সময়ের প্রতিবিম্ব-তত্ত্বাবধায়ক বিলুপ্তি নিয়ে বিচিত্র কথন by এবিএম মূসা
অবশেষে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। এই পেশ করার পদ্ধতি নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। কারণ, সংসদ কর্তৃক নিয়োজিত কমিটির রিপোর্ট তো সংসদেই পেশ করার কথা। আগাম প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে বলেই ‘ফাঁস’ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, কমিটির ৫১টি সুপারিশের ২২ নম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তথা অনুচ্ছেদ ২-ক বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে। গত ৩০ মে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। পরদিন সেই বৈঠকের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে একই ধরনের শিরোনামে, ‘কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।’ সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য তার আগে বলে দিয়েছেন, আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েই গেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সঠিকভাবে সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে, তবে সংসদীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশের স্বচ্ছতা ও ব্যুৎপত্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চরম সিদ্ধান্ত এই ধারণা নিয়ে বিরোধী দল সোচ্চার হয়েছে।
বস্তুত, তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমিও খেই হারিয়ে ফেলছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা সঠিক হয়নি, নাকি ব্যবস্থাটি এখনো আছে সুতরাং থাকা উচিত, কোনটি হবে আলোচনার বিষয়? অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, আদালতের রায় যা-ই বলুক অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই রায়ের যে ব্যাখ্যাই দিন, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুচ্ছেদ ২-খ সংবিধান থেকে বিলীন না করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন। এখন শুধু সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ, বস্তুত তিন-চতুর্থাংশ ভোটে পাস করার আনুষ্ঠানিক কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এ যেন সেই ইংরেজি শব্দ ‘পিলার’ বানান করার গপ্পো। ছাত্র শিক্ষককে জিজ্ঞেস করছে, বানানে একটি নাকি দুটি ‘এল’ হবে। স্যার বললেন, একটিই যথেষ্ট তবে দুটি দিলে পিলারটি মজবুত হবে। এই গল্পটির মাজেজা অনুসরণে বলতে পারি, সুপারিশ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটিকে খামিরা করেছে মাত্র। এখন সংসদে সরকারি দল বিভক্তি ভোট গ্রহণকালে কক্ষ থেকে ‘হ্যাঁ’ দরজা দিয়ে একযোগে বের হলেই পিলারটি আরও পোক্ত হবে। অনুচ্ছেদ ৭০ বজায় থাকতে তাদের অন্যথা করার অধিকার নেই।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা আছে কি নেই নয়, থাকলেও থাকবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের মাঝখানে আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে। প্রথম আলো গ্রন্থাগারে পুরোনো ফাইল ঘেঁটে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৯৫ সালের শেষে আর ছিয়ানব্বইয়ের প্রথমে লেখা আমার প্রতিবেদনগুলো পড়ছিলাম। হিসাব করে দেখেছি, প্রায় ৩০ হাজার শব্দ লিখেছি আওয়ামী লীগের দাবিকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অনেক যুক্তিসম্মত বক্তব্য দিয়েছি। এখন কি নিজের দেওয়া যুক্তিগুলো নিজেকেই খণ্ডাতে হবে? রাজনীতিবিদেরা ভোল পাল্টাতে পারেন, আমরা কি কলম উল্টাতে পারব?
একটুখানি অতীতে যাওয়া যাক। বিএনপির মাগুরা উপনির্বাচনের কেলেঙ্কারির পর দেশের সাধারণ মানুষ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। আমরা সেই জনমতেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছি। এখন তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার বিপক্ষে বলতে হলে জানতে বা বুঝতে হবে, ১৯৯৫ সালের ১৬ বছর পর ২০১১ সালে এসে জনমতের পরিবর্তন ঘটেছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে কোনো জরিপ হয়নি। সেই সময়ে যাঁরা জনগণকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে লাগাতার হরতাল করতে বলেছিলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’ দাবিতে সোচ্চার করেছিলেন, তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। একইভাবে তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমানের বিরোধী দল এপাশ থেকে ওপাশে ফিরেছে। পঁচানব্বইতে যাদের ‘শিশু ও পাগল’ বলেছিল, তাদের এখন ‘বয়স্ক ও সুস্থ’ বলছে। ষোলো বছর আগে যে ব্যবস্থাটিকে যাঁরা ‘না’ বলেছিলেন, এখন তাঁরা ‘হ্যাঁ’ বলছেন। আগে ‘হ্যাঁ’ বলানোর জন্য যাঁরা জনগণকে লাগাতার আন্দোলনে মাঠে নামিয়েছেন, তাঁরা এখন ‘না’ বলছেন। এখন ‘হ্যাঁ’-বলা জনগণকে দিয়ে ‘না’ বলাতে পারবেন কি না, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দায়টি আদালতের কাঁধে চাপিয়েছিলেন।
আদালতের রায়ের পূর্ণ বিবরণ এখনো পাওয়া যায়নি। যত দূর জানা গেছে তাতে মনে হয়েছে, আদালত পরোক্ষে তাঁদের কাঁধে চাপানো বন্দুকটি আবার সরকারের নীতিনির্ধারকদের তথা সংসদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এ যেন বনভোজনে বালিশ পাচার করার খেলা। তদুপরি তাঁরা একটি প্যাঁচালো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন। যেমন—একদিকে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বেআইনি, মানে ২-ক অনুচ্ছেদ, সংবিধানের মূলনীতি গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী। আবার বলছেন, দুবার অগণতান্ত্রিক কাজটি করা যাবে। বলা যায় আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা ক্ষমতায় বহাল থেকে আগামী দুটি নির্বাচন করবেন, কী পন্থায় করবেন, তা নির্ধারণ করবেন। ব্যাখ্যাটি এমন হতে পারে, বিদায়ী গণতান্ত্রিক সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেটের সমাপ্তিতে অগণতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করে আরও ৯০ দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে। দলীয় সরকারই মেয়াদ শেষে ‘আপনা-আপনি’ নির্দলীয় সরকার অথবা পরোক্ষে তত্ত্বাবধায়ক বনে যাবে। তাই যদি হয়, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন কেন এ রকমটি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন? লগি-বৈঠা দিয়ে তাঁকে তত্ত্বাবধায়কের পদ থেকে হটানো হয়েছিল কেন?
এত সব প্যাঁচালো আলোচনার ইতি ঘটিয়ে ধরে নিচ্ছি, ২-ক পরিচ্ছেদ বিলুপ্ত হয়েছে বা সংসদে বিলুপ্তি হালাল করা হবে। আড়াই বছর পর বর্তমান দলীয় সরকারই মেয়াদ শেষে একধরনের ‘নির্দলীয়’ সরকারের লেবাস পরবে। তার পরও তাঁরা নির্বাচন ‘পরিচালনা’ করবেন না, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শুধু ‘পর্যবেক্ষণ’ করবেন—তর্কের খাতিরে এই আগাম ধারণায় পূর্ণ আস্থা রাখছি। আরও বিশ্বাস করছি, সেই নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব একটি ‘স্বাধীন ও সর্বময় ক্ষমতার’ অধিকারী নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত হবে। তারা সাহসিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করবে। এদিকে আবার প্রশাসনিক ব্যবস্থা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। মানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তারা সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকবে, নির্বাচন পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করবে না। এমনটি বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। কারণ, যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংস্কৃতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা চেয়েছি, ষোলো বছরে সেসবের পরিবর্তন ঘটেছে এমন আলামত দেখতে পাচ্ছি না। আরও কথা আছে, যদি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নয় এই কারণে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা আদালতের মতে সংবিধানবিরোধী ও ‘অগণতান্ত্রিক’ হয়ে থাকে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি সরকারকে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলা হবে না কেন? ভবিষ্যতে কোনো নাগরিক এই প্রশ্ন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ অসাংবিধানিক ছিল, তখনকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আদালতের এমন রায়ও হতে পারে বৈকি।
এর পরের ধাঁধা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বিলীন হলে উপদেষ্টার স্থলে যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ক্ষমতায় বহাল থাকবেন, নির্বাচনের সময়ে তাঁদের প্রোটোকল কী হবে? নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা বাস্তবসম্মত হবে কি? সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প যদি হয় বিদায়ী রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা, তবে তাঁদের ক্ষেত্রে কি বিলুপ্ত ২-ক অনুচ্ছেদের ৫৮-গ(৭) উপ-অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে? সেই শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার কাছে এমন প্রত্যাশা করা হবে বাতুলতা। সুতরাং বলা যায়, তাঁরা আগে-পিছে সিপাহি-সান্ত্রি নিয়ে নিজের ও দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামলে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে উত্তপ্ত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করতে হলে আরও একটি বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সঙ্গে অর্থাৎ ২-ক পরিচ্ছেদের সঙ্গে চতুর্থ পরিচ্ছেদটি সম্পৃক্ত রয়েছে। সেই পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে মেয়াদে ৫৮-খ অনুচ্ছেদের অধীনে নির্দলীয় সরকার থাকিবে সেই মেয়াদে, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পরিচালিত হইবে।’ অসাংবিধানিক ঘোষণা করার রায়ে এ সম্পর্কে আদালত কী নির্দেশনা দিয়েছেন, তা জানা যায়নি। সংশোধন কমিটির এতদসম্পর্কীয় সুপারিশ স্বচ্ছ নয়, অন্তত আমার পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। এই প্রশ্নের মীমাংসা না হলে নির্বাচনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েন নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা হবে।
এতক্ষণ এত সব আলোচনা করলাম একটি নিশ্চিত প্রাক-ধারণার ভিত্তিতে। দুর্ভাবনা হচ্ছে, বর্তমানের ক্ষমতাসীন সরকার বর্ধিত সময়কালে কতখানি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে। তাদের ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী স্বল্পকালীন বিএনপি সরকারের অথবা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের স্বল্পকালীন সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভাগ্যবরণ করতে হবে না তো? অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এই প্রশ্নসমূহের উত্তর পাওয়া যাবে। সেই ইতিহাস হচ্ছে, যদি জনগণ মনে করে কোনো ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, দল বা সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চিরায়ত করতেই কোনো দোহাই দিচ্ছে, সংবিধানের নানা রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে অথবা অসাংবিধানিক কৌশল অবলম্বন করছে, তখন তারা আপনা-আপনি ফুঁসে ওঠে, রুখে দাঁড়ায়।
পাদটীকা: এফবিসিসিআই চেয়ারম্যান এ কে আজাদ গত ২৭ এপ্রিল একটি মোক্ষম কথা বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে অর্ধেক ব্যবসায়ী দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে।’ তাঁকে আমার প্রশ্ন, এই অর্ধেক কি সেই সব অসাধু ব্যবসায়ী, যাঁরা সিন্ডিকেট করেছেন, সেসব মজুদদার চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়িয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়েছেন? তাই যদি হয়, কোটি কোটি ভোক্তা অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বহাল রাখা সমর্থন করবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
বস্তুত, তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বিলুপ্তির বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমিও খেই হারিয়ে ফেলছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা সঠিক হয়নি, নাকি ব্যবস্থাটি এখনো আছে সুতরাং থাকা উচিত, কোনটি হবে আলোচনার বিষয়? অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, আদালতের রায় যা-ই বলুক অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই রায়ের যে ব্যাখ্যাই দিন, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুচ্ছেদ ২-খ সংবিধান থেকে বিলীন না করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন। এখন শুধু সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ, বস্তুত তিন-চতুর্থাংশ ভোটে পাস করার আনুষ্ঠানিক কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এ যেন সেই ইংরেজি শব্দ ‘পিলার’ বানান করার গপ্পো। ছাত্র শিক্ষককে জিজ্ঞেস করছে, বানানে একটি নাকি দুটি ‘এল’ হবে। স্যার বললেন, একটিই যথেষ্ট তবে দুটি দিলে পিলারটি মজবুত হবে। এই গল্পটির মাজেজা অনুসরণে বলতে পারি, সুপারিশ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটিকে খামিরা করেছে মাত্র। এখন সংসদে সরকারি দল বিভক্তি ভোট গ্রহণকালে কক্ষ থেকে ‘হ্যাঁ’ দরজা দিয়ে একযোগে বের হলেই পিলারটি আরও পোক্ত হবে। অনুচ্ছেদ ৭০ বজায় থাকতে তাদের অন্যথা করার অধিকার নেই।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা আছে কি নেই নয়, থাকলেও থাকবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের মাঝখানে আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে। প্রথম আলো গ্রন্থাগারে পুরোনো ফাইল ঘেঁটে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৯৫ সালের শেষে আর ছিয়ানব্বইয়ের প্রথমে লেখা আমার প্রতিবেদনগুলো পড়ছিলাম। হিসাব করে দেখেছি, প্রায় ৩০ হাজার শব্দ লিখেছি আওয়ামী লীগের দাবিকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অনেক যুক্তিসম্মত বক্তব্য দিয়েছি। এখন কি নিজের দেওয়া যুক্তিগুলো নিজেকেই খণ্ডাতে হবে? রাজনীতিবিদেরা ভোল পাল্টাতে পারেন, আমরা কি কলম উল্টাতে পারব?
একটুখানি অতীতে যাওয়া যাক। বিএনপির মাগুরা উপনির্বাচনের কেলেঙ্কারির পর দেশের সাধারণ মানুষ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। আমরা সেই জনমতেরই প্রতিফলন ঘটিয়েছি। এখন তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থার বিপক্ষে বলতে হলে জানতে বা বুঝতে হবে, ১৯৯৫ সালের ১৬ বছর পর ২০১১ সালে এসে জনমতের পরিবর্তন ঘটেছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে কোনো জরিপ হয়নি। সেই সময়ে যাঁরা জনগণকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে লাগাতার হরতাল করতে বলেছিলেন, ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’ দাবিতে সোচ্চার করেছিলেন, তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। একইভাবে তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমানের বিরোধী দল এপাশ থেকে ওপাশে ফিরেছে। পঁচানব্বইতে যাদের ‘শিশু ও পাগল’ বলেছিল, তাদের এখন ‘বয়স্ক ও সুস্থ’ বলছে। ষোলো বছর আগে যে ব্যবস্থাটিকে যাঁরা ‘না’ বলেছিলেন, এখন তাঁরা ‘হ্যাঁ’ বলছেন। আগে ‘হ্যাঁ’ বলানোর জন্য যাঁরা জনগণকে লাগাতার আন্দোলনে মাঠে নামিয়েছেন, তাঁরা এখন ‘না’ বলছেন। এখন ‘হ্যাঁ’-বলা জনগণকে দিয়ে ‘না’ বলাতে পারবেন কি না, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দায়টি আদালতের কাঁধে চাপিয়েছিলেন।
আদালতের রায়ের পূর্ণ বিবরণ এখনো পাওয়া যায়নি। যত দূর জানা গেছে তাতে মনে হয়েছে, আদালত পরোক্ষে তাঁদের কাঁধে চাপানো বন্দুকটি আবার সরকারের নীতিনির্ধারকদের তথা সংসদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এ যেন বনভোজনে বালিশ পাচার করার খেলা। তদুপরি তাঁরা একটি প্যাঁচালো পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন। যেমন—একদিকে বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বেআইনি, মানে ২-ক অনুচ্ছেদ, সংবিধানের মূলনীতি গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী। আবার বলছেন, দুবার অগণতান্ত্রিক কাজটি করা যাবে। বলা যায় আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা ক্ষমতায় বহাল থেকে আগামী দুটি নির্বাচন করবেন, কী পন্থায় করবেন, তা নির্ধারণ করবেন। ব্যাখ্যাটি এমন হতে পারে, বিদায়ী গণতান্ত্রিক সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেটের সমাপ্তিতে অগণতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করে আরও ৯০ দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবে। দলীয় সরকারই মেয়াদ শেষে ‘আপনা-আপনি’ নির্দলীয় সরকার অথবা পরোক্ষে তত্ত্বাবধায়ক বনে যাবে। তাই যদি হয়, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন কেন এ রকমটি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন? লগি-বৈঠা দিয়ে তাঁকে তত্ত্বাবধায়কের পদ থেকে হটানো হয়েছিল কেন?
এত সব প্যাঁচালো আলোচনার ইতি ঘটিয়ে ধরে নিচ্ছি, ২-ক পরিচ্ছেদ বিলুপ্ত হয়েছে বা সংসদে বিলুপ্তি হালাল করা হবে। আড়াই বছর পর বর্তমান দলীয় সরকারই মেয়াদ শেষে একধরনের ‘নির্দলীয়’ সরকারের লেবাস পরবে। তার পরও তাঁরা নির্বাচন ‘পরিচালনা’ করবেন না, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শুধু ‘পর্যবেক্ষণ’ করবেন—তর্কের খাতিরে এই আগাম ধারণায় পূর্ণ আস্থা রাখছি। আরও বিশ্বাস করছি, সেই নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব একটি ‘স্বাধীন ও সর্বময় ক্ষমতার’ অধিকারী নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত হবে। তারা সাহসিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করবে। এদিকে আবার প্রশাসনিক ব্যবস্থা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। মানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তারা সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকবে, নির্বাচন পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করবে না। এমনটি বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে না। কারণ, যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সংস্কৃতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা চেয়েছি, ষোলো বছরে সেসবের পরিবর্তন ঘটেছে এমন আলামত দেখতে পাচ্ছি না। আরও কথা আছে, যদি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নয় এই কারণে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা আদালতের মতে সংবিধানবিরোধী ও ‘অগণতান্ত্রিক’ হয়ে থাকে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি সরকারকে অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলা হবে না কেন? ভবিষ্যতে কোনো নাগরিক এই প্রশ্ন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হলে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ অসাংবিধানিক ছিল, তখনকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আদালতের এমন রায়ও হতে পারে বৈকি।
এর পরের ধাঁধা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বিলীন হলে উপদেষ্টার স্থলে যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ক্ষমতায় বহাল থাকবেন, নির্বাচনের সময়ে তাঁদের প্রোটোকল কী হবে? নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা বাস্তবসম্মত হবে কি? সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প যদি হয় বিদায়ী রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা, তবে তাঁদের ক্ষেত্রে কি বিলুপ্ত ২-ক অনুচ্ছেদের ৫৮-গ(৭) উপ-অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে? সেই শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার কাছে এমন প্রত্যাশা করা হবে বাতুলতা। সুতরাং বলা যায়, তাঁরা আগে-পিছে সিপাহি-সান্ত্রি নিয়ে নিজের ও দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামলে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে উত্তপ্ত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করতে হলে আরও একটি বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সঙ্গে অর্থাৎ ২-ক পরিচ্ছেদের সঙ্গে চতুর্থ পরিচ্ছেদটি সম্পৃক্ত রয়েছে। সেই পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে মেয়াদে ৫৮-খ অনুচ্ছেদের অধীনে নির্দলীয় সরকার থাকিবে সেই মেয়াদে, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পরিচালিত হইবে।’ অসাংবিধানিক ঘোষণা করার রায়ে এ সম্পর্কে আদালত কী নির্দেশনা দিয়েছেন, তা জানা যায়নি। সংশোধন কমিটির এতদসম্পর্কীয় সুপারিশ স্বচ্ছ নয়, অন্তত আমার পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। এই প্রশ্নের মীমাংসা না হলে নির্বাচনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েন নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা হবে।
এতক্ষণ এত সব আলোচনা করলাম একটি নিশ্চিত প্রাক-ধারণার ভিত্তিতে। দুর্ভাবনা হচ্ছে, বর্তমানের ক্ষমতাসীন সরকার বর্ধিত সময়কালে কতখানি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে। তাদের ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী স্বল্পকালীন বিএনপি সরকারের অথবা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের স্বল্পকালীন সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভাগ্যবরণ করতে হবে না তো? অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এই প্রশ্নসমূহের উত্তর পাওয়া যাবে। সেই ইতিহাস হচ্ছে, যদি জনগণ মনে করে কোনো ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, দল বা সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চিরায়ত করতেই কোনো দোহাই দিচ্ছে, সংবিধানের নানা রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে অথবা অসাংবিধানিক কৌশল অবলম্বন করছে, তখন তারা আপনা-আপনি ফুঁসে ওঠে, রুখে দাঁড়ায়।
পাদটীকা: এফবিসিসিআই চেয়ারম্যান এ কে আজাদ গত ২৭ এপ্রিল একটি মোক্ষম কথা বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে অর্ধেক ব্যবসায়ী দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে।’ তাঁকে আমার প্রশ্ন, এই অর্ধেক কি সেই সব অসাধু ব্যবসায়ী, যাঁরা সিন্ডিকেট করেছেন, সেসব মজুদদার চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়িয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়েছেন? তাই যদি হয়, কোটি কোটি ভোক্তা অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বহাল রাখা সমর্থন করবে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments