স্মরণ-কেন অসময়ে বিদায় নিলেন? by বেলাল চৌধুরী
ছাত্র হিসেবে ছিলেন যেমন মেধাবী, বক্তা হিসেবে তেমনই তুখোড়; ছিপছিপে সুদর্শন, প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে যে গুণগুলো থাকলে অন্তত তখনকার দিনে, অর্থাৎ বিগত শতাব্দের মাঝামাঝি সময়ে বেশির ভাগ ছাত্রই হয় রাজনীতি, না হয় বিদ্বজ্জনোচিত প্রণোদনার দিকে ঝুঁকতেন। বরিশালের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান আবু
জাফর ওবায়দুল্লাহ খান বরং সেদিকে না গিয়ে হয়তো রবীন্দ্রনাথেরশ্যামলীর অনিবার্য দুটি পঙিক্তর ঘোরে ‘কাটি আজ সবুজ ভাষার ছড়া কাটে ঘাসে ঘাসে/ আকাশের বাদল জবাবে’র প্রভাবে লিখলেন বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত প্রথম একুশের সংকলন-এর জন্য কালজয়ী অমোঘ সেই ছড়ার ছন্দে বললে ছড়ার ছন্দে আর কবিতা বললে কবিতার অশ্রুসজল পঙিক্ত যার শিরোনাম ছিল ‘মাগো, ওরা বলে’:
‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/ নুয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাঁটায়/ ভরে গেছে গাছটা,/ আর আমি/ ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।/ খোকা, তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি!’ চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।...খোকা এলি? ঝাপসা চোখে মা তাকায়/ উঠানে উঠানে/ যেখানে খোকার শব/ শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে/ এখন/ মা’র চোখে চৈত্রের রোদ/ পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের/ তারপর/ দাওয়ায় ব’সে/ মা আবার ধান ভানে,/ উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,/ খোকা তার/ কখন আসে কখন ছুটি।/ এখন/ মা’র চোখে শিশির ভোর/ স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।’
‘মানুষের ভাষা যে আলোর মতো। এই ভাষা যতদূর ছড়ায়, ততদূর মানুষের হূদয় আপনি আপনাকে প্রকাশ করিয়া চলে।’ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের যেন গত্যন্তর নেই। পথের সঞ্চয়-এ তিনি আবারও আমাদের ভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন। তাঁর জন্মের সার্ধশতবৎসর পরে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মহান ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পার হয়ে উপরোল্লিখিত কথাগুলো কি আজও প্রাসঙ্গিক নয়?
গেল ৮ আর ৯ মার্চব্যাপী বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচরে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর স্মরণমেলাটি বসেছিল তারই নামাঙ্কিত ‘কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রাঙ্গণে। বিপুল জনসমাগমের মধ্যে ছিল দেশগৌরব মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কৃত করা, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কবিতা আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক সংগীত, পল্লিগীতি, জারি-সারি গানের সঙ্গে নৃত্য প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা আর দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি রীতিমতো উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল যে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গোটা অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার ছিল এটিএন বাংলা; এ অঞ্চলেরই কৃতী সন্তান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নওয়াজিশ আলী খানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে।
বেশ তো চলছিল আমাদের! নিরবচ্ছিন্ন পানাহার, হাসি, গান, রঙ্গ-তামাশা, আড্ডার মাঝখানে কাব্যচর্চা আর বিতর্কের ঝড়। এসব তখনো ছিল, যখন তিনি দেশে থাকতেন।
শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইনসহ আরও কতশত বন্ধু অনুরক্তজন তাঁর! বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো, আরে! কবিদের আবার বয়স হয় নাকি? সব বয়সের মানুষের সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সাঁকো ছিল একশলা সিগারেট। প্যাকেটটা সব সময় বাড়িয়েই রাখতেন।
মাঝে মাঝে নিজের ওপর এমন রাগ হয় যে এমন একজন কৃতকর্মা ও ক্ষণজন্মা পুরুষকে সহজ-সরলভাবে বুঝতে ভুল করি। আসলে আমরা কূপমণ্ডূক সমাজের ভেতর ঘ্যাঙর ঘ্যাং প্যাঁচপয়জার এতই যে আমরা আমাদের শঠতা দিয়ে, আমাদের রাজ্যের ক্ষুদ্রতা দিয়ে আমাদের নিজেদেরকেই আমরা ছোট থেকে ছোটতর করে ফেলতে দ্বিধান্বিত হই না। না হলে কি আর এই অত বড় মাপের কবি কি কখনো লিখতে পারেন, ‘আমার প্রবাল দ্বীপে/ বাতি নিভে যায়/ এবং প্রস্তরখণ্ড কুসুমিত/ অথবা পোশাকি তিমিরের মতো/ প্রত্যুষে ঝরে পড়ে/ আমার চোখের তারা ভিজে যায় শুধু ভিজে যায়।’ পঙিক্তগুলো পড়তে গিয়ে নিজের ভেতরে নিজেরই অজান্তে এমন একটা জ্বলুনিপুড়নি শুরু হয়ে যায় যে, নিজেকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কেন, কেন সেন্টু ভাই, কেন এমন অসময়ে বিরতিহীন উৎসব থেকে অমনভাবে বিদায় নিয়ে যেতে হলো?
আমাদের ভাষার নায়ক আপনার কলমের কালি তো প্রবহমানই ছিল। শুধু কালির রংটাই যা পাল্টে যাচ্ছিল। এক হিসেবে ভেবে দেখলে মনে হয়, ঠিকই করেছেন। কাদের নিয়ে থাকতেন আপনি?
মানুষ কি আর মানুষ আছে? যত নীচতা, যত ক্ষুদ্রতা সবই যেন আজ সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে উঠতে চাইছে। এক বছরের অধিককাল আপনার সদাজাগ্রত চক্ষুজোড়া হয়তো সে কারণেই বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠত। সেসব মূঢ়মতি শিয়ালদের নিশ্চয় আপনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বলবেন, কী, কেমন আছো, কবিতা লেখা হচ্ছে তো! নতুন কী লিখলে?
বেলাল চৌধুরী
‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/ নুয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাঁটায়/ ভরে গেছে গাছটা,/ আর আমি/ ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।/ খোকা, তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি!’ চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।...খোকা এলি? ঝাপসা চোখে মা তাকায়/ উঠানে উঠানে/ যেখানে খোকার শব/ শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে/ এখন/ মা’র চোখে চৈত্রের রোদ/ পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের/ তারপর/ দাওয়ায় ব’সে/ মা আবার ধান ভানে,/ উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,/ খোকা তার/ কখন আসে কখন ছুটি।/ এখন/ মা’র চোখে শিশির ভোর/ স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।’
‘মানুষের ভাষা যে আলোর মতো। এই ভাষা যতদূর ছড়ায়, ততদূর মানুষের হূদয় আপনি আপনাকে প্রকাশ করিয়া চলে।’ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের যেন গত্যন্তর নেই। পথের সঞ্চয়-এ তিনি আবারও আমাদের ভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন। তাঁর জন্মের সার্ধশতবৎসর পরে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মহান ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পার হয়ে উপরোল্লিখিত কথাগুলো কি আজও প্রাসঙ্গিক নয়?
গেল ৮ আর ৯ মার্চব্যাপী বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচরে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর স্মরণমেলাটি বসেছিল তারই নামাঙ্কিত ‘কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রাঙ্গণে। বিপুল জনসমাগমের মধ্যে ছিল দেশগৌরব মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কৃত করা, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কবিতা আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক সংগীত, পল্লিগীতি, জারি-সারি গানের সঙ্গে নৃত্য প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা আর দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি রীতিমতো উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল যে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গোটা অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার ছিল এটিএন বাংলা; এ অঞ্চলেরই কৃতী সন্তান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নওয়াজিশ আলী খানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে।
বেশ তো চলছিল আমাদের! নিরবচ্ছিন্ন পানাহার, হাসি, গান, রঙ্গ-তামাশা, আড্ডার মাঝখানে কাব্যচর্চা আর বিতর্কের ঝড়। এসব তখনো ছিল, যখন তিনি দেশে থাকতেন।
শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইনসহ আরও কতশত বন্ধু অনুরক্তজন তাঁর! বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো, আরে! কবিদের আবার বয়স হয় নাকি? সব বয়সের মানুষের সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সাঁকো ছিল একশলা সিগারেট। প্যাকেটটা সব সময় বাড়িয়েই রাখতেন।
মাঝে মাঝে নিজের ওপর এমন রাগ হয় যে এমন একজন কৃতকর্মা ও ক্ষণজন্মা পুরুষকে সহজ-সরলভাবে বুঝতে ভুল করি। আসলে আমরা কূপমণ্ডূক সমাজের ভেতর ঘ্যাঙর ঘ্যাং প্যাঁচপয়জার এতই যে আমরা আমাদের শঠতা দিয়ে, আমাদের রাজ্যের ক্ষুদ্রতা দিয়ে আমাদের নিজেদেরকেই আমরা ছোট থেকে ছোটতর করে ফেলতে দ্বিধান্বিত হই না। না হলে কি আর এই অত বড় মাপের কবি কি কখনো লিখতে পারেন, ‘আমার প্রবাল দ্বীপে/ বাতি নিভে যায়/ এবং প্রস্তরখণ্ড কুসুমিত/ অথবা পোশাকি তিমিরের মতো/ প্রত্যুষে ঝরে পড়ে/ আমার চোখের তারা ভিজে যায় শুধু ভিজে যায়।’ পঙিক্তগুলো পড়তে গিয়ে নিজের ভেতরে নিজেরই অজান্তে এমন একটা জ্বলুনিপুড়নি শুরু হয়ে যায় যে, নিজেকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কেন, কেন সেন্টু ভাই, কেন এমন অসময়ে বিরতিহীন উৎসব থেকে অমনভাবে বিদায় নিয়ে যেতে হলো?
আমাদের ভাষার নায়ক আপনার কলমের কালি তো প্রবহমানই ছিল। শুধু কালির রংটাই যা পাল্টে যাচ্ছিল। এক হিসেবে ভেবে দেখলে মনে হয়, ঠিকই করেছেন। কাদের নিয়ে থাকতেন আপনি?
মানুষ কি আর মানুষ আছে? যত নীচতা, যত ক্ষুদ্রতা সবই যেন আজ সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে উঠতে চাইছে। এক বছরের অধিককাল আপনার সদাজাগ্রত চক্ষুজোড়া হয়তো সে কারণেই বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠত। সেসব মূঢ়মতি শিয়ালদের নিশ্চয় আপনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বলবেন, কী, কেমন আছো, কবিতা লেখা হচ্ছে তো! নতুন কী লিখলে?
বেলাল চৌধুরী
No comments