রূপকথার আলীবাবার বাস্তব রূপ by আবু এন এম ওয়াহিদ
জীবনে প্রথম আলীবাবার গল্প কখন কার কাছে কোথায় শুনেছিলাম তা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, গল্পটি যখন শুনছিলাম তখন তন্ময় হয়ে চুপচাপ বসেছিলাম। কৌতূহল আর উদ্দীপনার কোনো শেষ ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত কান খাড়া করে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম- এরপর কী! তারপর কী! অবশেষে এক জায়গায় এসে দেখলাম, তার আর পর নেই, অর্থাৎ
গল্পটি শেষ হয়ে গেল। গল্প যখন শেষ হলো তখন বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলাম, আবার খারাপও লেগেছিল বেশ। মনে মনে বলছিলাম, এত সুন্দর গল্প, এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কেন? ভাবছিলাম, গল্পটি যদি আরো লম্বা হতো, না জানি কত মজা হতো! বয়স একটু বাড়ার পর যখন গিয়ে বড়লেখা পিসি হাই স্কুলে ভর্তি হলাম তখন পড়তে শিখেছি। উজালা গ্রন্থাগার থেকে বই তুলে এনে নিজে নিজে একই গল্প আবার পড়লাম, কিন্তু প্রথমবারের শোনা গল্পের মতো এত মজা পাইনি।
তারপর কেটে গেছে বহু বছর, বহু যুগ। মধ্যযুগীয় আরব্য সাহিত্যের রূপকথার গল্প 'আলীবাবা ও চলি্লশ ডাকাতের কাহিনী' শোনার সুযোগ হয়নি, শোনাও হয়নি। শোনা হয়নি আলীবাবার মতো সৌভাগ্যের কথা, দেখা হয়নি কাসিমের মতো লোভী মানুষের করুণ পরিণতির ঘটনা। জানা হয়নি মর্জিনার মতো প্রত্যুৎপন্নমতি বালিকার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের ফলাফল। এইটুকু বলে, বিশেষ করে আমি আজকের নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মনে একটু কৌতূহল জাগাবার চেষ্টা করছি। গল্পটি জানা না থাকলে অবশ্যই পড়ে নেবেন। আর কোথাও বই না পেলে আলীবাবার ইংরেজি ভার্সন সহজেই পেয়ে যাবেন উইকিপিডিয়ায়। রূপকথার গল্প শোনার বয়স পার হয়ে এসেছি অনেক আগে, কিন্তু এর মধ্যে দেশে-বিদেশে অন্য আঙ্গিকে, অন্য পরিবেশে শুনেছি ভিন্ন আলীবাবার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে আছে বিখ্যাত 'আলীবাবা টার্কিশ কুইজিন'। পিটসবার্গে জমজমাট ব্যবসা চলে 'আলীবাবা মিডলইস্টার্ন রেস্টুরেন্টে'। একই নামে আরেকটি পপুলার খাবার দোকান আছে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিস্কো শহরে। তার নাম 'আলীবাবা মেডিটারেনিয়ান কুইজিন'। লোন স্টার স্টেট টেঙ্াসের ডালাসে নিশ্চয়ই কোনো আরব ব্রাদার চালু করেছেন 'আলীবাবা মেডিটারেনিয়ান গ্রিল'। আমাদের শহর ন্যাসভিলেও আছে আলীবাবা নামে অন্তত দুটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট। জার্মানির বার্লিনে ইনস্টিটিউট ফর ইনফরমেটিকে আছে আলীবাবা মেডিক্যাল পাবলিকেন্স গ্রুপ। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় গড়ে উঠেছে 'আলীবাবা লিমোজিন সার্ভিসেস'। এ ছাড়া আলীবাবা নামে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আছে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোনো কোনোটার কথা আমরা জানি, কোনোটার কথা জানিও না। যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এখানে উল্লেখ করলাম, তার সঙ্গে রূপকথার আলীবাবার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
কিন্তু আজকে যে আলীবাবার গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি, সে অন্য এক আলীবাবার কাহিনী। নতুন এক আলীবাবার কথা, আধুনিক এক আলীবাবার গল্প। এই আলীবাবা রূপকথার কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। তার উৎপত্তি আরব দেশেও নয়। আজকের আলীবাবার জন্ম চীন দেশে। তথাপি মজার ব্যাপার হলো, এই আলীবাবার সঙ্গে আরব্য কল্পকথার আলীবাবার একটি সুন্দর যোগসূত্রও আছে। হঠাৎ আলীবাবার প্রতি নজর পড়ল কেন- এখানে তার একটি ছোট্ট শানে-নুজুলের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সেদিন আমার সপ্তাহিক তিন ঘণ্টার এক নিয়মিত ক্লাসে ডিপার্টমেন্ট থেকে এক চীনা ভিজিটিং প্রফেসরকে পাঠানো হলো। বলা হলো, তিনি সে দেশের অর্থনীতির ওপর আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক ঘণ্টার একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করে এনেছেন। এবারকার আমাদের অতিথি অধ্যাপক একজন নারী। তাঁর নাম ড. জিয়ানবো বাও। তিনি চীনের তিয়ানজিন পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থশাস্ত্র ফ্যাকাল্টির ডিন। এঙ্চেঞ্জ প্রোগ্রামের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন চীনের সঙ্গে আমেরিকার মেলবন্ধ ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আজকাল চীনের সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে কৌতূহল আর আগ্রহের কোনো শেষ নেই। পরিচয়পর্ব সেরে ড. বাও যথারীতি তাঁর পাওয়ার পয়েন্ট বক্তৃতা শুরু করলেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে আমিও তাঁর কথা শুনছিলাম। স্ক্রিনে আরো অনেক নাম না জানা নামের সঙ্গে হঠাৎ ভেসে এলো একটি আইকন, তার পাশে একটি ছোট্ট শব্দ 'আলীবাবা'।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিথি অধ্যাপক আমাদের নিয়ে গেলেন মোহময়ী আলীবাবার বিশাল বাস্তব জগতে। তিনি বললেন, ১৯৯৯ সালে চীনের কোনো স্কুল কিংবা কলেজের জনৈক প্রাক্তন ইংরেজি শিক্ষক যার নাম জ্যাক মা, তিনি পূর্ব চীনের হ্যাংঝাও শহরে এই কম্পনির গোড়াপত্তন করেন। বর্তমানে আলীবাবা ডটকম চীনের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট কম্পানি। আসলে এটি একটি একক কম্পানি নয়, বরং অনেক কম্পানির সংমিশ্রণে একটি গ্রুপ অব কম্পানিজ বলা যায়। এর বিশেষত্ব ই-বিজনেস এবং ই-কমার্স। ২০০৫ সালে আলীবাবার পেরেন্ট কম্পানিতে আরেক ইন্টারনেট জায়েন্ট-ইয়াহু বিনিয়োগ করেছে ১০০ কোটি ডলার। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহু তার চৈনিক ওয়েবসাইটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আলীবাবা ডটকমের কাছে হস্তান্তর করেছে।
আলীবাবা ডটকম যেসব ব্যবসা করে থাকে তার মধ্যে অনলাইন অকশন, ইন্টারনেটে বি২বি (বিজনিস টু বিজনেস), বি২সি (বিজনেস টু কাস্টমারস) সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনস, ডোমেইন নেম রেজিস্ট্রেশন, ওয়েবসাইট হোস্টিং অ্যান্ড সলিউশনস, ইমেইল হোস্টিং, ইন্টারনেট সম্পর্কিত কনসাল্টিং সার্ভিসেস ইত্যাদি অন্যতম। আলীবাবা ডটকমের অধীনে অনেক সাবসিডিয়ারি কম্পানি কাজ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- টাওবাও ডটকম, টি'মল, ই-টাও, আলীবাবা ক্লাউড কম্পিউটিং, চায়না ইয়াহু এবং আলী পে কম্পানি। বর্তমানে এসব কম্পানিতে কাজ করেন প্রায় ২২ হাজার কর্মচারী। ছোট ব্যবসার জন্য আলীবাবা ডটকম এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বি২বি ব্যবসা প্ল্যাটফরম। চীনের বাজারে ব্যবসা শুরু করলেও মাত্র ১০ বছরে এখন আলীবাবার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৪০টি অঞ্চলের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী আলীবাবার রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারী আছে ছয় কোটি ৫০ লাখ। আলীবাবার শেয়ার কেনাবেচা হয় হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে। এখন এই কম্পানির বাজারজাত পুঁজির (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) পরিমাণ হলো ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। পৃথিবীর সব ইন্টারনেট কম্পানির মধ্যে গুগলের পরেই আলীবাবার স্থান।
এবার আসছি আসল কথায়, চীনের নতুন ও আধুনিক আলীবাবার সঙ্গে মধ্যযুগীয় আরব্য সাহিত্যের আলীবাবার সম্পর্কটি কী। ইন্টারনেট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা বলছেন, কম্পানি প্রতিষ্ঠার আগে একদিন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিস্কো শহরে এক কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক উয়েট্রেস এসে দাঁড়াল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি আলীবাবার নাম শুনেছ? মেয়েটি বলল- হ্যাঁ। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, কী জান তুমি আলীবাবা সম্বন্ধে? উত্তর এলো, 'সিসিম ফাঁক'। কফিশপ থেকে বেরিয়ে জ্যাক মা সানফ্রানসিস্কোর রাস্তায় হাঁটছেন। হেঁটে হেঁটে একে একে তিনি বিভিন্ন দেশের ৩০ জন পথচারীর কাছে একই প্রশ্ন রাখলেন এবং এমন কাউকে তিনি পেলেন না যে কি না আলীবাবার নাম কোনো দিন শোনেনি। জ্যাক মা আরো বললেন, রূপকথার আলীবাবার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। আলীবাবাও ছিলেন একজন সৎ ও হৃদয়বান মার্চেন্ট। তিনি সাহসের সঙ্গে অফুরন্ত ধনদৌলতের গুপ্ত গুহার দরজা উন্মুক্ত করেছিলেন। আলীবাবা নামটি বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত। তাই জ্যাক মা ফ্রানসিস্কোতে বসেই মনস্থির করলেন, তিনি দেশে গিয়ে আলীবাবা নামে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবসা শুরু করবেন, যা কি না পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইন্টারনেট জগতের ছোট ব্যবসার জন্য সৌভাগ্যের স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে ১৭০ কোটি ডলারের ব্যবসা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন সাফল্য বিরলই বটে। জ্যাক মা তাঁর মেধা, অভিনবত্ব ও পরিশ্রমের জাদুর কাঠি দিয়ে হাজার বছরের পুরনো রূপকথার আলীবাবাকে নতুন ও আধুনিক আলীবাবার বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। রূপকথার আলীবাবার সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান লেখক কে তা আমরা জানি না। তবে আধুনিক আলীবাবার জনক জ্যাক মার সাফল্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তার জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হোক এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
তারপর কেটে গেছে বহু বছর, বহু যুগ। মধ্যযুগীয় আরব্য সাহিত্যের রূপকথার গল্প 'আলীবাবা ও চলি্লশ ডাকাতের কাহিনী' শোনার সুযোগ হয়নি, শোনাও হয়নি। শোনা হয়নি আলীবাবার মতো সৌভাগ্যের কথা, দেখা হয়নি কাসিমের মতো লোভী মানুষের করুণ পরিণতির ঘটনা। জানা হয়নি মর্জিনার মতো প্রত্যুৎপন্নমতি বালিকার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের ফলাফল। এইটুকু বলে, বিশেষ করে আমি আজকের নতুন প্রজন্মের পাঠকদের মনে একটু কৌতূহল জাগাবার চেষ্টা করছি। গল্পটি জানা না থাকলে অবশ্যই পড়ে নেবেন। আর কোথাও বই না পেলে আলীবাবার ইংরেজি ভার্সন সহজেই পেয়ে যাবেন উইকিপিডিয়ায়। রূপকথার গল্প শোনার বয়স পার হয়ে এসেছি অনেক আগে, কিন্তু এর মধ্যে দেশে-বিদেশে অন্য আঙ্গিকে, অন্য পরিবেশে শুনেছি ভিন্ন আলীবাবার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে আছে বিখ্যাত 'আলীবাবা টার্কিশ কুইজিন'। পিটসবার্গে জমজমাট ব্যবসা চলে 'আলীবাবা মিডলইস্টার্ন রেস্টুরেন্টে'। একই নামে আরেকটি পপুলার খাবার দোকান আছে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিস্কো শহরে। তার নাম 'আলীবাবা মেডিটারেনিয়ান কুইজিন'। লোন স্টার স্টেট টেঙ্াসের ডালাসে নিশ্চয়ই কোনো আরব ব্রাদার চালু করেছেন 'আলীবাবা মেডিটারেনিয়ান গ্রিল'। আমাদের শহর ন্যাসভিলেও আছে আলীবাবা নামে অন্তত দুটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট। জার্মানির বার্লিনে ইনস্টিটিউট ফর ইনফরমেটিকে আছে আলীবাবা মেডিক্যাল পাবলিকেন্স গ্রুপ। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় গড়ে উঠেছে 'আলীবাবা লিমোজিন সার্ভিসেস'। এ ছাড়া আলীবাবা নামে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আছে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোনো কোনোটার কথা আমরা জানি, কোনোটার কথা জানিও না। যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এখানে উল্লেখ করলাম, তার সঙ্গে রূপকথার আলীবাবার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
কিন্তু আজকে যে আলীবাবার গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি, সে অন্য এক আলীবাবার কাহিনী। নতুন এক আলীবাবার কথা, আধুনিক এক আলীবাবার গল্প। এই আলীবাবা রূপকথার কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। তার উৎপত্তি আরব দেশেও নয়। আজকের আলীবাবার জন্ম চীন দেশে। তথাপি মজার ব্যাপার হলো, এই আলীবাবার সঙ্গে আরব্য কল্পকথার আলীবাবার একটি সুন্দর যোগসূত্রও আছে। হঠাৎ আলীবাবার প্রতি নজর পড়ল কেন- এখানে তার একটি ছোট্ট শানে-নুজুলের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সেদিন আমার সপ্তাহিক তিন ঘণ্টার এক নিয়মিত ক্লাসে ডিপার্টমেন্ট থেকে এক চীনা ভিজিটিং প্রফেসরকে পাঠানো হলো। বলা হলো, তিনি সে দেশের অর্থনীতির ওপর আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক ঘণ্টার একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করে এনেছেন। এবারকার আমাদের অতিথি অধ্যাপক একজন নারী। তাঁর নাম ড. জিয়ানবো বাও। তিনি চীনের তিয়ানজিন পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থশাস্ত্র ফ্যাকাল্টির ডিন। এঙ্চেঞ্জ প্রোগ্রামের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন চীনের সঙ্গে আমেরিকার মেলবন্ধ ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। আমেরিকান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আজকাল চীনের সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে কৌতূহল আর আগ্রহের কোনো শেষ নেই। পরিচয়পর্ব সেরে ড. বাও যথারীতি তাঁর পাওয়ার পয়েন্ট বক্তৃতা শুরু করলেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে আমিও তাঁর কথা শুনছিলাম। স্ক্রিনে আরো অনেক নাম না জানা নামের সঙ্গে হঠাৎ ভেসে এলো একটি আইকন, তার পাশে একটি ছোট্ট শব্দ 'আলীবাবা'।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিথি অধ্যাপক আমাদের নিয়ে গেলেন মোহময়ী আলীবাবার বিশাল বাস্তব জগতে। তিনি বললেন, ১৯৯৯ সালে চীনের কোনো স্কুল কিংবা কলেজের জনৈক প্রাক্তন ইংরেজি শিক্ষক যার নাম জ্যাক মা, তিনি পূর্ব চীনের হ্যাংঝাও শহরে এই কম্পনির গোড়াপত্তন করেন। বর্তমানে আলীবাবা ডটকম চীনের সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট কম্পানি। আসলে এটি একটি একক কম্পানি নয়, বরং অনেক কম্পানির সংমিশ্রণে একটি গ্রুপ অব কম্পানিজ বলা যায়। এর বিশেষত্ব ই-বিজনেস এবং ই-কমার্স। ২০০৫ সালে আলীবাবার পেরেন্ট কম্পানিতে আরেক ইন্টারনেট জায়েন্ট-ইয়াহু বিনিয়োগ করেছে ১০০ কোটি ডলার। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহু তার চৈনিক ওয়েবসাইটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আলীবাবা ডটকমের কাছে হস্তান্তর করেছে।
আলীবাবা ডটকম যেসব ব্যবসা করে থাকে তার মধ্যে অনলাইন অকশন, ইন্টারনেটে বি২বি (বিজনিস টু বিজনেস), বি২সি (বিজনেস টু কাস্টমারস) সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনস, ডোমেইন নেম রেজিস্ট্রেশন, ওয়েবসাইট হোস্টিং অ্যান্ড সলিউশনস, ইমেইল হোস্টিং, ইন্টারনেট সম্পর্কিত কনসাল্টিং সার্ভিসেস ইত্যাদি অন্যতম। আলীবাবা ডটকমের অধীনে অনেক সাবসিডিয়ারি কম্পানি কাজ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- টাওবাও ডটকম, টি'মল, ই-টাও, আলীবাবা ক্লাউড কম্পিউটিং, চায়না ইয়াহু এবং আলী পে কম্পানি। বর্তমানে এসব কম্পানিতে কাজ করেন প্রায় ২২ হাজার কর্মচারী। ছোট ব্যবসার জন্য আলীবাবা ডটকম এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বি২বি ব্যবসা প্ল্যাটফরম। চীনের বাজারে ব্যবসা শুরু করলেও মাত্র ১০ বছরে এখন আলীবাবার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৪০টি অঞ্চলের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী আলীবাবার রেজিস্টার্ড ব্যবহারকারী আছে ছয় কোটি ৫০ লাখ। আলীবাবার শেয়ার কেনাবেচা হয় হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে। এখন এই কম্পানির বাজারজাত পুঁজির (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) পরিমাণ হলো ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। পৃথিবীর সব ইন্টারনেট কম্পানির মধ্যে গুগলের পরেই আলীবাবার স্থান।
এবার আসছি আসল কথায়, চীনের নতুন ও আধুনিক আলীবাবার সঙ্গে মধ্যযুগীয় আরব্য সাহিত্যের আলীবাবার সম্পর্কটি কী। ইন্টারনেট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা বলছেন, কম্পানি প্রতিষ্ঠার আগে একদিন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিস্কো শহরে এক কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক উয়েট্রেস এসে দাঁড়াল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি আলীবাবার নাম শুনেছ? মেয়েটি বলল- হ্যাঁ। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, কী জান তুমি আলীবাবা সম্বন্ধে? উত্তর এলো, 'সিসিম ফাঁক'। কফিশপ থেকে বেরিয়ে জ্যাক মা সানফ্রানসিস্কোর রাস্তায় হাঁটছেন। হেঁটে হেঁটে একে একে তিনি বিভিন্ন দেশের ৩০ জন পথচারীর কাছে একই প্রশ্ন রাখলেন এবং এমন কাউকে তিনি পেলেন না যে কি না আলীবাবার নাম কোনো দিন শোনেনি। জ্যাক মা আরো বললেন, রূপকথার আলীবাবার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। আলীবাবাও ছিলেন একজন সৎ ও হৃদয়বান মার্চেন্ট। তিনি সাহসের সঙ্গে অফুরন্ত ধনদৌলতের গুপ্ত গুহার দরজা উন্মুক্ত করেছিলেন। আলীবাবা নামটি বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত। তাই জ্যাক মা ফ্রানসিস্কোতে বসেই মনস্থির করলেন, তিনি দেশে গিয়ে আলীবাবা নামে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবসা শুরু করবেন, যা কি না পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইন্টারনেট জগতের ছোট ব্যবসার জন্য সৌভাগ্যের স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে শূন্য থেকে ১৭০ কোটি ডলারের ব্যবসা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন সাফল্য বিরলই বটে। জ্যাক মা তাঁর মেধা, অভিনবত্ব ও পরিশ্রমের জাদুর কাঠি দিয়ে হাজার বছরের পুরনো রূপকথার আলীবাবাকে নতুন ও আধুনিক আলীবাবার বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। রূপকথার আলীবাবার সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান লেখক কে তা আমরা জানি না। তবে আধুনিক আলীবাবার জনক জ্যাক মার সাফল্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য উদ্যোক্তার জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হোক এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
No comments