কায়সার জামান অ্যাডভোকেট-আগামী দশকে এশিয়ার বিশুদ্ধ পানি সংকট

পানি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সসীম ও অপরিবর্তনীয় একটি উৎস, যা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। পানি শস্য উৎপাদনে, স্বাস্থ্যরক্ষায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সহায়ক এবং প্রতিবেশ ও প্রাচুর্য রক্ষা করে। জীবনরক্ষায়, জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পানির ভূমিকা কী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জল বা স্থল ব্যবহারকারী একটি প্রাণী বোঝে, পানিতে যদি সে ডিম ছাড়তে না পারে, তাহলে আর নতুন প্রাণের জন্ম হবে না।


উড়ে বেড়ানো পোকা বা মাছিরা জানে বিশুদ্ধ পানি ডিম ছাড়ার জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। একমাত্র মানুষ নামক প্রাণীটি, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো বোধ হয় এর গুরুত্ব বুঝতে পারে না। পানি আমাদের জীবনে এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
এশিয়ার বহু দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাই মানুষের টিকে থাকার সবচেয়ে বড় উৎস পানির ব্যাপারে এখনই সজাগ হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, চাহিদার ধরন পরিবর্তন, শিল্পায়ন, পানিদূষণ, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী এক দশকে এশিয়া পানির ভয়ানক সংকটে পড়বে। হ্রদগুলো হারিয়ে যাওয়া, নদী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে সামরিক সংঘাতের হুমকি_সব মিলিয়ে পানি এখন বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাপানে অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়া প্যাসিফিক ওয়াটার সামিটে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, 'পানির সংকট অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যুদ্ধ ও সংঘাতের মূল কারণ হয়ে পড়ছে।' দি ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ বলছে, মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতা দ্রুত কমে আসছে, বিশেষ করে নদীগুলোর বড় বড় অববাহিকা ফুরিয়ে আসছে। এশিয়াবিষয়ক ভাষ্যকার অ্যান্ডি মুখার্জি বলেছেন, এশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতিতে যে বস্তুটি সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা তেল নয়, পানি। ২০০৮ সালে ইউএস ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল গ্লোবাল ট্রেন্ড-২০২৫-এর প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশের পানি সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ায় যেভাবে পানি দুর্মূল্য হয়ে উঠছে, তাতে দেশগুলোর মধ্যে পানির উৎস নিয়ে সহযোগিতা কঠিন হয়ে পড়বে।
গোটা এশিয়ায় ভূমি হ্রাস পাওয়ার কারণে সংকট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাদ্যনিরাপত্তা সম্ভবত চীন ও ভারতের জন্য সবচেয়ে তীব্র হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের কনভেনশন টু কমব্যাট ডিজার্টিফিকেশন হিসাব করেছে, চীনের ২৭ শতাংশ ভূমি মরুভূমির রূপ নিয়েছে। চীনে প্রতিবছর গ্রাস করে নেওয়া মরুভূমি হয়ে উঠছে দুই হাজার ৪৬০ বর্গমাইল এলাকা। প্রায় ৪০ কোটি মানুষ চীনের এ এলাকায় বাস করে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। মরু হয়ে যাওয়ার কারণে এশিয়ার অন্যান্য দেশেরও প্রায় একই অবস্থা। আফগানিস্তানের কৃষি, পানি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশটির ৪০ শতাংশ বন কেটে ফেলা হয়েছে। অথচ ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ ও মরু হয়ে ওঠা একটি গভীর সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন উজাড় করার ফলে হিমালয়ের অধোমৃত্তিকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির স্রোতোধারা ফুরিয়ে আসছে। এই বনগুলো মূলত শেষ করে ফেলছে কাঠের মাফিয়ারা। দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিষাক্ত-বর্জ্য পানিতে দূষিত হয়ে উঠছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা এবং পাকিস্তানের করাচি শহরের পানি। এসব শহরের বর্জ্য পানি ফেলা হচ্ছে শহরের পাশের নদী, লেক ও সমুদ্র উপকূলে। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে দূষিত হয়ে পড়ছে সব পানির উৎস এবং স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত সমস্যাও তীব্র হয়ে উঠছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পানির সুব্যবস্থার অভাব দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, পরিবেশক্ষয় ও মানুষে-মানুষে সংঘাতের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এশিয়ায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ অব্যাহত রয়েছে, যে কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় পানির উৎস দিন দিন অপ্রতুল হয়ে পড়ছে।
শুধু রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রই নয়, পানিপ্রবাহ ইস্যু নিয়ে প্রদেশ থেকে প্রদেশের পর্যন্ত কোনো সুরাহা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত আকারে বড় হওয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে অভিন্ন নদী নিয়ে বিতর্ক-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। নদীর উৎসস্থলের দিকের দেশ হওয়ায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অবিশ্বাসের পরিবেশ জন্ম হয়েছে, যা সিরিয়াস ইস্যু হিসেবে সমাধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
তবে পানির ভাগাভাগি নিয়ে উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বেশ আশা-জাগানো চুক্তি করে সমস্যা সমাধানের একটি প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানিচুক্তি হয়েছে, যেখানে পূর্বের তিনটি নদী (ইরাবতী, শতদ্রু ও বিপাশা) এবং পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদীর (সিন্ধু, ঝিলাম ও চন্দ্রভাগা) পানি ভাগ করা হয়। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উত্থান-পতন এবং যুদ্ধের পরও ঝিলাম নদীর চুক্তি টিকে গেছে। দুই পক্ষই চুক্তির শর্ত মেনে চলেছে। যদিও ঝিলাম ও চন্দ্রভাগা নদীর ওপর নেওয়া ভারতের দুটি প্রকল্পের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। একইভাবে গঙ্গা নদীর পানি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানিপ্রবাহ দেওয়ার ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। নেপাল ও ভারতের মধ্যেও ১৯৯৬ সালে মহাকালী চুক্তি স্বাক্ষরেত হয়েছে। কিন্তু পার্লামেন্টের অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও এ চুক্তি অচল হয়ে আছে।
এসব চুক্তির পরও পানি ভাগাভাগি, পানি ব্যবস্থাপনা এবং পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রশ্নে একদিকে ভারত, অন্যদিকে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
লেখক : পাকিস্তানের গবেষক, কলামিস্ট। পাকিস্তানের দ্য নেশন থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.