পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি-বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হবে। শেষ হতে সময় লাগবে পাঁচ বছরের মতো। এতে খরচ পড়বে দেড় থেকে দুই শ কোটি মার্কিন ডলার এবং এর পুরোটাই রাষ্ট্রীয় ঋণ হিসেবে জোগান দেবে রাশিয়া। অর্থায়নের ব্যাপারে শিগগিরই আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সরকারিভাবে সাত হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সেখানে আমাদের গড়পড়তা উৎপাদন হচ্ছে মাত্র চার হাজার মেগাওয়াট। এই বিশাল ঘাটতির কারণে জনজীবনে কতটা ভোগান্তি হচ্ছে, তা আমরা গত গ্রীষ্মে অনেকটাই অনুভব করেছি। বিদ্যুৎ ঘাটতি জনভোগান্তির চেয়েও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে দেশের শিল্প ও কল-কারখানার বিকাশে। বিদ্যমান কল-কারখানাগুলোরও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। এই বিশাল ঘাটতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের আবাসন শিল্প। বিদ্যুতের অভাবে নতুন তৈরি বহু বাড়িঘরে মানুষ উঠতে পারছে না। বাড়িঘরে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সোলার প্যানেল বসানোর ব্যয়বহুল ও বাধ্যতামূলক বিধান অনেকের জন্যই মান্য করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমান সরকার সাময়িক চাহিদা মেটানোর কৌশল হিসেবে ছোট ছোট রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন স্থাপনকালেও সেগুলোর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি, প্রতি ইউনিট প্রায় ১২ টাকা। অথচ আবাসিক গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয় গড়পড়তা তিন টাকা ইউনিট। এখানে যেমন সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে, তেমনি এ কেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানি করতে গিয়েও বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বড় যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ, প্রায় সময়ই জরাজীর্ণ এসব কেন্দ্রের এক বা একাধিক ইউনিট বন্ধ থাকে। এ অবস্থায় আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ছোট ছোট কেন্দ্র নয়, বড় ও নিয়মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রই আমাদের নির্মাণ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কোন ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেব।
এটা সত্য, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। বিশেষ করে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয়ের পর থেকে এ উদ্বেগ আরো বেড়েছে। খুলনায় এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে প্রস্তাব উঠেছে, তা নিয়েও অনেকে বিরোধিতা করছেন। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। আবার জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি খরচ এত বেশি যে, তা আমাদের পোষাবে না। জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারও খুবই অস্থির। আমাদের গ্যাসও এখন পর্যন্ত এতটা পর্যাপ্ত নয় যে গ্যাসভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দিকে আমরা এগোব। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাহিদা মিটিয়ে গৃহস্থালি-প্রয়োজনে গ্যাসসংযোগ দেওয়া নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থান জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্যও খুব একটা উপযোগী নয়। সেসব দিক বিবেচনা করে অনেকেই মনে করেন, বেশি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনই আমাদের ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর প্রধান উপায় হওয়া উচিত। এর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও অনেক কম। নতুন যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক জোরদার। জাপানের ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ছিল চার দশক আগের নকশা অনুযায়ী নির্মিত। তার ওপর সেখানে আট মাত্রার ভূমিকম্প ও সুনামির একত্রে আঘাত না ঘটলে এমন বিপর্যয়কর অবস্থা হতো না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের কোনো একটি বিকল্পকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে হবে।
No comments