বিশেষ সাক্ষাৎকার-আদিবাসী নেই বলায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে by রাজা দেবাশীষ রায়
রাজা দেবাশীষ রায় জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল, চট্টগ্রামে। লন্ডনের ইনস অব কোর্ট স্কুল অব ল থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রিধারী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সম্প্রদায়ের প্রথাগত রাজা (রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার চাকমা সার্কেলের প্রধান) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
তিনি জাতিসংঘের আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২০১১-১৩ মেয়াদের জন্য এশিয়া অঞ্চলের আদিবাসী প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার, আদিবাসী অধিকার, পরিবেশ ও উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উপরিউক্ত বিষয়ে তাঁর লেখা বহু বই ও প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহসান হাবীব
প্রথম আলো সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে সরকারি প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। এই বক্তব্য কতটা যুক্তিসংগত? সেখানে আপনিও উপস্থিত ছিলেন। সেই বক্তব্যের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় এই বক্তব্য মোটেই যুক্তিসংগত নয়। এটা উটপাখির মতো বালুতে মাথা পুঁতে আদিবাসী না দেখতে পাওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। রাষ্ট্রীয় আইনে আদিবাসী বা ইনডিজিনাস ছাড়া অন্য নামে আদিবাসীদের অভিহিত করা হলেও (যেমন—‘উপজাতি’ বা ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দৃষ্টিতে তারা আদিবাসী হিসেবেই বিবেচিত হবে। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি ফোরামের আলোচনার সময়ও এ কথা বলেছি। আমি ট্রাইবালকে বাংলায় ‘উপজাতি’ বলছি না। কারণ, এ শব্দটিতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্নিহিত আছে এবং এ কারণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ এই শব্দ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী ও ট্রাইবাল—এই দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য দেখাতে চাচ্ছে এবং বলতে চাচ্ছে যে আদিবাসী ধারণাটি অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় প্রযোজ্য, বাংলাদেশে নয়। ১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ নম্বর কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করার সময় বাংলাদেশ সরকার এই মর্মে ঘোষণা দেয়নি যে দেশে ট্রাইবাল আছে, তবে আদিবাসী নেই।
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা দেয় (১৯৯৩) এবং তারপর আদিবাসীদের জন্য দুটি দশকের ঘোষণা দেয়। এতে আদিবাসী বা ইনডিজিনাসের কথা বলেছে এবং ইনডিজিনাস ও ট্রাইবালদের জন্য আলাদাভাবে বছর বা দশক ঘোষণা করেনি অথবা ‘ইনডিজিনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল’ বর্ষ বা দশকও বলেনি। কেবল ইনডিজিনাসের কথাই বলেছে। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত চুক্তি, নীতিমালা, বৈঠক ও কার্যক্রমেও সেই একই ধারা রয়েছে। জাতিসংঘ সর্বশেষ ২০০৭ সালে আদিবাসী-বিষয়ক সনদ (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইনডিজিনাস পিপলস) গ্রহণ করে এই ধারাবাহিকতাকে পাকাপোক্ত করে। দলিলে ব্যবহূত শব্দটি ‘ইনডিজিনাস’। ‘ট্রাইবাল’ শব্দ এতে নেই।
জাতিসংঘের আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির এই অবস্থানকে ফোরামের সদস্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ককাস, বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এনজিও ও বাংলাদেশ থেকে আগত আদিবাসী অংশগ্রহণকারীরা তীব্র ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করে। আমি মনে করি, এতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশের আদিবাসীদের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের কারণে আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন বেড়ে যায়।
প্রথম আলো পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ও সমতলের স্বল্পসংখ্যক জনসংখ্যার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে অভিহিত করার ক্ষেত্রে সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের এই অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
রাজা দেবাশীষ রায় আদিবাসী শব্দের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের কারণ এখনো সুস্পষ্টভাবে আমরা কোথাও পাইনি। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু দলিল, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও সরকারি প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, আপত্তির যুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে: দেশের সার্বভৌমত্ব ও ‘অখণ্ডতার’ প্রতি হুমকি; আদিবাসী-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কারণে পার্বত্য অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো ও পার্বত্য চট্টগ্রামের (এবং সীমিত পরিসরে সমতল অঞ্চলের) অবাঙালি জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের বাইরে থেকে অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত হওয়ায় আদিবাসী মর্যাদার যোগ্য নয়। ওই তিনটি যুক্তি ভিত্তিহীন। আদিবাসী পরিচয় ও অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলে আদিবাসীরা দেশের সুশাসন ও মূলধারার উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে এবং বিচ্ছিন্ন থাকবে না। এতে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান না হলেও হ্রাস পাবে। তাতে পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বাড়বে, কমবে না। এতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সুদৃঢ় হবে, হুমকির মধ্যে পড়বে না।
সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া না-দেওয়া ও আদিবাসী হিসেবে অথবা অন্য কোনো নামে সংবিধানের বিধান থাকা না-থাকার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইনের বিধানাবলির বাস্তবায়নের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাতিসংঘের একাধিক ঘোষণাপত্র ছাড়াও বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত বা অনুমোদিত একাধিক মানবাধিকার ও পরিবেশসংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির বিধান বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরা যে সবাই দেশের বাইরে থেকে অভিবাসিত, এটা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। আর বাইরে থেকে এসে থাকলেও তারা ক. রাজ্য বিজয় বা রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণের সময় দেশের বা ‘দেশটি যে ভৌগোলিক ভূখণ্ডে অবস্থিত’, সেই ভূখণ্ডে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত হওয়া এবং খ. তাদের আইনি মর্যাদানির্বিশেষে দেশের সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অধিক মাত্রায় তাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করার কারণে তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞায় পড়ে যায়। [অনুচ্ছেদ ১(১)(খ) আইএলও কনভেনশন ১০৭; বাংলাদেশ দ্বারা অনুমোদিত]
প্রথম আলো পরিচিতি নির্মাণের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্সগুলোর (যেমন—ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি) সমস্যা কী? ‘আদিবাসী’ পরিচয় কেন সঠিক ও যথাযথ বলে মনে করেন?
রাজা দেবাশীষ রায় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ও ‘উপজাতি’ শব্দগুলো বৈষম্যমূলক, অসম্মানজনক ও অন্যান্যভাবে বেঠিক হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ‘ক্ষুদ্রতার’ দিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। সংখ্যা, বিত্ত ও ক্ষমতায় দুর্বল বলে তাদের ‘ক্ষুদ্র’ বলে অসম্মান করা হচ্ছে। ‘ক্ষুদ্র’ না বলে ‘স্বল্প জনসংখ্যা’ বললে ভুল হতো না।
‘উপজাতি’ শব্দটি আভিধানিক অর্থেও ত্রুটিপূর্ণ। কোনো বড় জাতি থেকে একটি গোষ্ঠী উদ্ভূত হলে যথাযথভাবে ‘উপ’জাতি বলা যেত। নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা বাঙালির উপজাতি হতে পারে, কিন্তু গারো, চাকমা, সান্তাল প্রভৃতি কার ‘উপ’? হিন্দি ও নেপালি ভাষায় ইংরেজি ‘ট্রাইব’কে ‘জনজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলায় কেন উপজাতি বলা হয়, আমি জানি না। আঠারো শতকে ও এর আগে বাংলা ভাষায় এ শব্দের প্রচলন ছিল না। এই শব্দটি ‘ক্ষুদ্র’ নৃগোষ্ঠীর চেয়েও অধিক অগ্রহণযোগ্য। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার আগে ব্যবহূত ‘উপজাতি’ শব্দকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ও ‘আদিবাসী’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। ২০১১ সালে এসে পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ নেওয়াটা বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক হবে।
প্রথম আলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিচয় নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশীদারি কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে?
রাজা দেবাশীষ রায় সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী পরিচয় মেনে নিলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা প্রতিফলিত হবে এবং এর মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের পরিচয়ের বেলায় মুসলমান বনাম বাঙালির কৃত্রিম দ্বন্দ্ব অবসানের ভিত্তি স্থাপিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্রথম আলো সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি বাঙালির বাইরে অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে যে সুপারিশ করেছে, তাতে এসব মানুষের আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় সংবিধানে সংবিধান সংস্কার কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন ২৩(ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের অবাঙালি নাগরিকদের পরিচয়ের স্বীকৃতির সুযোগ হয়েছে। প্রস্তাবিত বিধানে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর পছন্দমতো না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য শব্দ সংযোজন ও অগ্রহণযোগ্য শব্দ পরিহার করা দরকার। এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
প্রথম আলো সংবিধান সংশোধন বিষয়ে আপনি কিংবা আপনাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারপক্ষের আলোচনা হয়েছে কি? হয়ে থাকলে তার কতটুকু আমলে নেওয়া হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় আমি এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ করেছি এবং কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। এ ছাড়া দেশের বিশিষ্ট আদিবাসী নেতারা এবং বর্তমান সংসদের পাঁচজন আদিবাসী সংসদ সদস্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাংবিধানিক সংস্কারসংক্রান্ত কিছু দাবিনামায় স্বাক্ষর করেছি। এই দাবিনামা সংবিধান সংস্কার কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়েছে। দাবিনামায় সংস্কারের স্বরূপ (কোন অনুচ্ছেদ সংস্কার প্রয়োজন ও কীভাবে), দাবির যৌক্তিকতা ও বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক বিধানাবলি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিধানের উল্লেখ রয়েছে। এসব মিলিয়ে দাবিনামার প্যাকেজ, সংযোজনী ইত্যাদি তৈরির জন্য আদিবাসী সংসদ সদস্য ও অন্য আদিবাসী নেতাদের উপস্থিতিতে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে আমাকে সভাপতি করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমি বিগত মাসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে লিখিত ও মৌখিকভাবে কিছু দাবি পেশ করেছি, আগের সমষ্টিগতভাবে পেশকৃত দাবিনামার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
নতুন প্রস্তাবিত ২৩(ক) অনুচ্ছেদে আমাদের দাবিতে উল্লিখিত কিছু বিষয় এসে গেছে, যেমন আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, মুসলমান ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চার অধিকারের স্বীকৃতি (ইসলাম ধর্মের কথা তো উল্লেখ রয়েছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে)। কিন্তু যেসব শব্দের মাধ্যমে আদিবাসীদের আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা আদিবাসীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে ‘উপজাতি’ এবং ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় এতে স্থান পায়নি যথা—স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন; জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন; সম-অধিকার ও বৈষম্যহীনতা-সংক্রান্ত রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান নেওয়ার বেলায় ‘সমাজের অনগ্রসর অংশ’-এর সঙ্গে ‘আদিবাসী’ যোগ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার পুনর্বহাল; পার্বত্য চট্টগ্রামসংক্রান্ত বিশেষ আইনগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করে এরূপ সাংবিধানিক বিধানাবলি যাতে তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে সংশোধন বা বাতিল না হয়, তার জন্য বিধান সংযোজন করা।
প্রথম আলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রশ্নে গুরুতর আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। এই আশঙ্কার কতটুকু ভিত্তি আছে?
রাজা দেবাশীষ রায় রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার আশঙ্কা ভিত্তিহীন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ও এলাকার মানুষের পরিচয়, স্বকীয়তা ও অধিকার সংবিধানে সংরক্ষিত হলে পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি আসবে না, বরং সুদৃঢ় হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানকালের সংঘাত আন্তপাহাড়ি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইনসার্জেন্সি ১৯৯৭ সালে অবসান হয়েছে।
প্রথম আলো পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য ‘শান্তি’ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর ১৩ বছরেরও অধিককাল অতিক্রান্ত হয়েছে। বাস্তবায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী কী?
রাজা দেবাশীষ রায় চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে: চুক্তির বিষয়াবলির ‘রাক্ষুসীকরণ’ অর্থাৎ অপব্যাখ্যা; নীতিনির্ধারণ মহলে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি; জাতীয় নেতা ও কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণার অভাব; পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে অহেতুক ‘কাউন্টার-ইনসার্জেন্সি’ ও নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখা; এবং উচ্চপর্যায়ে ফলোআপের অভাব।
প্রথম আলো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের করণীয় কী বলে মনে করেন? কীভাবে বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে?
রাজা দেবাশীষ রায় রাষ্ট্রযন্ত্র ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আদিবাসীদের আরও সমন্বিতভাবে, কৌশলগতভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। আদিবাসী-বাঙালি মৈত্রী আরও জোরদার করতে হবে। মিডিয়া ও ইন্টারনেটের অধিক ব্যবহার করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং আদিবাসী অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে যে আদিবাসী অধিকার সুস্বীকৃত হলে বাঙালির অধিকার কোনোভাবে বিঘ্নিত হবে না। দেশের সম্পদের ভান্ডার সীমিত হতে পারে কিন্তু অধিকার স্বীকৃতিতে কৃপণতার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আদিবাসী অধিকার নাগরিকের সম-অধিকারের অংশ। আদিবাসী অধিকার ‘বিশেষ অধিকার’ নয়। তবে ঐতিহাসিক কারণে রাষ্ট্র গঠন, আইন প্রণয়ন, সম্পদ বণ্টন ও শাসনকার্যে আদিবাসীদের বহির্ভূত রাখার কারণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত আদিবাসীরা নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার বৈষম্যহীনভাবে ও সমভাবে চর্চা করতে সক্ষম হবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
রাজা দেবাশীষ রায় ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহসান হাবীব
প্রথম আলো সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে সরকারি প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। এই বক্তব্য কতটা যুক্তিসংগত? সেখানে আপনিও উপস্থিত ছিলেন। সেই বক্তব্যের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় এই বক্তব্য মোটেই যুক্তিসংগত নয়। এটা উটপাখির মতো বালুতে মাথা পুঁতে আদিবাসী না দেখতে পাওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। রাষ্ট্রীয় আইনে আদিবাসী বা ইনডিজিনাস ছাড়া অন্য নামে আদিবাসীদের অভিহিত করা হলেও (যেমন—‘উপজাতি’ বা ‘সংখ্যালঘু’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দৃষ্টিতে তারা আদিবাসী হিসেবেই বিবেচিত হবে। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি ফোরামের আলোচনার সময়ও এ কথা বলেছি। আমি ট্রাইবালকে বাংলায় ‘উপজাতি’ বলছি না। কারণ, এ শব্দটিতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্নিহিত আছে এবং এ কারণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ এই শব্দ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী ও ট্রাইবাল—এই দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য দেখাতে চাচ্ছে এবং বলতে চাচ্ছে যে আদিবাসী ধারণাটি অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় প্রযোজ্য, বাংলাদেশে নয়। ১৯৭২ সালে আইএলও ১০৭ নম্বর কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করার সময় বাংলাদেশ সরকার এই মর্মে ঘোষণা দেয়নি যে দেশে ট্রাইবাল আছে, তবে আদিবাসী নেই।
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা দেয় (১৯৯৩) এবং তারপর আদিবাসীদের জন্য দুটি দশকের ঘোষণা দেয়। এতে আদিবাসী বা ইনডিজিনাসের কথা বলেছে এবং ইনডিজিনাস ও ট্রাইবালদের জন্য আলাদাভাবে বছর বা দশক ঘোষণা করেনি অথবা ‘ইনডিজিনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল’ বর্ষ বা দশকও বলেনি। কেবল ইনডিজিনাসের কথাই বলেছে। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত চুক্তি, নীতিমালা, বৈঠক ও কার্যক্রমেও সেই একই ধারা রয়েছে। জাতিসংঘ সর্বশেষ ২০০৭ সালে আদিবাসী-বিষয়ক সনদ (ইউএন ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইনডিজিনাস পিপলস) গ্রহণ করে এই ধারাবাহিকতাকে পাকাপোক্ত করে। দলিলে ব্যবহূত শব্দটি ‘ইনডিজিনাস’। ‘ট্রাইবাল’ শব্দ এতে নেই।
জাতিসংঘের আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির এই অবস্থানকে ফোরামের সদস্য, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ককাস, বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এনজিও ও বাংলাদেশ থেকে আগত আদিবাসী অংশগ্রহণকারীরা তীব্র ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করে। আমি মনে করি, এতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশের আদিবাসীদের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের কারণে আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন বেড়ে যায়।
প্রথম আলো পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ও সমতলের স্বল্পসংখ্যক জনসংখ্যার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে অভিহিত করার ক্ষেত্রে সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের এই অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
রাজা দেবাশীষ রায় আদিবাসী শব্দের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের কারণ এখনো সুস্পষ্টভাবে আমরা কোথাও পাইনি। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু দলিল, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও সরকারি প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, আপত্তির যুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে: দেশের সার্বভৌমত্ব ও ‘অখণ্ডতার’ প্রতি হুমকি; আদিবাসী-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কারণে পার্বত্য অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো ও পার্বত্য চট্টগ্রামের (এবং সীমিত পরিসরে সমতল অঞ্চলের) অবাঙালি জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের বাইরে থেকে অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত হওয়ায় আদিবাসী মর্যাদার যোগ্য নয়। ওই তিনটি যুক্তি ভিত্তিহীন। আদিবাসী পরিচয় ও অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলে আদিবাসীরা দেশের সুশাসন ও মূলধারার উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে এবং বিচ্ছিন্ন থাকবে না। এতে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান না হলেও হ্রাস পাবে। তাতে পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বাড়বে, কমবে না। এতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সুদৃঢ় হবে, হুমকির মধ্যে পড়বে না।
সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া না-দেওয়া ও আদিবাসী হিসেবে অথবা অন্য কোনো নামে সংবিধানের বিধান থাকা না-থাকার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইনের বিধানাবলির বাস্তবায়নের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাতিসংঘের একাধিক ঘোষণাপত্র ছাড়াও বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত বা অনুমোদিত একাধিক মানবাধিকার ও পরিবেশসংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির বিধান বাস্তবায়ন করতে সরকার বাধ্য।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরা যে সবাই দেশের বাইরে থেকে অভিবাসিত, এটা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। আর বাইরে থেকে এসে থাকলেও তারা ক. রাজ্য বিজয় বা রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণের সময় দেশের বা ‘দেশটি যে ভৌগোলিক ভূখণ্ডে অবস্থিত’, সেই ভূখণ্ডে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত হওয়া এবং খ. তাদের আইনি মর্যাদানির্বিশেষে দেশের সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অধিক মাত্রায় তাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন যাপন করার কারণে তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞায় পড়ে যায়। [অনুচ্ছেদ ১(১)(খ) আইএলও কনভেনশন ১০৭; বাংলাদেশ দ্বারা অনুমোদিত]
প্রথম আলো পরিচিতি নির্মাণের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্সগুলোর (যেমন—ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি) সমস্যা কী? ‘আদিবাসী’ পরিচয় কেন সঠিক ও যথাযথ বলে মনে করেন?
রাজা দেবাশীষ রায় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ও ‘উপজাতি’ শব্দগুলো বৈষম্যমূলক, অসম্মানজনক ও অন্যান্যভাবে বেঠিক হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ‘ক্ষুদ্রতার’ দিকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। সংখ্যা, বিত্ত ও ক্ষমতায় দুর্বল বলে তাদের ‘ক্ষুদ্র’ বলে অসম্মান করা হচ্ছে। ‘ক্ষুদ্র’ না বলে ‘স্বল্প জনসংখ্যা’ বললে ভুল হতো না।
‘উপজাতি’ শব্দটি আভিধানিক অর্থেও ত্রুটিপূর্ণ। কোনো বড় জাতি থেকে একটি গোষ্ঠী উদ্ভূত হলে যথাযথভাবে ‘উপ’জাতি বলা যেত। নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা বাঙালির উপজাতি হতে পারে, কিন্তু গারো, চাকমা, সান্তাল প্রভৃতি কার ‘উপ’? হিন্দি ও নেপালি ভাষায় ইংরেজি ‘ট্রাইব’কে ‘জনজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলায় কেন উপজাতি বলা হয়, আমি জানি না। আঠারো শতকে ও এর আগে বাংলা ভাষায় এ শব্দের প্রচলন ছিল না। এই শব্দটি ‘ক্ষুদ্র’ নৃগোষ্ঠীর চেয়েও অধিক অগ্রহণযোগ্য। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার আগে ব্যবহূত ‘উপজাতি’ শব্দকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ও ‘আদিবাসী’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে। ২০১১ সালে এসে পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ নেওয়াটা বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক হবে।
প্রথম আলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিচয় নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশীদারি কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে?
রাজা দেবাশীষ রায় সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী পরিচয় মেনে নিলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা প্রতিফলিত হবে এবং এর মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের পরিচয়ের বেলায় মুসলমান বনাম বাঙালির কৃত্রিম দ্বন্দ্ব অবসানের ভিত্তি স্থাপিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্রথম আলো সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি বাঙালির বাইরে অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে যে সুপারিশ করেছে, তাতে এসব মানুষের আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় সংবিধানে সংবিধান সংস্কার কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত নতুন ২৩(ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের অবাঙালি নাগরিকদের পরিচয়ের স্বীকৃতির সুযোগ হয়েছে। প্রস্তাবিত বিধানে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর পছন্দমতো না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য শব্দ সংযোজন ও অগ্রহণযোগ্য শব্দ পরিহার করা দরকার। এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
প্রথম আলো সংবিধান সংশোধন বিষয়ে আপনি কিংবা আপনাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারপক্ষের আলোচনা হয়েছে কি? হয়ে থাকলে তার কতটুকু আমলে নেওয়া হয়েছে?
রাজা দেবাশীষ রায় আমি এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আলাপ করেছি এবং কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। এ ছাড়া দেশের বিশিষ্ট আদিবাসী নেতারা এবং বর্তমান সংসদের পাঁচজন আদিবাসী সংসদ সদস্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাংবিধানিক সংস্কারসংক্রান্ত কিছু দাবিনামায় স্বাক্ষর করেছি। এই দাবিনামা সংবিধান সংস্কার কমিটি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়েছে। দাবিনামায় সংস্কারের স্বরূপ (কোন অনুচ্ছেদ সংস্কার প্রয়োজন ও কীভাবে), দাবির যৌক্তিকতা ও বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক বিধানাবলি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিধানের উল্লেখ রয়েছে। এসব মিলিয়ে দাবিনামার প্যাকেজ, সংযোজনী ইত্যাদি তৈরির জন্য আদিবাসী সংসদ সদস্য ও অন্য আদিবাসী নেতাদের উপস্থিতিতে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে আমাকে সভাপতি করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমি বিগত মাসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে লিখিত ও মৌখিকভাবে কিছু দাবি পেশ করেছি, আগের সমষ্টিগতভাবে পেশকৃত দাবিনামার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
নতুন প্রস্তাবিত ২৩(ক) অনুচ্ছেদে আমাদের দাবিতে উল্লিখিত কিছু বিষয় এসে গেছে, যেমন আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, মুসলমান ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চার অধিকারের স্বীকৃতি (ইসলাম ধর্মের কথা তো উল্লেখ রয়েছেই, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে)। কিন্তু যেসব শব্দের মাধ্যমে আদিবাসীদের আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা আদিবাসীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে ‘উপজাতি’ এবং ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় এতে স্থান পায়নি যথা—স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন; জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন; সম-অধিকার ও বৈষম্যহীনতা-সংক্রান্ত রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান নেওয়ার বেলায় ‘সমাজের অনগ্রসর অংশ’-এর সঙ্গে ‘আদিবাসী’ যোগ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার পুনর্বহাল; পার্বত্য চট্টগ্রামসংক্রান্ত বিশেষ আইনগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ করে এরূপ সাংবিধানিক বিধানাবলি যাতে তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে সংশোধন বা বাতিল না হয়, তার জন্য বিধান সংযোজন করা।
প্রথম আলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রশ্নে গুরুতর আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। এই আশঙ্কার কতটুকু ভিত্তি আছে?
রাজা দেবাশীষ রায় রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার আশঙ্কা ভিত্তিহীন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ও এলাকার মানুষের পরিচয়, স্বকীয়তা ও অধিকার সংবিধানে সংরক্ষিত হলে পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি আসবে না, বরং সুদৃঢ় হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানকালের সংঘাত আন্তপাহাড়ি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইনসার্জেন্সি ১৯৯৭ সালে অবসান হয়েছে।
প্রথম আলো পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা জাগিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য ‘শান্তি’ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর ১৩ বছরেরও অধিককাল অতিক্রান্ত হয়েছে। বাস্তবায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা কী কী?
রাজা দেবাশীষ রায় চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে: চুক্তির বিষয়াবলির ‘রাক্ষুসীকরণ’ অর্থাৎ অপব্যাখ্যা; নীতিনির্ধারণ মহলে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি; জাতীয় নেতা ও কর্মকর্তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণার অভাব; পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে অহেতুক ‘কাউন্টার-ইনসার্জেন্সি’ ও নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখা; এবং উচ্চপর্যায়ে ফলোআপের অভাব।
প্রথম আলো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের করণীয় কী বলে মনে করেন? কীভাবে বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে?
রাজা দেবাশীষ রায় রাষ্ট্রযন্ত্র ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আদিবাসীদের আরও সমন্বিতভাবে, কৌশলগতভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। আদিবাসী-বাঙালি মৈত্রী আরও জোরদার করতে হবে। মিডিয়া ও ইন্টারনেটের অধিক ব্যবহার করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং আদিবাসী অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে যে আদিবাসী অধিকার সুস্বীকৃত হলে বাঙালির অধিকার কোনোভাবে বিঘ্নিত হবে না। দেশের সম্পদের ভান্ডার সীমিত হতে পারে কিন্তু অধিকার স্বীকৃতিতে কৃপণতার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আদিবাসী অধিকার নাগরিকের সম-অধিকারের অংশ। আদিবাসী অধিকার ‘বিশেষ অধিকার’ নয়। তবে ঐতিহাসিক কারণে রাষ্ট্র গঠন, আইন প্রণয়ন, সম্পদ বণ্টন ও শাসনকার্যে আদিবাসীদের বহির্ভূত রাখার কারণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত আদিবাসীরা নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার বৈষম্যহীনভাবে ও সমভাবে চর্চা করতে সক্ষম হবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
রাজা দেবাশীষ রায় ধন্যবাদ।
No comments