গোধূলির ছায়াপথে-ফুল দাও, ভালোবাসা পাবে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
মন ভেঙে পড়ছে। বিভক্তির দিকে এগিয়ে চলেছি নির্দ্বিধায়, মনে হয় না সামনে শান্তি। কেউ কাউকে ছাড় দেব না, যে যেদিকে ইচ্ছে, চলব। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নাম বাংলাদেশি গণতন্ত্র। বিদেশে নেত্রীদের কালো পতাকা দেখানোর জন্য কিছু লোক প্রস্তুত। কালো পতাকা কালো মনের প্রতিচ্ছবি।
সামান্যের প্রত্যাশায় বিসর্জনের জন্য ওত পেতে আছে ওরা। যারা ক্ষমতায়, অসংযত সংলাপ মুহূর্তের জন্যও পরিহার করি না। দুর্বিনীত পথে চলতে গিয়ে ধাক্কা, পড়ে যাই খন্দকে। কালো কাচের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বড় গাড়ির মাস্তুলে দুলছে লাল-সবুজ। তার আন্দোলনে ভাবি, সবই আয়ত্তাধীন। বালকও জানে, তা নয়।
দুই দিন আগে বিদায়ী মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে দেখলাম এক ধর্মসভায় আল্লার কাছে ফরিয়াদ করছেন কেঁদে কেঁদে, কদিন আগে যিনি ক্ষমতার সুউচ্চ চূড়ায়। সেই সভায় তিনি আমার মতোই একজন সাধারণ মানুষ বৈকি। হয়তো কোনো দিন হূদয়ঙ্গম করবেন, তাঁর সব সই যুক্তিযুক্ত ছিল না, যে কারণে ভবিষ্যতে আরও কান্নার ফরিয়াদে অংশ নিতে হবে তাঁকে। ক্ষমতার চতুর্দোলায় যখন চড়ে বসি, তখন নিজেদের যা নয়, তা-ই ভাবা সহজ। এ পথের পথিকেরা পথটি ভালোভাবেই চেনেন। বহুদিন তাঁরাও ক্ষমতা ছুঁতে পারেননি। বুদ্ধিমান তাঁরাই, ক্ষমা চাওয়া শিখেছেন যাঁরা, মানুষের কাছে, বিধাতার কাছে। কারণ প্রতিক্ষণ আমরা ভুলের আবর্তে।
কে শুনবে কার কথা? টেলিফোনটি নিন এবং রোজ কথা বলুন, একজন আরেকজনকে বোঝান। দেশটি কজনের নয়, কোটি কোটি মানুষের। তারা চায়, আপনারা দুজন প্রতিটি ব্যাপারে বসে আলোচনা করুন। আল্লাহর ওয়াস্তে বিভেদ ভুলে যান। দেশটি অভাগা, সঠিক নেতৃত্ব নেই। দুজনের ভাগ্যে নেতৃত্ব প্রিয়জনদের হত্যার কারণে। আপনাদের অবদান আছে, অনস্বীকার্য। ৫০ বছর পর ইতিহাস আপনাদের দুজনের জন্য তুলে দেবে সবচেয়ে সুন্দর ফুলের মালা। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জানি, সত্যিকার দেশ-দরদি রাজনীতিকেরা এই মালাটুকুরই কাঙাল।
বাজারে সুন্দর ফুল পাওয়া যাচ্ছে, প্রতিদিন আসছে বিমানে করে চীনের কওমিন থেকে। কিনে নিয়ে আসি প্রেয়সীর জন্য। দুজন দুজনকে ফুল পাঠান। টাটকা ফল—যেমন আম লিচু—এগুলো পাঠান। নিশ্চিত, এতে ফল হবে। মানুষের মন কোন সময় নরম হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। সবাই জানে, আপনারা দুজনই দুঃখী। মনের দিক দিয়ে কাছাকাছি হোন। দেশের মানুষকে রেহাই দিন।
বন্ধুরা, যাঁরা যত বড় ইজমের দাপটি সম্রাট তত জেল্লা তাঁদের চেহারায়, তাঁদের চলনে-বলনে তত প্রস্তুত বক্তৃতার খৈ। তা ফুটছে ঠোঁটের ফাঁকে যখন-তখন চ্যানেলে চ্যানেলে তির্যক হাসিসহ। যেন সবকিছু বুঝে দিগ্গজ হয়ে বসেছেন। তাঁদের নিজ স্বার্থ আগে, দেশমাতৃকা পরে।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে চারজন সাংবাদিককে নির্মমভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। অপরাধ, ৮৫ লাখ টাকার সংস্কার চলছে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করে সরকারি দলের লোক দিয়ে। অচিরেই শুনব, দেড় শ কোটি টাকা খরচে বিশ্ববিদ্যালয় হবে দেড় শ বছরের নামে। এতে হবে দুই কাজ: খুশি হবে কবির পূর্বতন প্রজাদের আত্মা, বর্তমান প্রেতাত্মারাও খুশিতে বাগবাগ। ব্যবসা বলে কথা। রবীন্দ্রাত্মা দূর থেকে হাসবে।
সবচেয়ে বড় শত্রু কী? হিংসা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিংসুক আমি। ক্ষমা শিখিনি। তাই কোনো দিন বেহেশতে প্রবেশাধিকার পাব না। নেতাদের কীভাবে বোঝাতে পারব? আমার কাছে নেই কোনো গল্প। সম্প্রতি নজরুলের জীবনী নিয়ে অনেক সময় দেওয়ায় মনে পড়ছে তাঁর জীবনের গল্প।
নজরুল বললেন, ‘হিন্দুরা আমাকে “যবন” বলে, মুসলমানরা “কাফের”, ওরাই আবার আমাকে মালা দেয়। যত দিন দুটিতে মিলে সমঝোতার পথে মিলিত না হব তত দিন দুর্ভাগাই রয়ে যাব।’
প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ বললেন, ‘তাহলে আমরা ঈমান আকিদা নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। আলাদা ছিলাম, আছি, থাকব। অসুবিধা কী?’
নজরুল বললেন, ‘আগে খোঁজ নিন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করে কারা। মন্বন্তরের জন্য কারা দায়ী, খোঁজ নিন। মহাযুদ্ধের জন্য দায়ী কারা, খোঁজ নিন। সবার বিরুদ্ধে সম্মিলিত কার্যক্রম না হলে শুধু ভাগই হতে থাকব, মিল হবে না।’
এস ওয়াজেদ আলী বললেন, ‘তাহলে কাজীদা, তোমার ওই “স্বরাজ পার্টি”, যার নেতা দেশবন্ধু, হেমন্তকুমার সরকার, যার সমর্থক নেতাজি, তারা কী চায়?’
নজরুলের চোখ এবার নেচে উঠল। বললেন, ‘সমাজ থেকে ওই সব মানুষের নির্বাসন, যারা হিন্দুকে হিংসা করে, মুসলমানদের মুসলমান থাকতে দেয় না, যারা সর্বহারাদের সমর্থন করে না।’
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। নজরুলের দিকে কয়েকটি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কাজীদা, এবার পান খাও। গতকাল এই গানটি বেরিয়েছে, শুনেছ?
“ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
হিংসায় গড়া তলোয়ারখানি ভেঙে কর খান খান”।’
নজরুল বললেন, ‘শুনেছি। আব্বাস আর মৃণাল কান্তির গাওয়া। হিংসা যাবে না, মঈনুদ্দিন, যতক্ষণ হিংসাকে পুষে রাখো। মানুষ দুই শ্রেণীতে: পনেরো আনা শান্ত, এক আনা অশান্ত। বাতাসও তাই, পনেরো আনা শান্ত অক্সিজেন, এক আনা অশান্ত নাইট্রোজেন। সমাজ থেকে ওই বিষাক্ত বায়ু যতক্ষণ বের করে দিতে না পারছ, ততক্ষণ আগুন জ্বলার আশঙ্কা থেকেই যাবে।’
‘ভাগাভাগি করে তাহলে কী পাব?’
‘আরও ভাগাভাগি।’
‘তাহলে?’
‘মনটাকে নরম করো। ক্ষমা চাও। ফুল দাও, ভালোবাসা পাবে।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
দুই দিন আগে বিদায়ী মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে দেখলাম এক ধর্মসভায় আল্লার কাছে ফরিয়াদ করছেন কেঁদে কেঁদে, কদিন আগে যিনি ক্ষমতার সুউচ্চ চূড়ায়। সেই সভায় তিনি আমার মতোই একজন সাধারণ মানুষ বৈকি। হয়তো কোনো দিন হূদয়ঙ্গম করবেন, তাঁর সব সই যুক্তিযুক্ত ছিল না, যে কারণে ভবিষ্যতে আরও কান্নার ফরিয়াদে অংশ নিতে হবে তাঁকে। ক্ষমতার চতুর্দোলায় যখন চড়ে বসি, তখন নিজেদের যা নয়, তা-ই ভাবা সহজ। এ পথের পথিকেরা পথটি ভালোভাবেই চেনেন। বহুদিন তাঁরাও ক্ষমতা ছুঁতে পারেননি। বুদ্ধিমান তাঁরাই, ক্ষমা চাওয়া শিখেছেন যাঁরা, মানুষের কাছে, বিধাতার কাছে। কারণ প্রতিক্ষণ আমরা ভুলের আবর্তে।
কে শুনবে কার কথা? টেলিফোনটি নিন এবং রোজ কথা বলুন, একজন আরেকজনকে বোঝান। দেশটি কজনের নয়, কোটি কোটি মানুষের। তারা চায়, আপনারা দুজন প্রতিটি ব্যাপারে বসে আলোচনা করুন। আল্লাহর ওয়াস্তে বিভেদ ভুলে যান। দেশটি অভাগা, সঠিক নেতৃত্ব নেই। দুজনের ভাগ্যে নেতৃত্ব প্রিয়জনদের হত্যার কারণে। আপনাদের অবদান আছে, অনস্বীকার্য। ৫০ বছর পর ইতিহাস আপনাদের দুজনের জন্য তুলে দেবে সবচেয়ে সুন্দর ফুলের মালা। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জানি, সত্যিকার দেশ-দরদি রাজনীতিকেরা এই মালাটুকুরই কাঙাল।
বাজারে সুন্দর ফুল পাওয়া যাচ্ছে, প্রতিদিন আসছে বিমানে করে চীনের কওমিন থেকে। কিনে নিয়ে আসি প্রেয়সীর জন্য। দুজন দুজনকে ফুল পাঠান। টাটকা ফল—যেমন আম লিচু—এগুলো পাঠান। নিশ্চিত, এতে ফল হবে। মানুষের মন কোন সময় নরম হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। সবাই জানে, আপনারা দুজনই দুঃখী। মনের দিক দিয়ে কাছাকাছি হোন। দেশের মানুষকে রেহাই দিন।
বন্ধুরা, যাঁরা যত বড় ইজমের দাপটি সম্রাট তত জেল্লা তাঁদের চেহারায়, তাঁদের চলনে-বলনে তত প্রস্তুত বক্তৃতার খৈ। তা ফুটছে ঠোঁটের ফাঁকে যখন-তখন চ্যানেলে চ্যানেলে তির্যক হাসিসহ। যেন সবকিছু বুঝে দিগ্গজ হয়ে বসেছেন। তাঁদের নিজ স্বার্থ আগে, দেশমাতৃকা পরে।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে চারজন সাংবাদিককে নির্মমভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। অপরাধ, ৮৫ লাখ টাকার সংস্কার চলছে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করে সরকারি দলের লোক দিয়ে। অচিরেই শুনব, দেড় শ কোটি টাকা খরচে বিশ্ববিদ্যালয় হবে দেড় শ বছরের নামে। এতে হবে দুই কাজ: খুশি হবে কবির পূর্বতন প্রজাদের আত্মা, বর্তমান প্রেতাত্মারাও খুশিতে বাগবাগ। ব্যবসা বলে কথা। রবীন্দ্রাত্মা দূর থেকে হাসবে।
সবচেয়ে বড় শত্রু কী? হিংসা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিংসুক আমি। ক্ষমা শিখিনি। তাই কোনো দিন বেহেশতে প্রবেশাধিকার পাব না। নেতাদের কীভাবে বোঝাতে পারব? আমার কাছে নেই কোনো গল্প। সম্প্রতি নজরুলের জীবনী নিয়ে অনেক সময় দেওয়ায় মনে পড়ছে তাঁর জীবনের গল্প।
নজরুল বললেন, ‘হিন্দুরা আমাকে “যবন” বলে, মুসলমানরা “কাফের”, ওরাই আবার আমাকে মালা দেয়। যত দিন দুটিতে মিলে সমঝোতার পথে মিলিত না হব তত দিন দুর্ভাগাই রয়ে যাব।’
প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ বললেন, ‘তাহলে আমরা ঈমান আকিদা নিয়ে আলাদা হয়ে যাব। আলাদা ছিলাম, আছি, থাকব। অসুবিধা কী?’
নজরুল বললেন, ‘আগে খোঁজ নিন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করে কারা। মন্বন্তরের জন্য কারা দায়ী, খোঁজ নিন। মহাযুদ্ধের জন্য দায়ী কারা, খোঁজ নিন। সবার বিরুদ্ধে সম্মিলিত কার্যক্রম না হলে শুধু ভাগই হতে থাকব, মিল হবে না।’
এস ওয়াজেদ আলী বললেন, ‘তাহলে কাজীদা, তোমার ওই “স্বরাজ পার্টি”, যার নেতা দেশবন্ধু, হেমন্তকুমার সরকার, যার সমর্থক নেতাজি, তারা কী চায়?’
নজরুলের চোখ এবার নেচে উঠল। বললেন, ‘সমাজ থেকে ওই সব মানুষের নির্বাসন, যারা হিন্দুকে হিংসা করে, মুসলমানদের মুসলমান থাকতে দেয় না, যারা সর্বহারাদের সমর্থন করে না।’
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। নজরুলের দিকে কয়েকটি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কাজীদা, এবার পান খাও। গতকাল এই গানটি বেরিয়েছে, শুনেছ?
“ও ভাই হিন্দু-মুসলমান
হিংসায় গড়া তলোয়ারখানি ভেঙে কর খান খান”।’
নজরুল বললেন, ‘শুনেছি। আব্বাস আর মৃণাল কান্তির গাওয়া। হিংসা যাবে না, মঈনুদ্দিন, যতক্ষণ হিংসাকে পুষে রাখো। মানুষ দুই শ্রেণীতে: পনেরো আনা শান্ত, এক আনা অশান্ত। বাতাসও তাই, পনেরো আনা শান্ত অক্সিজেন, এক আনা অশান্ত নাইট্রোজেন। সমাজ থেকে ওই বিষাক্ত বায়ু যতক্ষণ বের করে দিতে না পারছ, ততক্ষণ আগুন জ্বলার আশঙ্কা থেকেই যাবে।’
‘ভাগাভাগি করে তাহলে কী পাব?’
‘আরও ভাগাভাগি।’
‘তাহলে?’
‘মনটাকে নরম করো। ক্ষমা চাও। ফুল দাও, ভালোবাসা পাবে।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments