খেলব কই? by পিন্টু রঞ্জন অর্ক

শীত এলেই ক্যাম্পাসে শুরু হয় খেলার ধুম। হলের আঙিনা থেকে খেলার মাঠে চলে হরেক খেলার প্রতিযোগিতা। নানা কারণে ক্যাম্পাসগুলোতে কমে যাচ্ছে খেলাধুলা। ক্যাম্পাসে খেলাধুলার হালহকিকত নিয়ে লিখেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্কক্রীড়াক্ষেত্রে ঢাবি : মুহসীন হলের মাঠে ফুটবল খেলছিলেন কয়েকজন তরুণ। খেলা থামিয়ে এই দলেরই একজন তীর্থ জানালেন, 'সময় পেলেই আমরা খেলতে আসি। মাঝেমধ্যে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে গিয়েও খেলি।' ঢাকা


বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলার তত্ত্বাবধান করে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র। প্রায় দুই একর আয়তনের এ মাঠের এক ভাগে ফুটবল আর অন্য ভাগে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেট খেলা। বিভাগগুলোকে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চল_এই দুই ভাগে ভাগ করে বছরে একবার আয়োজন করা হয় আন্তবিভাগ ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের। এ ছাড়া আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হওয়া সাঁতার ও ওয়াটারপোলো, ভলিবল এবং ক্রিকেট খেলায় অংশ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় টিম। এ মাঠের পরই আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় জগন্নাথ হল মাঠ। এখানে নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করেন ছাত্ররা। জহুরুল হক হল মাঠের ব্যাপারে হলের ছাত্র আতিক বলেন, 'সংস্কারের অভাবে খেলার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ইনজুরির ভয়ে এ মাঠে খেলতে সাহস হয় না আমাদের।' ভবন সম্প্রসারণের ফলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এসএম হলের মাঠ। এফ রহমান হল, সূর্য সেন হল, জিয়াউর রহমান হল, বঙ্গবন্ধু হল এবং কবি জসীমউদ্দীন হলের কোনো মাঠই নেই। মওলানা ভাসানী হল নামে নতুন একটি হল নির্মিত হচ্ছে সূর্য সেন হল এবং জিয়াউর রহমান হলের মাঝামাঝি জায়গায়। এ হলের ছাত্ররাও পাবেন না মাঠের সুবিধা। কবি জসীমউদ্দীন হলের ছাত্র রাশেদ, মামুন, জনি, সৌরভরা আড্ডা দিচ্ছিলেন হলের সামনে। খেলাধুলা করেন কি না জানতে চাইলে বলেন, 'মাঠ নেই, খেলব কোথায়?'
ইনডোর গেইমসে নেই আর নেই : জগন্নাথ হলে আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার ছাত্রের বাস। অথচ তাঁদের জন্য গেইমস রুম রয়েছে মাত্র একটি। সেখানে প্রায় তিন হাজার ছাত্রের খেলার জন্য রয়েছে দুটি করে টেবিল টেনিস বোর্ড ও ক্যারম বোর্ড। 'ইচ্ছা করলেও এখানে খেলার সুযোগ পাই না'_জানান হলের বাসিন্দা রাজেশ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সব হলের চিত্র মোটামুটি একই রকম। পর্যাপ্ত সামগ্রীর অভাবে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা। 'আগে গেইমস রুমে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও খেলার সুযোগ পেতাম না। বিফল মনোরথে ফিরে আসতে হতো। তাই এখন আর যাই না সেখানে', বলছিলেন মুহসীন হলের ছাত্র আবদুল আহাদ।
ছাত্রীদের অংশগ্রহণ কম : 'মোটেও আগ্রহী ছিলাম না, বান্ধবীরা এবং ম্যাডাম একরকম জোর করেই মাঠে নামিয়ে দিলেন', বলছিলেন শামসুন নাহার হলের ছাত্রী দীপ্তি। তাঁর মতো বেশির ভাগ মেয়েই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা কারণে খেলাধুলায় আগ্রহী নন। মেয়েরা মূলত অ্যাথলেটিকস, সাঁতার এবং ভলিবল খেলায় অংশগ্রহণ করেন। খেলোয়াড় সংকটের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই মেয়েদের কোনো ফুটবল কিংবা ক্রিকেট টিম। ছাত্রীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে করা হয় না কোনো কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম।
খেলোয়াড়দের চাওয়া-পাওয়া : বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হয়ে খেলে ঢাকার মধ্যে ১৩০ এবং ঢাকার বাইরে হলে ১৫০ টাকা হারে দৈনিক ভাতা পান একেকজন খেলোয়াড়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সময় প্রদান করা হয় দৈনিক জনপ্রতি ৭৫ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় দেবব্রত দাস বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অনেক সময় ঢাকার বাইরে যেতে হয়। কিন্তু যে ভাতা দেওয়া হয় তাতে মোটেও পোষায় না।' আন্তহল পর্যায়ে খেলে একটি মেডেল কিংবা ক্রেস্ট ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই পাই না আমরা_জানালেন জগন্নাথ হলের ছাত্র আশিস। বিশেষজ্ঞ কোচ ছাড়াই ট্রেনার দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জিমনাস্টিক, ফুটবল, ক্রিকেটসহ অনেক খেলা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলতে গিয়ে ইনজুরির শিকার হলে তাঁর চিকিৎসার দায়ভার গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, ঢিলেঢালাভাবেই চলে চিকিৎসাসেবা। বাংলার ছাত্র মহিব বলেন, 'প্রতিবছর আমাদের কাছ থেকে খেলাধুলা খাতে মোটা অঙ্কের ফি আদায় করা হলেও সে তুলনায় সুযোগ-সুবিধা দেয় না কর্তৃপক্ষ।'
পরিচালক বললেন : খেলাধুলার সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালক শওকতুর রহমান জানান, 'অপ্রতুল বাজেট, ডাকসু অচল থাকার কারণে আন্তহল ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা চালু করতে পারছি না। আরো একটা জিমনেসিয়ামও দরকার।' খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক কম, এ বিষয়ে একমত পোষণ করে তিনি বলেন, 'বাজেটে ক্রীড়া খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। তখন খুব দ্রুত মাঠগুলো সংস্কার করা হবে।'
বাজেট বাড়ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
সারা বছরই এই ক্যাম্পাসে কোনো না কোনো খেলা লেগেই থাকে। ইনডোর গেইমস হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা হরহামেশাই খেলেন টেবিল টেনিস, কার্ড, ক্যারম আর দাবা। সারা বছরই ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল কিংবা বাস্কেটবল খেলা হয় আন্তবিভাগ ও আন্তহল পর্যায়ে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আল আমীন অভিযোগ করে বলেন, 'কম বাজেট, খেলাধুলার নিম্নমানের সরঞ্জাম এবং ড্রেসিং রুমের অভাবে মাঠে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।' বিভাগের খেলাধুলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবহেলা এবং মাঠে ইন্সট্রাক্টরের অনুপস্থিতির কথা জানালেন বাংলার নাসির। এসব ব্যাপারে শারীরিক শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সিফাতুল্লাহ জানান, 'খেলার মাঠে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসতে এ বছর থেকে খেলাধুলার জন্য বাজেট এবং খেলোয়াড়দের প্রাইজমানি বৃদ্ধি করা হচ্ছে।' আগামী বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের চারদিকে স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু আছে কোটায় ছাত্রছাত্রী ভর্তি। খেলাধুলায় সাফল্যের স্বাক্ষরও রাখছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় টেনিস ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় (ছাত্রী) এই বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন এবং অ্যাথলেটিকস, ফুটবল ও হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় হয়েছে রানারসআপ। জাতীয় ভলিবল প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দল তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে এবং সেরা সুশৃঙ্খল দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারটি স্বর্ণ, ১০টি রৌপ্য ও পাঁচটি তাম্রপদক অর্জন করেছে। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ওয়াটার পোলো খেলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭, ২০০৮ এবং ২০১০ সালে হ্যাটট্রিক শিরোপা অর্জন করেছে। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় হ্যান্ডবল দলের অন্যতম সদস্য রনি দত্ত যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক রাশেদ বিন আমিন চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছরই আন্তহল খেলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঠের অভাব
সারা বছরই নানা আয়োজনে মেতে থাকে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) স্পোর্টস ক্লাব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে খেলাধুলাবিষয়ক চারটি ক্লাব_ফুটবল ক্লাব, ক্রিকেট ক্লাব, ইনডোর গেইমস ক্লাব ও উইমেন স্পোর্টস ক্লাব-পিরিকন। কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী প্রেমা জানান, সাভার ক্যাম্পাসেই খোলা মাঠ পেয়েছি। মাত্র এক সেমিস্টারেই আমরা প্রাণখুলে খেলাধুলার সুযোগ পাই।' মাঠের অভাবে নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছেন না নর্থ সাউথ স্পোর্টস ক্লাবের ছেলেমেয়েরা। প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই এ সমস্যা প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থায়ী ক্যাম্পাসে এলেও মেলেনি মাঠ। এদিক থেকে ভাগ্যবান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) ছাত্রছাত্রীরা। স্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশাল মাঠ রয়েছে। সেমিস্টারভিত্তিক ইউল্যাব ফেয়ার প্লে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ইউল্যাব প্রিমিয়ার লীগ (ফুটবল) ইনডোর গেইমস টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।
তথ্য সহায়তা : কাজী শামীম হাসান, জয়ন্ত ও সৈকত

No comments

Powered by Blogger.