বিশেষ সাক্ষাৎকার : শেখ শহিদুল ইসলাম-প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে
সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হন জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) সেক্রেটারি জেনারেল শেখ শহিদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। জনগণ দুর্ভোগ কমিয়ে আনতে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : প্রতিটি দেশের রাজনীতিতে নিজ নিজ দেশের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে কিছু গুণগত দিক আছে। আমাদের এখানে সাধারণত দেখা যায়, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিরোধী দলের আন্দোলন শুরু হয়। ফলে বিরোধী দল মনে করতে পারে তাদের আন্দোলনের কারণেই সরকারের পতন হয়েছে। এতে মনস্তাত্তি্বক সুবিধা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখুন ১৯৯১ সালের পর থেকে যে কয়টি সরকারই এসেছে, প্রত্যেকেই মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। সেখানে সাত দিন সংসদ অধিবেশন স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকালেও সরকার পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত ছিল।
কালের কণ্ঠ : ঢাকায় পল্টন ময়দান ছাড়া সমাবেশের কোনো স্থান নেই। ফলে রাজপথেই সভা-সমাবেশ করতে হয়। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : আমাদের এখানে সমাবেশ করার মতো জায়গা কিন্তু আছে। ৫০/৬০ বছর ধরে সমাবেশ হচ্ছে এমন জায়গা আমাদের এখানে আছে। পল্টনের মতো আরমানিটোলা, শহীদ মিনার, মুক্তাঙ্গন, চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড, লালদীঘি ময়দান এমন বেশ কিছু জায়গা তো এখনো আছে। এমনকি স্কুল কলেজের মাঠও একসময় সমাবেশের কাজে ব্যবহার হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব জায়গা যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না। আমরা কর্মসূচিগুলো কিভাবে নেব তার ওপর। কখন এবং কিভাবে নেব তার ওপর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও ব্যবহার হতে পারে। বিশেষ প্রয়োজনে যদি পল্টনে ওভারফ্লো হয়ে যায় তা হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। সরকার এই পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে ছেটে ফেলেছে। আপনারা কী ভাবছেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলুন আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বলুন এগুলো প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। এই পদ্ধতির কিছু দুর্বলতা ছিল, আমাদের সংবিধানে সেপারেশন অব পাওয়ার সুস্পষ্ট। সেখানে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইন বিভাগের কথা আছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে গিয়ে সংবিধানের মৌলিক বিষয়ই পরিবর্তন হয়ে যায় না কি? তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত। এর মধ্যে একটি সরকার তো দুই বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিল। এমনটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতি, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমসুবিধা থাকা দরকার। আমি মনে করি রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রমুখের এখনই দ্রুত এই বিষয়ে ভাবনা দরকার।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব?
শেখ শহিদুল ইসলাম : রাজনীতিবিদদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত অন্তর্বর্তীকালের জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। ওই সময় যে সরকার থাকবে সে যাতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতি করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। রাজনীতিকে মাস্তানতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মোটেও গৌরবের বিষয় নয়। আদর্শহীন, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল সংসদে যোগ দিচ্ছে না। তাদের এই কার্যক্রমকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
শেখ শহিদুল ইসলাম : ১৯৯১ সাল থেকে আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর থেকে কোনো সংসদকেই কার্যকর বলে আমার কাছে মনে হয় না। প্রতিটি সংসদেই বিরোধী দলের অনুপস্থিতি ছিল নিয়মিত। উপস্থিত হওয়ার পরও দেখা গেছে, অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই তারা ব্যস্ত থেকেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আধিক্য ছিল সংসদগুলোতে। বিরোধী দল সরকারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে কিভাবে বেকায়দায় ফেলা যায় সেই চর্চাই করে আসছে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার নেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার তো বরাবরই আছে। রাজনীতিবিদদের চিন্তা করা উচিত কোন পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। সরকারের স্বচ্ছতা থাকবে এবং সরকার জনকল্যাণমুখী হবে।
কালের কণ্ঠ : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, লোডশেডিং বেড়েই চলেছে, বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, গ্যাসের ক্ষেত্রেও কোনো সুখবর নেই। শেয়ারবাজার নিয়ে হৈচৈ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিভাবে দেখছেন বিষয়গুলোকে?
শেখ শহিদুল ইসলাম : বৈশ্বিক মন্দা চলছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশেও। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। লিবিয়া ও ইরাক অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে তাদের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বেড়েছে। আমাদের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভয়াবহ সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি ও তেলের মূল্য সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের এখানে বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগ করেনি। তাঁরা মনে করেছেন শেয়ার বেচাকেনার মাধ্যমেই বড় অঙ্ক মুনাফা অর্জন করে নিয়ে যাবেন। ডিভিডেন্টের মাধ্যমে মুনাফার বিষয়টি ভাবছে কি কেউ? আর এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছে কারসাজিকারীরা।
কালের কণ্ঠ : এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনটি ধারায় কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। আর রপ্তানিখাতকে বিভিন্নমুখী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শ্রমবাজারকে সম্প্রসারিত করতে হবে। যাতে রেমিট্যান্স বাড়ে। তৃতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরে শিল্প অবকাঠামো খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এটা সম্ভব হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলেও মানুষ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে যে সংকট চলছে এটা বাজার অর্থনীতির কারণে।
আর শেয়ার বাজার সম্পর্কে বলতে গেলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কথা বলব। খন্দকার ইবরাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা মেনে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হোক।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : তারপরও দেখুন, আমরা কিন্তু ৬.৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এটা বলা হচ্ছে। তাহলে আমরা খুব একটা খারাপ করছি কোথায়? আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, গ্রিস, ইতালি, স্পেনের মতো দেশে অর্থনৈতিক কারণে সরকারের পরিবর্তন ও পতন হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে বেকারত্ব বেড়েছে অনেক। সেখানে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে এমন উদাহরণও আছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। এটা আসলে পুঁজিবাজার অর্থনীতির সংকট।
কালের কণ্ঠ : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে বলুন।
শেখ শহিদুল ইসলাম : বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি করা দরকার। যাতে মানুষ নিরাপত্তা বোধ করতে পারে। অপরাধ কম হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন অপরাধীকে খুঁজে বের করা। তাকে আইনানুগ শাস্তি প্রদান করা। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা হলো, সম্প্রতি সৌদি নাগরিক খুন হলো। তাদের খুনিদের ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। এটা অমার্জনীয়। অপরাধ দমন করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় চিন্তার ঊধর্ে্ব রাখতে হবে। অপরাধী যে পরিচয়েরই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের দুর্নীতির ঊধর্ে্ব থাকা প্রয়োজন। অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে শোনা যায়। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল আরো ট্রাইব্যুনাল করা হবে। কিন্তু এখনো গঠন হয়নি। সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। প্রক্রিয়াটি যাতে স্বচ্ছ থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে আমাদের এখানে যে বিচারব্যবস্থা তাতে তাড়াহুড়া করে কিছু করার অবস্থা নেই। দ্রুত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেই। সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে।
কালের কণ্ঠ : জোটভিত্তিক রাজনীতির প্রাধান্য এখন। আপনারা কি কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : জোটভিত্তিক রাজনীতি হতে পারে আদর্শের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন প্রাক্কালে। নির্বাচন তো অনেক দূরে। সুতরাং এখনই এই ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে মনে করি না। মনে করি, ইট ইজ টু আরলি টু ডিসাইড। নির্বাচন এলে দেখা যাবে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেই অনুযায়ীই বিবেচনা হবে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব হবে বলে কি আপনি মনে করেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : রাজনীতিতে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শক্তি বলতে কিছু নেই। বিভিন্ন দলের কর্মসূচি এবং তাদের আদর্শ থাকে। সেই ভিত্তিতেই তারা এগিয়ে চলে। কেউ যদি শুরুতে তৃতীয় চিন্তা করতে থাকে তাহলে কিভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আমরা মাইনাস টু ফর্মুলার কথা শুনেছিলাম। সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে পারলে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় এসব কিছুই লাগবে না। বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি নয়, প্রথম শক্তির চিন্তাই করা উচিত।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ শহিদুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
শেখ শহিদুল ইসলাম : প্রতিটি দেশের রাজনীতিতে নিজ নিজ দেশের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে কিছু গুণগত দিক আছে। আমাদের এখানে সাধারণত দেখা যায়, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে বিরোধী দলের আন্দোলন শুরু হয়। ফলে বিরোধী দল মনে করতে পারে তাদের আন্দোলনের কারণেই সরকারের পতন হয়েছে। এতে মনস্তাত্তি্বক সুবিধা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখুন ১৯৯১ সালের পর থেকে যে কয়টি সরকারই এসেছে, প্রত্যেকেই মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। সেখানে সাত দিন সংসদ অধিবেশন স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকালেও সরকার পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত ছিল।
কালের কণ্ঠ : ঢাকায় পল্টন ময়দান ছাড়া সমাবেশের কোনো স্থান নেই। ফলে রাজপথেই সভা-সমাবেশ করতে হয়। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : আমাদের এখানে সমাবেশ করার মতো জায়গা কিন্তু আছে। ৫০/৬০ বছর ধরে সমাবেশ হচ্ছে এমন জায়গা আমাদের এখানে আছে। পল্টনের মতো আরমানিটোলা, শহীদ মিনার, মুক্তাঙ্গন, চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড, লালদীঘি ময়দান এমন বেশ কিছু জায়গা তো এখনো আছে। এমনকি স্কুল কলেজের মাঠও একসময় সমাবেশের কাজে ব্যবহার হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব জায়গা যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না। আমরা কর্মসূচিগুলো কিভাবে নেব তার ওপর। কখন এবং কিভাবে নেব তার ওপর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও ব্যবহার হতে পারে। বিশেষ প্রয়োজনে যদি পল্টনে ওভারফ্লো হয়ে যায় তা হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। সরকার এই পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে ছেটে ফেলেছে। আপনারা কী ভাবছেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলুন আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বলুন এগুলো প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। এই পদ্ধতির কিছু দুর্বলতা ছিল, আমাদের সংবিধানে সেপারেশন অব পাওয়ার সুস্পষ্ট। সেখানে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইন বিভাগের কথা আছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে গিয়ে সংবিধানের মৌলিক বিষয়ই পরিবর্তন হয়ে যায় না কি? তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত। এর মধ্যে একটি সরকার তো দুই বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিল। এমনটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতি, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমসুবিধা থাকা দরকার। আমি মনে করি রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রমুখের এখনই দ্রুত এই বিষয়ে ভাবনা দরকার।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব?
শেখ শহিদুল ইসলাম : রাজনীতিবিদদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত অন্তর্বর্তীকালের জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। ওই সময় যে সরকার থাকবে সে যাতে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতি করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। রাজনীতিকে মাস্তানতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মোটেও গৌরবের বিষয় নয়। আদর্শহীন, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল সংসদে যোগ দিচ্ছে না। তাদের এই কার্যক্রমকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
শেখ শহিদুল ইসলাম : ১৯৯১ সাল থেকে আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর থেকে কোনো সংসদকেই কার্যকর বলে আমার কাছে মনে হয় না। প্রতিটি সংসদেই বিরোধী দলের অনুপস্থিতি ছিল নিয়মিত। উপস্থিত হওয়ার পরও দেখা গেছে, অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই তারা ব্যস্ত থেকেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ী ও আমলাদের আধিক্য ছিল সংসদগুলোতে। বিরোধী দল সরকারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে কিভাবে বেকায়দায় ফেলা যায় সেই চর্চাই করে আসছে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার নেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার তো বরাবরই আছে। রাজনীতিবিদদের চিন্তা করা উচিত কোন পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। সরকারের স্বচ্ছতা থাকবে এবং সরকার জনকল্যাণমুখী হবে।
কালের কণ্ঠ : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, লোডশেডিং বেড়েই চলেছে, বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, গ্যাসের ক্ষেত্রেও কোনো সুখবর নেই। শেয়ারবাজার নিয়ে হৈচৈ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিভাবে দেখছেন বিষয়গুলোকে?
শেখ শহিদুল ইসলাম : বৈশ্বিক মন্দা চলছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশেও। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। লিবিয়া ও ইরাক অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে তাদের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বেড়েছে। আমাদের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভয়াবহ সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি ও তেলের মূল্য সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের এখানে বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগ করেনি। তাঁরা মনে করেছেন শেয়ার বেচাকেনার মাধ্যমেই বড় অঙ্ক মুনাফা অর্জন করে নিয়ে যাবেন। ডিভিডেন্টের মাধ্যমে মুনাফার বিষয়টি ভাবছে কি কেউ? আর এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছে কারসাজিকারীরা।
কালের কণ্ঠ : এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : এ থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনটি ধারায় কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। আর রপ্তানিখাতকে বিভিন্নমুখী করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শ্রমবাজারকে সম্প্রসারিত করতে হবে। যাতে রেমিট্যান্স বাড়ে। তৃতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরে শিল্প অবকাঠামো খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এটা সম্ভব হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলেও মানুষ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে যে সংকট চলছে এটা বাজার অর্থনীতির কারণে।
আর শেয়ার বাজার সম্পর্কে বলতে গেলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কথা বলব। খন্দকার ইবরাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা মেনে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা হোক।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : তারপরও দেখুন, আমরা কিন্তু ৬.৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এটা বলা হচ্ছে। তাহলে আমরা খুব একটা খারাপ করছি কোথায়? আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, গ্রিস, ইতালি, স্পেনের মতো দেশে অর্থনৈতিক কারণে সরকারের পরিবর্তন ও পতন হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে বেকারত্ব বেড়েছে অনেক। সেখানে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে এমন উদাহরণও আছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। এটা আসলে পুঁজিবাজার অর্থনীতির সংকট।
কালের কণ্ঠ : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে বলুন।
শেখ শহিদুল ইসলাম : বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি করা দরকার। যাতে মানুষ নিরাপত্তা বোধ করতে পারে। অপরাধ কম হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন অপরাধীকে খুঁজে বের করা। তাকে আইনানুগ শাস্তি প্রদান করা। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা হলো, সম্প্রতি সৌদি নাগরিক খুন হলো। তাদের খুনিদের ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। এটা অমার্জনীয়। অপরাধ দমন করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় চিন্তার ঊধর্ে্ব রাখতে হবে। অপরাধী যে পরিচয়েরই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের দুর্নীতির ঊধর্ে্ব থাকা প্রয়োজন। অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে বলে শোনা যায়। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল আরো ট্রাইব্যুনাল করা হবে। কিন্তু এখনো গঠন হয়নি। সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
শেখ শহিদুল ইসলাম : যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। প্রক্রিয়াটি যাতে স্বচ্ছ থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে আমাদের এখানে যে বিচারব্যবস্থা তাতে তাড়াহুড়া করে কিছু করার অবস্থা নেই। দ্রুত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেই। সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে।
কালের কণ্ঠ : জোটভিত্তিক রাজনীতির প্রাধান্য এখন। আপনারা কি কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : জোটভিত্তিক রাজনীতি হতে পারে আদর্শের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন প্রাক্কালে। নির্বাচন তো অনেক দূরে। সুতরাং এখনই এই ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে মনে করি না। মনে করি, ইট ইজ টু আরলি টু ডিসাইড। নির্বাচন এলে দেখা যাবে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেই অনুযায়ীই বিবেচনা হবে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব হবে বলে কি আপনি মনে করেন?
শেখ শহিদুল ইসলাম : রাজনীতিতে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শক্তি বলতে কিছু নেই। বিভিন্ন দলের কর্মসূচি এবং তাদের আদর্শ থাকে। সেই ভিত্তিতেই তারা এগিয়ে চলে। কেউ যদি শুরুতে তৃতীয় চিন্তা করতে থাকে তাহলে কিভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আমরা মাইনাস টু ফর্মুলার কথা শুনেছিলাম। সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে পারলে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় এসব কিছুই লাগবে না। বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি নয়, প্রথম শক্তির চিন্তাই করা উচিত।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ শহিদুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments