'আমরা সবাই বোলার'

কোনো ইনিংসে দলের ১১ জন ক্রিকেটারই বল করেছেন_টেস্ট ক্রিকেটে এমন ঘটনা বিরল। তবে ১০ জন বল করার সাধ মিটিয়েছেন একবার দুবার নয়, ১৪ বার! অথচ কদিন আগে ইংল্যান্ড সফরে ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি উইকেটকিপিং গ্লাভস খুলে বল করতে শুরু করায় কপিল দেবের মতো ক্রিকেটারও কী সমালোচনাটাই না করলেন! ধোনি বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন জহির খানরা ইনজুরিতে পড়ায়।


আমাদের আজকের আয়োজনে ১০ বা ১১ জনের বল করার যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে সেখানে 'আমরা সবাই বোলার' হওয়ার কারণ অবশ্য অন্য রকম ছিল।
ব্যাটসম্যান ব্যাটিং করে চলেছেন মনের আনন্দে। ইনিংস ঘোষণা করার আইনটা ১৮৮৯ সালের আগে ছিল না বলে অল আউট না হওয়া পর্যন্ত ব্যাট করতে হতোই তাঁদের। অনেক সময় তাই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন বোলাররা। ১৮৮৪ সালের ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ওভাল টেস্টটাই যেমন। তিন দিনের টেস্টের প্রথম দিন শেষে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ২ উইকেটে ৩৬৩। দ্বিতীয় দিন প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটিও করে ফেলেন বিলি মারডক। ডাবল সেঞ্চুরির পথে তৃতীয় উইকেটে জেমস হারবার্ট স্কটের সঙ্গে গড়েন ২০৭ রানের জুটি। কোনোভাবেই জুটিটা ভাঙছিল না বলে ইংলিশ অধিনায়ক লর্ড হ্যারিস ঘুরিয়েফিরিয়ে বল করিয়ে ফেলেন দলের ১১ জনকে দিয়েই! ইতিহাসটা গড়া হয় তাতেই। টেস্ট ইতিহাসের ১৬তম সেই ম্যাচে প্রথমবার বোলিং করেন কোনো দলের ১১ ক্রিকেটার।
১১ জনের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন আবার উইকেটরক্ষক আলফ্রেড লাইটেলটন! ১২ ওভারে ৫ মেডেনসহ ১৯ রান দিয়ে সর্বোচ্চ ৪ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। এরপর আরো তিনটি টেস্ট খেললেও অবশ্য আর বোলিং করেননি লাইটেলটন। সেই টেস্টে ৩১১ ওভারে অস্ট্রেলিয়া অল আউট হয় ৫৫১ করে। মারডক করেছিলেন সর্বোচ্চ ২১১ রান। জবাবে ইংল্যান্ড ৩৪৬ রান করে ফলোঅনে পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে ২ উইকেটে ৮৫ করার পর ড্র হয়ে যায় টেস্টটি।
বিরল সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে কেটে যায় প্রায় ১০০ বছর। ১৯৮০ সালে পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়ার ফয়সালাবাদ টেস্টের প্রথম দিন ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। দ্বিতীয় দিনের খেলাও শুরু হতে দেরি হয় ৬৫ মিনিট। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ম্যাচ শুরু হলে ২১ রানেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। তবে সকালের সূর্য দেখে সব সময় দিনটা অনুমান করা যায় না। অস্ট্রেলিয়াও শুরুর ধাক্কাটা কাটিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলের ২৩৫ ও গ্রাহাম ইয়ালপের ১৭২-এর ওপর ভর করে করে ফেলে ৬১৭ রান। পাকিস্তানের মাটিতে সেবারই কোনো সফরকারী দল করে ৬০০-এর বেশি রান। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া অল আউট হতে হতে গড়িয়ে গিয়েছিল চতুর্থ দিনের লাঞ্চও। নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে টেস্টের পরিণতি লেখা হয়ে গিয়েছিল তাতেই। তাই হয়তো বোলারদের বিশ্রাম দিতে ১১ ক্রিকেটারকে দিয়েই বল করান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল। উইকেটরক্ষক রড মার্শও করেছিলেন ১০ ওভার। ১১ জন মিলেও অবশ্য উইকেট নিতে পারেননি ১টির বেশি! ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্ট খেলা তসলিম আরিফের অপরাজিত ২১০-এ পাকিস্তান ২ উইকেটে ৩৮২ করলে ড্র হয়ে যায় ম্যাচটি। ওপেনার হারুন রশিদকে এলবিডাবি্লউ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার জিওফ ডিমক আর জহির আব্বাস হয়েছিলেন রান আউট।
ফয়সালাবাদ টেস্টের পর ১১ ক্রিকেটারের বল করার ঘটনা ঘটেছে আরো দুবার। দুটোই ব্যাটিং উদ্যান অ্যান্টিগার সেন্ট জোন্সে। ২০০২ সালে ভারত আর ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ ক্রিকেটার বল করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ড্র হওয়া ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচটিতে এক ইনিংস করে ব্যাট করতে পেরেছিল দুই দল। ভারত ৯ উইকেটে ৫১৩ করে ইনিংস ঘোষণা করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজও পঞ্চম দিন চা বিরতির পর ইনিংস ঘোষণা করে ৯ উইকেটে ৬২৯-এ। এরপর আর দ্বিতীয় ইনিংস ব্যাট করার দরকার মনে করেননি দুই দলের অধিনায়ক। সেই টেস্টেই প্রথমবারের মতো সেঞ্চুরি পান দুই দলের দুই উইকেটরক্ষক। নিশ্চিত ড্র হতে যাওয়া টেস্টটিতে ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী বোলিং করার সুযোগ দেন সবাইকে। তা ছাড়া অনিল কুম্বলে মাথায় আঘাত পেয়ে বসায় পার্টটাইম বোলার ব্যবহার করা ছাড়া উপায়ও ছিল না সৌরভের। তাঁরা খুব বেশি হতাশ করেননি সৌরভকে। ভিভিএস লক্ষ্মণ ১৭ ওভারে ৩২ রানে নেন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট উইকেট। ক্যারিয়ারের দুটি টেস্ট উইকেটের অপরটি লক্ষ্মণ পান ২০০৭ সালে ইডেনে পাকিস্তানের বিপক্ষে। অ্যান্টিগায় ওপেনার ওয়াসিম জাফর ১১ ওভারে ১৮ রানে ২টি, শচীন টেন্ডুলকার ৩৪ ওভারে ১০৭ রানে ২টি, রাহুল দ্রাবিড় ৯ ওভারে ১৮ রানে নেন ১ উইকেট। উইকেটরক্ষক অজয় রাত্রা ১ ওভার বল করে ১ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটহীন।
২০০৫ সালে সেই অ্যান্টিগা টেস্টে বল করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ১১ জন। প্রোটিয়াদের ৫৮৮ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৭৪৭। ম্যাচটা ড্র হতে যাচ্ছে দেখে গ্রায়েম স্মিথ বল করতে দেন সবাইকে। উইকেটরক্ষক মার্ক বাউচার ৮ বল করে ৬ রানে নিয়েছিলেন সেঞ্চুরিয়ান ডোয়াইন ব্রাভোর উইকেটটি। ক্যারিয়ারের ১৪১ টেস্টে সেই একবারই হাত ঘুরিয়েছেন বাউচার। ওয়ানডেতে প্রায়ই উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়ানো এবি ডি ভিলিয়ার্স সেই ম্যাচে ২১ ওভারে ৪৯ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। সবচেয়ে বেশি ৪৩ ওভার বল করেছিলেন অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ নিজেই! ২টি উইকেটও নিয়েছিলেন অফস্পিন বল করে।
টেস্ট ইতিহাসে কোনো দলের ১০ জন ক্রিকেটারের বোলিং করার নজির আছে ১৪ বার। এ ১৪টি টেস্টই ড্র হয়েছে। আর ম্যাচের পরিণতি আগেভাগে বুঝতে পেরে অধিনায়করা বিশ্রাম দিতে চেয়েছেন দলের মূল বোলারদের। ১০ জনের মধ্যে বোলিং করার ঘটনা প্রথমবার ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইডেন টেস্টে। জয়ের জন্য ৪৩১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ দিন শেষে বিনা উইকেটে ভারত করেছিল ৬৬। পঞ্চম দিনে লালা অমরনাথের দল ৩ উইকেটে ৩২৫ করার পর ড্র মেনে নেয় দুই দল। ম্যাচটা ড্র হতে যাচ্ছে দেখে ১০ বোলার ব্যবহার করেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক স্যার ক্লাইড ওয়ালকট। বল করেছিলেন উইকেটরক্ষক জন গডার্ডও। ২৩ ওভারে ১১টি মেডেনসহ ৪১ রানে ১ উইকেট নেন তিনি।
সর্বশেষ ২০০০ সালের নভেম্বরে নাগপুর টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ড্র হওয়া ম্যাচটিতে ১০ জন বোলার ব্যবহার করেছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। ভারতের ৬০৯ রানের জবাবে ৩৮২ রানে গুটিয়ে গিয়ে ফলোঅনে পড়েছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ডাবল সেঞ্চুরিতে নিশ্চিত হয়ে যায় ড্র হতে যাচ্ছে ম্যাচটি। তাই উইকেটরক্ষক বিজয় দাইয়াকে ছাড়া সবার হাতেই বল তুলে দেন সৌরভ। জিম্বাবুয়ে ৬ উইকেটে ৫০৩ করলে ড্র হয়ে যায় ম্যাচটি। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ২৩২ রানে অপরাজিত থেকে গড়েন কোনো উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড। পরে শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারা অবশ্য ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৮৭ রানের ইনিংস খেলে ভেঙে দেন সেই রেকর্ড।
১৯৮২ সালে চেন্নাইয়ে নিশ্চিত ড্র হতে যাওয়া টেস্টটিতে বল করেছিলেন ইংল্যান্ডের ১০ জন। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেটরক্ষক বব টেলর ২ ওভার হাত ঘোরালেও বল করেননি কেবল প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ৩১ ওভার করা মিডিয়াম পেসার পল অ্যালট। ১৯৮০ সালে লাহোর টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ড্র হওয়া ম্যাচটির চতুর্থ ইনিংসে পাকিস্তানের উইকেটরক্ষক তসলিম আরিফ ৫ ওভারে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। ইনিংসটিতে বল করেননি কেবল আজমত রানা। প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে অবশ্য ১৭৮ বলে ১ উইকেট নেওয়ার 'কীর্তি' আছে রানার। ক্রিকইনফো
১১-১০ জন বল করা টেস্ট

No comments

Powered by Blogger.