রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র-স্বপ্নযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক

পাকিস্তান আমলে ষাটের দশক থেকেই পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শুরু। এ জন্য বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। এর প্রায় পাঁচ দশক পর বুধবার ঢাকায় রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে এ লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রান্ত হলো। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পরমাণু করপোরেশনের প্রধান সের্গেই ভি কিরিয়েনকো।


বলা যায়, রুশ কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দৃঢ়পণ তার প্রমাণ রেখেছে এ ধরনের প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আনুমানিক ব্যয় হবে দেড়শ' থেকে দুইশ' কোটি ডলার (বাংলাদেশের মুদ্রায় ১১ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো), যার জোগান দেওয়া হবে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। প্রকল্পের আয়ুষ্কাল ৪০ বছর এবং পুরো সময়জুড়েই রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ করবে আর সবচেয়ে বিপজ্জনক বর্জ্য বা স্পেন্ট ফুয়েল নিজ দেশে নিয়ে যাবে। প্রকল্পের মানবসম্পদ উন্নয়নেও মিলবে তাদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সহায়তা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে রাশিয়ার পূর্বসূরি দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য সহায়তা ছিল এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সেটা হবে এ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। দু'পক্ষের সম্পাদিত চুক্তিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিষয়ে যে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ, তা দূর করার জন্য চুক্তিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের উল্লেখ রয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সামরিক হামলা এবং ভূমিকম্প ও সুনামিসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কারিগরি ত্রুটির মতো ইস্যু তো রয়েছেই। জাপানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পারমাণবিক বিকিরণের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখেই এর নকশা প্রণয়ন করা হবে, সেটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। বাংলাদেশের তরফে এ বিষয়টি তদারকির ভার যাদের ওপর ন্যস্ত করা হবে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা হওয়া চাই প্রশ্নাতীত। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নেওয়া চাই। জনমনে নিরাপত্তা বিষয়ে ব্যাপক ভীতি রয়েছে এবং তা দূর না করে বাস্তব কাজে অগ্রসর হওয়া কঠিন হবে। ব্যয়বহুল এবং একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রকল্পের ঋণের অর্থ ব্যবহারের বিষয়েও চাই সর্বোচ্চ সতর্কতা। এ প্রকল্প থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হলে দেশের প্রকট বিদ্যুৎ সংকট বহুলাংশে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকল্পটি যেন কোনোভাবেই অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে না ওঠে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে স্থাপিত কয়েকটি অর্থনৈতিক প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। কাফকো ও চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার প্রকল্প এবং বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির বিষয়টি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বহুল প্রত্যাশিত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের এমন পরিণতি কাম্য নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের কেবল একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে। নির্মাণ কাজ শুরুর আগে প্রকল্প স্থল ও আশপাশের জনগণের মতামত গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের প্রকল্পের ঝুঁকি ও সুবিধা সম্পর্কে তাদের ভালোভাবে অবগত করতে হবে। পুনর্বাসনের প্রশ্নও সামনে আসবে। এসব কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হোক, এটাই কাম্য।
 

No comments

Powered by Blogger.