চরাচর-গানপাগল প্রতিবন্ধী বিশ্বেশ্বর

মা আমায় ঘুরাবি কতো, কলুর চোখঢাকা বলদের মতো...। একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো।' হয়তো এই গানের সঙ্গেই তিনি তাঁর জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছেন। পেয়েছেন নিজের বাস্তবতা। তাই তো যখনই কোথাও গান গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, ভক্তদের তিনি গানটি গেয়ে শোনাচ্ছেন। নাম তাঁর বিশ্বেশ্বর রাজবংশী। জন্ম থেকেই অন্ধ। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি।


থাকেন চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল উপজেলার সোনাছড়া চা বাগানে। চা শ্রমিকের সন্তান হওয়ায় চা বাগানেই জন্ম তাঁর। জন্মান্ধ বলে তাঁর ভাগ্যে আর চা শ্রমিকের চাকরি জোটেনি। তাই জীবনের প্রয়োজনে সেই সাত-আট বছর বয়সেই লেগে যান ভিক্ষাবৃত্তিতে। সেই থেকেই পেশায় ভিক্ষুক হলেও গান শোনা বা গাওয়া তাঁর শখ। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি অসম্ভব দুর্বলতা। যেখানেই গানের আসর হতো, সেখানেই ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। সারা রাত গান শুনে ভোরে বাড়ি ফিরতেন। তখন তাঁকে নিয়ে অনেকেই উপহাস করত। তাতে কী! গান যার রক্তে মিশে যায়, তাকে কি আর উপহাস করে ফেরানো যায়? সারা রাতের ঘুমহীন রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে পরদিন বেরিয়ে পড়েন ভিক্ষা করতে। রাস্তায় হেঁটে হেঁটে গুনগুন করে গাইতেন রাত জেগে শোনা গানগুলো। কখনো কোনো দোকানি দোকানের বারান্দায় বসিয়ে তাঁকে দিয়ে গান গাওয়াতেন। তখন পথচারীরা খুব আগ্রহ নিয়েই শুনতে থাকে তাঁর গান। গান শুনে ভিক্ষার সঙ্গে বাড়তি আরো ১০-২০ টাকা গুঁজে দেন তাঁর হাতে। তিনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তা গ্রহণ করেন। মানুষের ভালোবাসার উপহার গান গেয়ে জীবনের ঝুলিতে কিছু কুড়াতে না পারলেও তৃপ্তি দিয়ে যাচ্ছেন ভক্তদের মনে, এটাই তাঁর বড় পাওনা। একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর গান শোনেন শ্রীমঙ্গল থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল আচার্য্য। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেন, তোমার গানের কণ্ঠ তো মধুর মতো মিষ্টি, তুমি চাইলে তোমাকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব। গানপাগল এই লোকটিকে তিনি কালীপূজার রাতে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন এক দেবালয়ে। স্থানীয় সর্বজনীন দুর্গাবাড়িতে গান গেয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন উপস্থিত সবাইকে। গান শুনে খুশি হয়ে ভক্তরা তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে যায় কিছু টাকা। প্রতিবন্ধী বিশ্বেশ্বর রাজবংশী জানান, পথে পথে বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে হয়। তাই সব সময় একটি 'ডপকি' তাঁর সঙ্গে রাখেন। ভিক্ষা করার পাশাপাশি গান গেয়ে বাড়তি যা আয় হয়, সংসার চালানোর জন্য তুলে দেন বড় ভাইয়ের হাতে। এভাবেই ৪০ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আপন মনে কাটছে তাঁর জীবন। তাঁর একটাই দুঃখ, টাকা-পয়সা নেই বলে সমাজে তাঁর গানের কদর নেই। গানের কোনো বড় পরিসরেও তাঁকে ডাকা হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও তিনি অবলীলায় গেয়ে যাচ্ছেন বাংলা, হিন্দি, উর্দুু ও বাগানি গান। তিনি টিভিতে গান গাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, 'কেউ যদি একটু সাহায্য করে তাহলে এটা সম্ভব, নতুবা আমার টাকা নেই, আমি কী করে টিভিতে যাব!' প্রতিবন্ধী চা শ্রমিক বিশ্বেশ্বর রাজবংশীর প্রতি সমাজের বিবেকবান বিত্তশালীদের একটু সহমর্মিতায় খুলে যাবে তাঁর সম্ভাবনার দুয়ার, ঘটবে প্রতিভার বিকাশ, পূর্ণ হবে তাঁর মনের প্রত্যাশা। সমাজও তাতে উপকৃত হবে।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

No comments

Powered by Blogger.