স্বাধীনতা আমার কতখানি স্বাধীনতা by মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটাতে আমার বা আমাদের প্রাপ্তির ফর্দটা তখনি আমাদের হাতের মুঠোতে জ্বলজ্বল করবে, যখন এখানে প্রায় সব নেতা নিজের স্বার্থ সংকীর্ণতার বাইরে আসতে পারবেন। এসব নেতা বেরিয়ে আসবেন রাজনৈতিক কালচার বা রাজনৈতিক সমাজ থেকে।
তবেই সেই রাজনৈতিক মানুষটি দেশের এবং দশের কল্যাণে প্রকৃত কাজে লাগবেন। আমাদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা কেবল ওইসব শঠ, মুনাফালোভী রাজনীতি করা লোকগুলোর কারণে, তাও কেবল একটি সঠিক প্রপঞ্চ নয়! এখানে যোগ হয়েছে দেশের সিভিল সার্ভিসে যুক্ত অসংখ্য স্বল্প মেধাবী এবং অতি লোভী লোকজন। ফলে এ দুয়ের মিশ্রণে এ এক করুণ হাল, যেখানে আমাদের প্রাপ্তিগুলো ফিকে হয়ে অদৃশ্যপ্রায়
স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধ। মুুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে রাইফেলের নলে বেঁধে লাখো তরুণ উড়াল লাল সবুজের পতাকা। সেই পতাকা হাতে বাংলাদেশ আজ একচলি্লশে।
আমি সেই যুদ্ধ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের অনুভবের ভেতর তখন হেঁটেছি। আমরা একটা কিছু পেতে যাচ্ছি। আমরা একটা গৌরবের মতো কিছু পেতে চাই_ মানুষের ভেতর এই উচ্চারণ আমি দেখেছি। এই অনুভবটা মানুষের ভেতর আমি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই দেখেছি; কিন্তু যখন ১৯৭১-এর মার্চ এলো, তখন বদলে গেল জনতার চেহারা। শীতের খোলস ছাড়িয়ে ফাগুনে বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আগুনঝরা আচরণ। দেখতাম মানুষের মাঝে মুক্তি অর্জনের উচ্ছ্বাস। আমি আমার এগারো বছরের ছোট্ট হৃদয় নিয়ে আবেগে মথিত হতাম। কি সকাল, কি দুপুর কিংবা বিকেল, দেখতাম আব্বাকে (্অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান। তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য; সভাপতি, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা; আহ্বায়ক, দিনাজপুর জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের সিভিল এফেয়ার্স অ্যাডভাইজার) ছুটছেন মিটিং আর মিছিলে। বাসার বাইরে সবসময় শত জনতা আব্বার দিকনির্দেশনার জন্য ভিড় করে আছে। এটা ঠিক, সেই কিশোর বয়সে স্বাধীনতার সবটুকু বুঝতাম না। স্বাধীনতার দিগন্ত বিস্তারী ফলাফল আমার বোধের সবকিছুতে কোনো পরিমাপ তৈরি করেনি। কিন্তু এটা বুঝতাম, আমরা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানিদের থেকে আলাদা হচ্ছি। শুরু হয়েছে ২ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন। সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ায় প্রবল উত্তাপ পেতে শুরু করলাম। এরপর ৭ মার্চের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর হুকুম এলো ৮ মার্চের সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে রেডিওতে_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য চাঞ্চল্য! মার্চের পরিস্থিতির উত্তাপে দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুরে আমাদের বাসার সামনে পাকিস্তানি মেজর রাজার তিনতলা বাড়ির ছাদে লম্বা নলের মেশিনগান। ভয় দেখাতে নলটা আমাদের বাড়ির দিকে তাক করানো।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের বাসার ছাদের ওপর দিয়ে সারারাত মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়ে আমাদের, মূলত আব্বাকেই ভয় দেখাল। সেই তো আমার দেখা স্বাধীনতা সংগ্রাম। যুদ্ধ শুরু হলো। পাকিস্তানিরা হেরে গেল দিনাজপুরে। আবার ওরা ১৩ এপ্রিল দিনাজপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। আব্বার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন বাঁচাতে আমরা পালিয়েছি দিনের পর দিন গ্রাম থেকে গ্রামে। অবশেষে ভারতে শরণার্থী। বড় ভাইয়ের আত্মীয়দের সঙ্গে কত শরণার্থী শিবিরে গেছি। সেই করুণ কাহিনীর ভেতর আমি আমার মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। আব্বার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুরে গেছি। শত শত তাঁবুতে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র পাশে রেখে রণাঙ্গনে যেতে আকুল। দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর বিজয় ছিনিয়ে আনার শপথ। লরি বোঝাই হয়ে যোদ্ধারা যাচ্ছে রণাঙ্গনে জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। কেউ ফিরছে আহত হয়ে।
সেই তো আমার দেখা যুদ্ধের দিন। সেই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা আমার কতটুকু! বাংলাদেশের আজ এই একচলি্লশে এসে আমার প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির হিসাবটা তো আমি করি সেই দিনগুলোতে সবার চোখে যে ভাষা ছিল সেখান থেকে। সবার বুকে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, ওই ওখান থেকে।
প্রাপ্তিযোগটাকেই আমি অনেক বেশি বলে মনে করি। একটা দেশ তো আমার আছে। সেই দেশে আমরা অনেকগুলো ঘরভর্তি মানুষ তো আছি! এদের ভেতর অনেক স্বপ্ন দেখা কোটি তরুণ তো আছে। তারাই আমার প্রাপ্তি। জানি চারদিকে অনেক যন্ত্রণা আছে। এই যন্ত্রণাগুলো নিজেদের তৈরি।
কতগুলো যন্ত্রণা মনোবৈকল্য দ্বারা সৃষ্টি। যেমন, বাংলাদেশ যেহেতু এখনও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয়, তাই পাকিস্তানি মনোভাবের কেউ কেউ বলছেন, এমন দুর্দশা দেখলে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করত না। আমি অবাক হয়ে ভাবি, তবে তো আমরা পাকিস্তানের কাঠামোভুক্তই থাকতাম। কিন্তু এ পাকিস্তান তো একটা এখন পুরো ব্যর্থ রাষ্ট্র! কি আঞ্চলিক অবস্থানে, আর কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে! কী অদ্ভুত সেই ব্যর্থ রাষ্ট্রের বুকের মাঝে কেন লেপটে থাকতে হবে! এ এক অদ্ভুত বিকৃত চিন্তা। যখন খবরে পড়ি, সপ্তাহ হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সাবেক প্রধান দুররানি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে সাক্ষী প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, তারা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচন করতে তারা দুইশ' কোটি টাকা দিয়েছিল। সত্য তারাই জানে। কিন্তু এমন খবরে তখন কীভাবে আমি আমার প্রাপ্তির হিসাব মিলাই যে আমরাই পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম!
আমাদের প্রয়োজন মাথা উঁচু করে এগোবার নীতিনির্ধারণ আর নীতিনির্ধারণে দরকার সঠিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব হবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রমনা এবং মানবিক বোধসম্পন্ন। লুটেপুটে খাবারের নেতা এখন গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায়।
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটাতে আমার বা আমাদের প্রাপ্তির ফর্দটা তখনি আমাদের হাতের মুঠোতে জ্বলজ্বল করবে, যখন এখানে প্রায় সব নেতা নিজের স্বার্থ সংকীর্ণতার বাইরে আসতে পারবেন। এসব নেতা বেরিয়ে আসবেন রাজনৈতিক কালচার বা রাজনৈতিক সমাজ থেকে। তবেই সেই রাজনৈতিক মানুষটি দেশের এবং দশের কল্যাণে প্রকৃত কাজে লাগবেন। আমাদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা কেবল ওইসব শঠ, মুনাফালোভী রাজনীতি করা লোকগুলোর কারণে, তাও কেবল একটি সঠিক প্রপঞ্চ নয়! এখানে যোগ হয়েছে দেশের সিভিল সার্ভিসে যুক্ত অসংখ্য স্বল্প মেধাবী এবং অতি লোভী লোকজন। ফলে এ দুয়ের মিশ্রণে এ এক করুণ হাল, যেখানে আমাদের প্রাপ্তিগুলো ফিকে হয়ে অদৃশ্যপ্রায়।
কেন এমন? এটা এ সমাজে বিকৃত সংস্কৃতির উত্থানের কারণে। একটা সমাজ তো বিকৃত হবেই, যখন কি-না রাষ্ট্রের সংবিধানে মানুষের আত্মার মুক্তির অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলোকে ছেঁটে দেশকে মোল্লাতান্ত্রিক করার প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক আকৃতি দেওয়া হয়। একটা সমাজ তো বিকৃত হবেই, যখন তার প্রতিষ্ঠিত জাতিসত্তার পরিচয় মুছে তাকে অন্য একটি জাতিসত্তার রূপ প্রদান করা হয়। বলা হয়, 'এই নাও। এখন থেকে এটাই তোমার গলার হার। তুমি বাংলাদেশি।' সে তখন প্রশ্নবিদ্ধ, 'আমি কে? কী আমার জাতিগত পরিচয়!' এটা করা হয় কেন? ঘুরিয়ে বলি, যখন কি-না একটি দেশে শুধু হাতে রাইফেল আছে, সেই লোকটিকে ভয় পেয়ে চলতে হবে বলে আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন তো সেই দেশে আর যাই হোক একটি বিধিবদ্ধ মানবিক মূল্যবোধের সমাজ গড়ে ওঠে না। এমন একটি সমাজ না থাকলে সেখানে, সেই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হয় না। আর তা না হলে সব মানুষের অধিকার রক্ষিত হওয়ার ধারাবাহিকতাও সেখানে আশা করা যায় না।
একটি ভূখণ্ড তো নিজের পতাকার সঙ্গে একটি কারণে স্বাধীনতা অর্জন করে, তা হলো তার জনগণ প্রতিটা মৌলিক অধিকারকে ভোগ করবে। প্রতিটা মানুষের সব চাহিদা পূরণ হবে। নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দেবে। রাষ্ট্র তার জনগণের ভোটাধিকার সংরক্ষণ করবে। দেশকে সত্যিকারভাবে সামনে এগিয়ে নিতে সৃজনশীলতাকে, গবেষণাকে উৎসাহ জোগাবে। সহায়তা দেবে।
এগুলোর দিকে তাকালে সত্যিই আমার বা আপামর জনগণের প্রাপ্তিযোগটা বড়ই দুর্বল। কিন্তু এই দুর্বল চিত্রের পাশাপাশি একটি বিরাট উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সামুদ্রিক সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাদের পক্ষে রায় পাওয়ায়। এটা একটা আরেকটি বাংলাদেশ পাওয়ার মতো বিজয়। এর ফলে বঙ্গোপসাগরে আমরা প্রায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সমান পানির অঞ্চল লাভ করলাম এবং এখন প্রয়োজন সেখান থেকে অর্থনৈতিক লাভ বের করে আনার জন্য সুদক্ষ নীতি, দক্ষ জনবল, শক্তিশালী নৌবাহিনী, যেন এসব কিছুকে সমন্বিত করে আমরা সঠিকভাবে লাভবান হতে পারি। এই সমুদ্র বিজয় আমার কাছে আরেকটি, একটি নতুন ১৬ ডিসেম্বর। আর এখান থেকে নতুন প্রাপ্তিযোগ সৃষ্টি করবে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ :কবি ও কথাসাহিত্যিক
স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধ। মুুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে রাইফেলের নলে বেঁধে লাখো তরুণ উড়াল লাল সবুজের পতাকা। সেই পতাকা হাতে বাংলাদেশ আজ একচলি্লশে।
আমি সেই যুদ্ধ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের অনুভবের ভেতর তখন হেঁটেছি। আমরা একটা কিছু পেতে যাচ্ছি। আমরা একটা গৌরবের মতো কিছু পেতে চাই_ মানুষের ভেতর এই উচ্চারণ আমি দেখেছি। এই অনুভবটা মানুষের ভেতর আমি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই দেখেছি; কিন্তু যখন ১৯৭১-এর মার্চ এলো, তখন বদলে গেল জনতার চেহারা। শীতের খোলস ছাড়িয়ে ফাগুনে বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আগুনঝরা আচরণ। দেখতাম মানুষের মাঝে মুক্তি অর্জনের উচ্ছ্বাস। আমি আমার এগারো বছরের ছোট্ট হৃদয় নিয়ে আবেগে মথিত হতাম। কি সকাল, কি দুপুর কিংবা বিকেল, দেখতাম আব্বাকে (্অ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান। তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য; সভাপতি, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা; আহ্বায়ক, দিনাজপুর জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের সিভিল এফেয়ার্স অ্যাডভাইজার) ছুটছেন মিটিং আর মিছিলে। বাসার বাইরে সবসময় শত জনতা আব্বার দিকনির্দেশনার জন্য ভিড় করে আছে। এটা ঠিক, সেই কিশোর বয়সে স্বাধীনতার সবটুকু বুঝতাম না। স্বাধীনতার দিগন্ত বিস্তারী ফলাফল আমার বোধের সবকিছুতে কোনো পরিমাপ তৈরি করেনি। কিন্তু এটা বুঝতাম, আমরা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানিদের থেকে আলাদা হচ্ছি। শুরু হয়েছে ২ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন। সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ায় প্রবল উত্তাপ পেতে শুরু করলাম। এরপর ৭ মার্চের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর হুকুম এলো ৮ মার্চের সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে রেডিওতে_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য চাঞ্চল্য! মার্চের পরিস্থিতির উত্তাপে দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুরে আমাদের বাসার সামনে পাকিস্তানি মেজর রাজার তিনতলা বাড়ির ছাদে লম্বা নলের মেশিনগান। ভয় দেখাতে নলটা আমাদের বাড়ির দিকে তাক করানো।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের বাসার ছাদের ওপর দিয়ে সারারাত মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়ে আমাদের, মূলত আব্বাকেই ভয় দেখাল। সেই তো আমার দেখা স্বাধীনতা সংগ্রাম। যুদ্ধ শুরু হলো। পাকিস্তানিরা হেরে গেল দিনাজপুরে। আবার ওরা ১৩ এপ্রিল দিনাজপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। আব্বার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন বাঁচাতে আমরা পালিয়েছি দিনের পর দিন গ্রাম থেকে গ্রামে। অবশেষে ভারতে শরণার্থী। বড় ভাইয়ের আত্মীয়দের সঙ্গে কত শরণার্থী শিবিরে গেছি। সেই করুণ কাহিনীর ভেতর আমি আমার মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। আব্বার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুরে গেছি। শত শত তাঁবুতে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র পাশে রেখে রণাঙ্গনে যেতে আকুল। দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর বিজয় ছিনিয়ে আনার শপথ। লরি বোঝাই হয়ে যোদ্ধারা যাচ্ছে রণাঙ্গনে জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। কেউ ফিরছে আহত হয়ে।
সেই তো আমার দেখা যুদ্ধের দিন। সেই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা আমার কতটুকু! বাংলাদেশের আজ এই একচলি্লশে এসে আমার প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তির হিসাবটা তো আমি করি সেই দিনগুলোতে সবার চোখে যে ভাষা ছিল সেখান থেকে। সবার বুকে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, ওই ওখান থেকে।
প্রাপ্তিযোগটাকেই আমি অনেক বেশি বলে মনে করি। একটা দেশ তো আমার আছে। সেই দেশে আমরা অনেকগুলো ঘরভর্তি মানুষ তো আছি! এদের ভেতর অনেক স্বপ্ন দেখা কোটি তরুণ তো আছে। তারাই আমার প্রাপ্তি। জানি চারদিকে অনেক যন্ত্রণা আছে। এই যন্ত্রণাগুলো নিজেদের তৈরি।
কতগুলো যন্ত্রণা মনোবৈকল্য দ্বারা সৃষ্টি। যেমন, বাংলাদেশ যেহেতু এখনও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয়, তাই পাকিস্তানি মনোভাবের কেউ কেউ বলছেন, এমন দুর্দশা দেখলে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করত না। আমি অবাক হয়ে ভাবি, তবে তো আমরা পাকিস্তানের কাঠামোভুক্তই থাকতাম। কিন্তু এ পাকিস্তান তো একটা এখন পুরো ব্যর্থ রাষ্ট্র! কি আঞ্চলিক অবস্থানে, আর কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে! কী অদ্ভুত সেই ব্যর্থ রাষ্ট্রের বুকের মাঝে কেন লেপটে থাকতে হবে! এ এক অদ্ভুত বিকৃত চিন্তা। যখন খবরে পড়ি, সপ্তাহ হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সাবেক প্রধান দুররানি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে সাক্ষী প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, তারা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচন করতে তারা দুইশ' কোটি টাকা দিয়েছিল। সত্য তারাই জানে। কিন্তু এমন খবরে তখন কীভাবে আমি আমার প্রাপ্তির হিসাব মিলাই যে আমরাই পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে আমরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম!
আমাদের প্রয়োজন মাথা উঁচু করে এগোবার নীতিনির্ধারণ আর নীতিনির্ধারণে দরকার সঠিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব হবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রমনা এবং মানবিক বোধসম্পন্ন। লুটেপুটে খাবারের নেতা এখন গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায়।
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটাতে আমার বা আমাদের প্রাপ্তির ফর্দটা তখনি আমাদের হাতের মুঠোতে জ্বলজ্বল করবে, যখন এখানে প্রায় সব নেতা নিজের স্বার্থ সংকীর্ণতার বাইরে আসতে পারবেন। এসব নেতা বেরিয়ে আসবেন রাজনৈতিক কালচার বা রাজনৈতিক সমাজ থেকে। তবেই সেই রাজনৈতিক মানুষটি দেশের এবং দশের কল্যাণে প্রকৃত কাজে লাগবেন। আমাদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা কেবল ওইসব শঠ, মুনাফালোভী রাজনীতি করা লোকগুলোর কারণে, তাও কেবল একটি সঠিক প্রপঞ্চ নয়! এখানে যোগ হয়েছে দেশের সিভিল সার্ভিসে যুক্ত অসংখ্য স্বল্প মেধাবী এবং অতি লোভী লোকজন। ফলে এ দুয়ের মিশ্রণে এ এক করুণ হাল, যেখানে আমাদের প্রাপ্তিগুলো ফিকে হয়ে অদৃশ্যপ্রায়।
কেন এমন? এটা এ সমাজে বিকৃত সংস্কৃতির উত্থানের কারণে। একটা সমাজ তো বিকৃত হবেই, যখন কি-না রাষ্ট্রের সংবিধানে মানুষের আত্মার মুক্তির অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলোকে ছেঁটে দেশকে মোল্লাতান্ত্রিক করার প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক আকৃতি দেওয়া হয়। একটা সমাজ তো বিকৃত হবেই, যখন তার প্রতিষ্ঠিত জাতিসত্তার পরিচয় মুছে তাকে অন্য একটি জাতিসত্তার রূপ প্রদান করা হয়। বলা হয়, 'এই নাও। এখন থেকে এটাই তোমার গলার হার। তুমি বাংলাদেশি।' সে তখন প্রশ্নবিদ্ধ, 'আমি কে? কী আমার জাতিগত পরিচয়!' এটা করা হয় কেন? ঘুরিয়ে বলি, যখন কি-না একটি দেশে শুধু হাতে রাইফেল আছে, সেই লোকটিকে ভয় পেয়ে চলতে হবে বলে আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন তো সেই দেশে আর যাই হোক একটি বিধিবদ্ধ মানবিক মূল্যবোধের সমাজ গড়ে ওঠে না। এমন একটি সমাজ না থাকলে সেখানে, সেই রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি হয় না। আর তা না হলে সব মানুষের অধিকার রক্ষিত হওয়ার ধারাবাহিকতাও সেখানে আশা করা যায় না।
একটি ভূখণ্ড তো নিজের পতাকার সঙ্গে একটি কারণে স্বাধীনতা অর্জন করে, তা হলো তার জনগণ প্রতিটা মৌলিক অধিকারকে ভোগ করবে। প্রতিটা মানুষের সব চাহিদা পূরণ হবে। নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দেবে। রাষ্ট্র তার জনগণের ভোটাধিকার সংরক্ষণ করবে। দেশকে সত্যিকারভাবে সামনে এগিয়ে নিতে সৃজনশীলতাকে, গবেষণাকে উৎসাহ জোগাবে। সহায়তা দেবে।
এগুলোর দিকে তাকালে সত্যিই আমার বা আপামর জনগণের প্রাপ্তিযোগটা বড়ই দুর্বল। কিন্তু এই দুর্বল চিত্রের পাশাপাশি একটি বিরাট উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সামুদ্রিক সীমান্ত সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাদের পক্ষে রায় পাওয়ায়। এটা একটা আরেকটি বাংলাদেশ পাওয়ার মতো বিজয়। এর ফলে বঙ্গোপসাগরে আমরা প্রায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সমান পানির অঞ্চল লাভ করলাম এবং এখন প্রয়োজন সেখান থেকে অর্থনৈতিক লাভ বের করে আনার জন্য সুদক্ষ নীতি, দক্ষ জনবল, শক্তিশালী নৌবাহিনী, যেন এসব কিছুকে সমন্বিত করে আমরা সঠিকভাবে লাভবান হতে পারি। এই সমুদ্র বিজয় আমার কাছে আরেকটি, একটি নতুন ১৬ ডিসেম্বর। আর এখান থেকে নতুন প্রাপ্তিযোগ সৃষ্টি করবে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ :কবি ও কথাসাহিত্যিক
No comments