চরাচর-মাঘী পূর্ণিমার দিঘি

রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর। যদিও হালে দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে নামকরণ করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলা, তথাপিও মানুষের অন্তরে গেঁথে রয়েছে 'বিক্রমপুর' নামটি। বিক্রমপুর বলতে মানুষ যেমন স্বাছন্দ্যবোধ করে, তেমনি নামটি নিয়ে গর্ববোধও করে অনেকে। তাই তো গুণীজনরা দাবি তুলেছেন জেলাটির নামের সঙ্গে অন্তত যেন বিক্রমপুর নামটি জুড়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জ-


বিক্রমপুর নামে নামকরণের প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। যুক্তিসংগত কারণ আছে অবশ্য। তন্মধ্যে প্রধান কারণটি হচ্ছে_'ইতিহাস কথা বলে বিক্রমপুরের, মুন্সীগঞ্জের সঙ্গে নয়'। কাজেই মন হরণকারী নামটি নিয়েই ইতিহাসের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা শ্রেয়। ইতিহাসটি একটি দিঘি নিয়ে। এটি খনন করেছেন তৎকালীন রাজা 'হরিশ্চন্দ্র'। তিনি শুধু শাসক রাজাই ছিলেন না, ছিলেন দয়ালুও। রাজা হরিশ্চন্দ্রের দয়া-দাক্ষিণ্যের মাত্রা এতই ছাড়িয়ে গেছে যে বলতে হয় বাংলার ইতিহাসে অমন দ্বিতীয় রাজা আর আসেননি। তাঁর দয়ার ভাণ্ডার এত প্রসারিত ছিল যে তিনি নাকি রাজ্য পর্যন্ত দান করে দিয়েছেন (যদিও ঘটনাটির সত্যতা মেলেনি, তথাপিও এ থেকে প্রতীয়মান হয় তাঁর দয়ার অসীমতা)। রাজা হরিশ্চন্দ্র প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। যখন জানতেন প্রজারা কোনো সমস্যায় পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধান করে দিতেন। তদ্রূপ রাজা একবার জানতে পেরেছেন তাঁর রাজ্যের 'রামপাল' নামক স্থানের প্রজারা প্রচুর জলকষ্টে ভুগছে। দেরি না করে প্রজাদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তিনি ওখানে একটি বিশাল দিঘি খনন করে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর ওই দিঘিটি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়ে যায়। এর ইতিহাস অন্য দশটি দিঘির মতো নয়। রীতিমতো ভড়কে দেওয়ার মতো ইতিহাস রয়েছে। ঘটনাটা জানান দেওয়ার আগে এর নামদাম জানিয়ে দেওয়া উচিত। এর বর্তমান নাম হচ্ছে 'মাঘী পূর্ণিমার দিঘি'। কিংবদন্তি রয়েছে, দিঘিটি বছরের বারো মাসই প্রায় জলশূন্য থাকত। অল্প পরিমাণে জল থাকলেও এর ওপর ভাসত লতাপাতার বড় বড় দাম। যার ওপর দিয়ে লোকজন অনায়াসে হাঁটাচলা করত। শুধু তাই-ই নয়, গবাদিপশুও অবাধে বিচরণ করত। এ শুষ্কপ্রায় দিঘিটি বছরে একবার তেজস্বী রূপ ধারণ করত। ঠিক যে রাতে মাঘী পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যেত সে রাতে ধীরে ধীরে দিঘিটি জলে টইটম্বুর হয়ে যেত। পরের দিন আবার জলশূন্য হয়ে পড়ত। অলৌকিক এ দৃশ্যটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে তখন লোকজন এসে ভিড় জমাত। এমনকি মেলাও বসত ওই রাতে ওখানে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন আবার মানতও করত। সেই মানত আদায়ে কারো মনোবাসনা পূর্ণ হতো কি না, তা অজানা। দিঘিটির বর্তমান অবস্থা করুণ। সোজা কথায় এটি এখন আর সেই রাজা হরিশ্চন্দ্রের দিঘি নেই, সংস্কারের অভাবে ছোট্ট পুকুরে পরিণত হয়েছে। যদিও সর্বশেষ ১৯৮০ সালে সরকারিভাবে একবার খনন করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। বেহালদশার এ দিঘিটির পাড়ে বর্তমানে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে। তাতে লেখা আছে, 'এ পুরাকীর্তিটি জাতীয় জাদুঘরের অধীনে সংরক্ষিত'। এ ছাড়া উন্নয়নমূলক আর কোনো কর্মকাণ্ডের বালাই নজরে পড়ছে না। বরং দিঘিটির চারপাশ ঘিরে স্থানীয়দের নানা রকম দখলদারি নজরে পড়ছে, যা বিক্রমপুরের ইতিহাসের জন্য বিরাট হুমকি বলা যায়।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.