দেশ বাস্তবতাবর্জিতও। কারণ, যদিও 'প্রকল্প' বলা হচ্ছে; আন্তঃনদী সংযোগ বা ভারতের এক অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রবাহ কৃত্রিম খাল কেটে অন্য অঞ্চলে নেওয়ার বিষয়টি বাস্তবে 'পরিকল্পনা' মাত্র। নদী সংযোগের পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায়েই থেমে ছিল। ভারতীয় সরকার এটি অবশ্য বাতিল করেনি। আবার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও ছিল না। এটা আসলে আর দশটা বাস্তবায়ন-অযোগ্য পরিকল্পনার সঙ্গে হিমাগারে পড়ে ছিল।
ওয়াকিবহালরা জানেন, কোনো পরিকল্পনা প্রকল্প হয়ে ওঠার আগে পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো ধাপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই হতে হয়। সেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অযোগ্যও বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেসব বিবেচনা না করে বাস্তবায়নের জন্যই যেভাবে সময় বেঁধে দিয়েছেন, তা আধুনিক উন্নয়ন ধারণা তা সমর্থন করতে পারে না। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞ ড. রামাসোয়ামি আর আইয়ার মার্চের গোড়ার দিকে ভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। আমি আর সেদিকে যাব না।
আমি মনে করি, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যাই বলুন না কেন, আন্তঃনদী সংযোগ 'প্রকল্প' কারিগরিভাবেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলো থেকে পানি টেনে নেওয়া কঠিন ব্যাপার। যে ১৬টি খালের মাধ্যমে পানি টেনে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা কার্যকর থাকবে আমার সন্দেহ রয়েছে। বড় কথা হচ্ছে, যে দুই প্রধান নদী থেকে পানি নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, সেই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গাতেই এখন পানি সংকট। আগে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতো, গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কথাও ভাবতে হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে হিমালয় থেকে পানির জোগান কমে যাবে। হিমবাহ ও বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের নদীগুলোর যে জীবনচক্র গড়ে উঠেছে, তা পুরোটাই ব্যাহত হতে পারে। মূল নদীতেই যদি পানি না থাকে, খাল কেটে লাভ কী? কেবল আমরা নই, ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও বারবার কিন্তু বলে এসেছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আসলে খাল কেটে বিপর্যয়ের কুমির ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতের সরকারও কিন্তু এসব দিক বিবেচনা করে তথাকথিত প্রকল্পটি হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কারিগরি অযোগ্যতা সত্ত্বেও যদি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে গিয়ে ভারতীয় সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে, সেটা তাদের জন্যই নানা দিক থেকে আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। ১৬টি খাল কাটতে গিয়ে বিস্তৃত অংশে বন উজাড় ও পাহাড় কাটতে হবে। প্রকৃতিতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। কাটা খাল ও পাহাড়ের মাটিতে খোদ নদীগুলোও ভরাট হবে। অন্যদিকে বনাঞ্চল হচ্ছে নদীর পানির উৎস। বর্ষায় এর শিকড়ের নেটওয়ার্ক পানি ধরে রাখে। শুকনো মৌসুমে সেগুলো চুইয়ে নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে। খাল কাটতে গিয়ে বন ও পাহাড় উজাড় করলে নদী পানি পাবে কোথায়? ভরাট ও প্রবাহহীন নদী থেকে কোনোভাবেই আগের মতো মৎস্যসম্পদ আহরণ ও সেচ চালানো সম্ভব হবে না। আবার নদী একটি অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে রাখে। নদী প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে ভারতের চিরসবুজ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাবে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবিকা নদী, বন ও কৃষিনির্ভর। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সব ধরনের জীবিকাতেই আঘাত হানবে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে দারিদ্র্য আরও বাড়বে। ব্যাহত হবে গোটা দক্ষিণ এশীয় অর্থনীতির গতি। বিশেষজ্ঞরা বারবারই হুশিয়ার করে দিয়ে আসছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হচ্ছে সেধে বিপর্যয় ডেকে আনা। খোদ ভারতেই দেখা দেবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
বাংলাদেশের কথা বলাই বাহুল্য। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার প্রবাহই এ দেশের ভূমি, সভ্যতা, কৃষি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, যোগাযোগ, অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। যদি দুই প্রধান নদীর পানি টেনে নেওয়া হয়, তাহলে তো এসব প্রক্রিয়া স্বভাবতই ব্যাহত হবে। এর ওপর উজানে যে বিপর্যয় দেখা দেবে সেগুলো ভাটিতেও চলে আসবে। উজানের মতো ভাটিরও প্রকৃতি, অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপদ হবে সমুদ্র উপকূল। নদীর কারণে এর লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। দুই প্রধান নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে মূল ভূখণ্ডের অনেক অভ্যন্তরে লবণাক্ততা চলে আসবে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপদের পাশাপাশি আমার আশঙ্কা হচ্ছে, দুই দেশেই দেখা দেবে রাজনৈতিক নৈরাজ্য। গত ছয় দশক ধরে নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেছে, এক আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পই তা ভেস্তে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমি মনে করি, সর্বনাশা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়ে দিতে হবে। এই ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরেও পাওয়া যাবে ব্যাপক সমর্থন। এর আগে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ কর্মীরা দফায় দফায় একমত হয়েছেন যে, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলকর হতে পারে না।
আমি এও আশা করি, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতও বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববেন। কারণ, আমার বিশ্বাস হয় না যে সুপ্রিম কোর্ট সবকিছু জেনেশুনে রায় দিয়েছেন। আদালতের রায় বা নির্দেশ সবসময়ই জনস্বার্থের অনুকূলে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো কেন, তা নিশ্চয়ই আদালত খতিয়ে দেখবেন। ভৌগোলিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বিশ্বের কোনো দেশের আদালতই প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যয়কর, অর্থনৈতিকভাবে বিপজ্জনক, রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতে পারেন না।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
No comments