মত ও মন্তব্য-সমুদ্রসীমার অধিকার অবশ্যই বড়মাপের অর্জন by হারুন হাবীব
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সরকার পরিচালনায় সংকট ও সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়ার মাঝে বিস্তর যৌক্তিকতা আছে। বিভিন্ন অঙ্গনে সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ মেনে নিলেও সাফল্যের কথাগুলো তাতে চাপা পড়ে যায় না। যদিও বলতেই হয়, সাফল্য প্রচারে এ সরকারের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো।
অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা শেখ হাসিনার সরকারের বড়মাপের একটি অর্জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয়ের জন্যই কেবল নয়- এ বিজয় গোটা বাংলাদেশের, গোটা জাতির। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিশেষজ্ঞ মহল থেকে এ বিজয়কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ অভিমতও তারা প্রকাশ করেছেন, ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ আছে, যার সমাধান চেয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে তারও নিষ্পত্তি ঘটবে শান্তিপূর্ণভাবেই। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং তাঁর মন্ত্রণালয়কে আন্তরিক অভিনন্দন এমন একটি মহাবিজয়কে দেশবাসীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। বলাই বাহুল্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রণালয়ের বিশেষ যে সেলটি দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে- তারই ফলশ্রুতি আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের পক্ষের এই ঐতিহাসিক রায়।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের দাবিটি বাস্তবভিত্তিক ছিল। তা না হলে ১৪ মার্চ জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত 'ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সির দেওয়া রায়টি বাংলাদেশের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ হতো না। এতে একদিকে যেমন ন্যায়নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের ন্যায়সংগত স্বার্থও। আর গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের হাতে জাতীয় এ স্বার্থটি রক্ষিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষই উপকৃত হয়েছেন। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, আগামীতে আরো এমনি কোনো অমীমাংসিত ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিকভাবে সমাধানে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক আদালতের আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে এ রায় স্মরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়কে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি। গত ৩৮ বছরে যা হয়নি- মাত্র তিন বছরে একটি সরকার তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে- এটি কম কথা নয়। কাজেই এ অর্জনকে কোনো মানদণ্ডেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আরো উল্লেখ করার মতো বিষয়, এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জলসীমার অধিকার লাভ করেছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সম্পদ বহুগুণ বেড়ে যাবে। স্থলভাগ থেকে ২০০ মাইল সমুদ্রে বাংলাদেশ তার একক অধিকার ভোগ করবে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশকে এখন বিস্মৃত এই জলসীমা ও সম্পদের সুরক্ষা ও তার ব্যবহারে বিশেষ উদ্যোগী নিতে হবে ও সমুদ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং এ সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ রায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে সেটি হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে তেল-গ্যাস আহরণে বাংলাদেশের যে দ্বন্দ্ব বা সংকট চলে আসছিল, আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়ের ফলে সে সমস্যা আর হবে না বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মধ্যে ২৭টিরই মালিকানা দাবি করে আসছিল মিয়ানমার ও ভারত। এ রায়ের ফলে ১৮টি ব্লকের মালিকানা বাংলাদেশের নিশ্চিত হয়েছে। বাকিগুলোর মালিকানা ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে। হামবুর্গ আদালতের এ রায়টি চূড়ান্ত এবং আপিলের অযোগ্য। অর্থাৎ মিয়ানমার ইচ্ছে করলেই এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করতে পারবে না। ভেবে দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়ের ফলে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল, অর্থাৎ এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশ তার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে- যা দেশটির প্রত্যাশার চেয়ে চার হাজার বর্গকিলোমিটার বেশি। বলাই বাহুল্য, সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশের কোনো সরকারের জন্য সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু কঠিন সিদ্ধান্তটি বর্তমান সরকার নিতে পেরেছিল। বিএনপি বা কিছু বিরোধী দল বরাবরই 'নতজানু পররাষ্ট্রনীতির' কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কোনো বিষয়ের সুরাহা হচ্ছে না বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছে। ভারত গঙ্গার পানি দিচ্ছে না বলে জেনারেল জিয়ার আমলে উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে, জাতিসংঘে পর্যন্ত বিষয়টি তোলা হয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি। উপযুক্ত যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশকে ফিরে আসতে হয়েছে। পরে আলোচনার মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টনে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছে।
এবারও উত্তেজনা সৃষ্টির কম তৎপরতা ছিল না কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল থেকে। স্বীকার করতে বাধ্য যে এসব অভিযোগ বা উত্তেজনার মন্ত্রণা কানে না তুলে সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমুদ্রসীমা নিয়ে অক্লান্ত কাজ করে গেছেন। নীতি ও রীতিগতভাবে কাজ করেছেন। যার ফলে দেশের পক্ষে বিরাট এ সাফল্যটি বয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশ উপকৃত হয়েছে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সমস্যাটি নিয়ে বাংলাদেশ মামলা দায়ের করে। বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতি যে নতজানু নয়- আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায় তারই প্রমাণ দিয়েছে। আমরা আশা করব, কোনো সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নয়, আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয়েই অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সম্ভব। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘ ৩৮ বছরের। এ নিয়ে বহুবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কোনো ফলপ্রসূ সমাধান পাওয়া যায়নি। আমাদের স্মরণ আছে, মিয়ানমার এরই মধ্যে একবার তার নৌজাহাজ পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তার দাবির সমর্থনে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো সংঘর্ষে জড়ায়নি। সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশন মেনে বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে গেছে। তিন বছর ধরে দুই দেশ তাদের দাবির পক্ষে নানা তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেছে। পরিশেষে ১৪ মার্চ, ২০১২ ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্যতাভিত্তিক সমুদ্রসীমার দাবিকে সমুন্নত রেখেছে। বঙ্গোপসাগরের জলরাশি এবং তলদেশের সম্পদে নিজের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলায় বাংলাদেশ গত বছরের ৩১ মে তার দাবি ও যুক্তিপত্র জমা দিয়েছে। এ বিষয়ে সব লিখিত ও মৌখিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ওই মামলার রায় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আশা করব, সে রায়েও যুক্তি ও ন্যায্যতা সমুন্নত রাখা হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়েছে- এটিও কম স্বস্তির কথা নয়। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ নিকটতম প্রতিবেশী। আমরা কেউই এ ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারব না। কাজেই বাস্তবতা মেনে আমাদের সমস্যার সমাধান আইনানুগ এবং শান্তিপূর্ণভাবেই হতে হবে। আরো আনন্দের খবর যে, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার রায় প্রকাশের পর মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। মিয়ানমার এ রায় মেনে নিয়েছে এবং ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত বলেছেন- এ রায়ের ফলে তাঁর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না।
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সত্য প্রতিষ্ঠার। সীমানা ও সম্পদে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র হলেও আমরা অন্যের ক্ষতির কারণ হবো না- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। বর্তমান সরকার সে নীতিই গ্রহণ করায় শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবাদী মানুষের ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বলাবাহুল্য, হামবুর্গ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। সীমিত সম্পদ, সীমিত ভূখণ্ড এবং সুবিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ বলে বাংলাদেশে নানা ঘাটতি, নানা সংকট আছে। আশা করা যায়, বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত সীমানার মালিকানা নিশ্চিত হওয়ার পর সে ঘাটতি অনেকটাই কমবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেকটাই স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবে। এর পরও কথা থাকে, সম্পদের মালিকানা পেলেই শুধু চলে না, একই সঙ্গে প্রয়োজন সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। সারা বিশ্বেই প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও আছে জনসংখ্যার চাপ, নানামুখী চাহিদা ও শক্তিধরদের কুদৃষ্টি। কাজেই এই বিপুল সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিকট অতীতে অনেকবারই লক্ষ করা গেছে যে তেল বা গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কম্পানিকে ব্লক ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞ মহলই সরকারি নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমি এ সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞ নই। তবু এ কথা বলতে পারি, জাতীয় সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং জনকল্যাণের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা কারো কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের দাবিটি বাস্তবভিত্তিক ছিল। তা না হলে ১৪ মার্চ জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত 'ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সির দেওয়া রায়টি বাংলাদেশের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ হতো না। এতে একদিকে যেমন ন্যায়নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের ন্যায়সংগত স্বার্থও। আর গণতান্ত্রিক কোনো সরকারের হাতে জাতীয় এ স্বার্থটি রক্ষিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষই উপকৃত হয়েছেন। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, আগামীতে আরো এমনি কোনো অমীমাংসিত ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় বা আঞ্চলিকভাবে সমাধানে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক আদালতের আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে এ রায় স্মরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়কে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি। গত ৩৮ বছরে যা হয়নি- মাত্র তিন বছরে একটি সরকার তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে- এটি কম কথা নয়। কাজেই এ অর্জনকে কোনো মানদণ্ডেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আরো উল্লেখ করার মতো বিষয়, এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জলসীমার অধিকার লাভ করেছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সম্পদ বহুগুণ বেড়ে যাবে। স্থলভাগ থেকে ২০০ মাইল সমুদ্রে বাংলাদেশ তার একক অধিকার ভোগ করবে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশকে এখন বিস্মৃত এই জলসীমা ও সম্পদের সুরক্ষা ও তার ব্যবহারে বিশেষ উদ্যোগী নিতে হবে ও সমুদ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং এ সম্পদের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ রায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে দিয়েছে সেটি হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে তেল-গ্যাস আহরণে বাংলাদেশের যে দ্বন্দ্ব বা সংকট চলে আসছিল, আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়ের ফলে সে সমস্যা আর হবে না বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মধ্যে ২৭টিরই মালিকানা দাবি করে আসছিল মিয়ানমার ও ভারত। এ রায়ের ফলে ১৮টি ব্লকের মালিকানা বাংলাদেশের নিশ্চিত হয়েছে। বাকিগুলোর মালিকানা ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে। হামবুর্গ আদালতের এ রায়টি চূড়ান্ত এবং আপিলের অযোগ্য। অর্থাৎ মিয়ানমার ইচ্ছে করলেই এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করতে পারবে না। ভেবে দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায়ের ফলে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল, অর্থাৎ এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশ তার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে- যা দেশটির প্রত্যাশার চেয়ে চার হাজার বর্গকিলোমিটার বেশি। বলাই বাহুল্য, সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার ব্যাপারটি বাংলাদেশের কোনো সরকারের জন্য সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু কঠিন সিদ্ধান্তটি বর্তমান সরকার নিতে পেরেছিল। বিএনপি বা কিছু বিরোধী দল বরাবরই 'নতজানু পররাষ্ট্রনীতির' কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কোনো বিষয়ের সুরাহা হচ্ছে না বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেছে। ভারত গঙ্গার পানি দিচ্ছে না বলে জেনারেল জিয়ার আমলে উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে, জাতিসংঘে পর্যন্ত বিষয়টি তোলা হয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি। উপযুক্ত যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশকে ফিরে আসতে হয়েছে। পরে আলোচনার মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে গঙ্গার পানি বণ্টনে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছে।
এবারও উত্তেজনা সৃষ্টির কম তৎপরতা ছিল না কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল থেকে। স্বীকার করতে বাধ্য যে এসব অভিযোগ বা উত্তেজনার মন্ত্রণা কানে না তুলে সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমুদ্রসীমা নিয়ে অক্লান্ত কাজ করে গেছেন। নীতি ও রীতিগতভাবে কাজ করেছেন। যার ফলে দেশের পক্ষে বিরাট এ সাফল্যটি বয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশ উপকৃত হয়েছে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সমস্যাটি নিয়ে বাংলাদেশ মামলা দায়ের করে। বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতি যে নতজানু নয়- আন্তর্জাতিক আদালতের এ রায় তারই প্রমাণ দিয়েছে। আমরা আশা করব, কোনো সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নয়, আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয়েই অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সম্ভব। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘ ৩৮ বছরের। এ নিয়ে বহুবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কোনো ফলপ্রসূ সমাধান পাওয়া যায়নি। আমাদের স্মরণ আছে, মিয়ানমার এরই মধ্যে একবার তার নৌজাহাজ পাঠিয়েছিল বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তার দাবির সমর্থনে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো সংঘর্ষে জড়ায়নি। সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশন মেনে বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে গেছে। তিন বছর ধরে দুই দেশ তাদের দাবির পক্ষে নানা তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেছে। পরিশেষে ১৪ মার্চ, ২০১২ ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্যতাভিত্তিক সমুদ্রসীমার দাবিকে সমুন্নত রেখেছে। বঙ্গোপসাগরের জলরাশি এবং তলদেশের সম্পদে নিজের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলায় বাংলাদেশ গত বছরের ৩১ মে তার দাবি ও যুক্তিপত্র জমা দিয়েছে। এ বিষয়ে সব লিখিত ও মৌখিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি ওই মামলার রায় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আশা করব, সে রায়েও যুক্তি ও ন্যায্যতা সমুন্নত রাখা হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়েছে- এটিও কম স্বস্তির কথা নয়। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ নিকটতম প্রতিবেশী। আমরা কেউই এ ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারব না। কাজেই বাস্তবতা মেনে আমাদের সমস্যার সমাধান আইনানুগ এবং শান্তিপূর্ণভাবেই হতে হবে। আরো আনন্দের খবর যে, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার রায় প্রকাশের পর মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। মিয়ানমার এ রায় মেনে নিয়েছে এবং ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত বলেছেন- এ রায়ের ফলে তাঁর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না।
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সত্য প্রতিষ্ঠার। সীমানা ও সম্পদে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র হলেও আমরা অন্যের ক্ষতির কারণ হবো না- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। বর্তমান সরকার সে নীতিই গ্রহণ করায় শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবাদী মানুষের ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বলাবাহুল্য, হামবুর্গ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। সীমিত সম্পদ, সীমিত ভূখণ্ড এবং সুবিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ বলে বাংলাদেশে নানা ঘাটতি, নানা সংকট আছে। আশা করা যায়, বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত সীমানার মালিকানা নিশ্চিত হওয়ার পর সে ঘাটতি অনেকটাই কমবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেকটাই স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবে। এর পরও কথা থাকে, সম্পদের মালিকানা পেলেই শুধু চলে না, একই সঙ্গে প্রয়োজন সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। সারা বিশ্বেই প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়াও আছে জনসংখ্যার চাপ, নানামুখী চাহিদা ও শক্তিধরদের কুদৃষ্টি। কাজেই এই বিপুল সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিকট অতীতে অনেকবারই লক্ষ করা গেছে যে তেল বা গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কম্পানিকে ব্লক ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞ মহলই সরকারি নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমি এ সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞ নই। তবু এ কথা বলতে পারি, জাতীয় সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং জনকল্যাণের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা কারো কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট
No comments