ওরাও ভয়ঙ্কর by সাহাদাত হোসেন পরশ ও আতাউর রহমান

রা কেউ পেশাদার কিলার নয়। নিজেদের ভাণ্ডারে নেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের কেউই কিলিং মিশনে ভাড়ায়ও খাটে না। অথচ তারা অবলীলায় মানুষকে খুন করছে। দেখে মনেই হবে না, ওদের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব খুনের ঘটনা। গা শিউরে ওঠা সব খুনের পর আলামত নষ্ট করে দায় এড়াতেও চেষ্টার ত্রুটি নেই তাদের। নিত্য-নতুন কৌশলে আলমত নষ্ট করে অন্যকে ফাঁসিয়ে দেওয়ায়ও তারা সিদ্ধহস্ত।


অনেক হত্যাকাণ্ডের পর এমন সব নাটক সাজায়, যা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখন কেবল পেশাদার আর চিহ্নিত খুনি নয়, বিভিন্ন ঘটনায় যারা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করছে তারাও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীতে লোমহর্ষক এমন কয়েকটি ঘটনায় ভাবিয়ে তুলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম সমকালকে বলেন, আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মনুষ্যত্ববোধ ও নৈতিকতা বাড়ানোর কোনো শিক্ষা নেই। অধিকাংশ পরিবারেও নৈতিকতাবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়না। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে অপরাধ কমবেনা।
ঘটনাক্রম-১ : চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর সূত্রাপুরের নবাবপুর নবেন্দ্রনাথ বসাক লেনে নিজের লোহার কারখানা থেকে দুলাল মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে তার ছেলে জাহিদুর রহমান সানি। এরপর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা গোপন করতে সাজায় অবিশ্বাস্য এক নাটক। বাবাকে হত্যা করে চাচাতো ভাই আল আমিনকে নিয়ে নিজের কারখানায় লাশ মাটিচাপা দিয়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে চলে যায়। সেখানে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে সানি জানায়, বাবাকে নিয়ে সূত্রাপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসার সময় ডাকাতদের কবলে পড়ে। ডাকাতরা তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। সানির কথায় সন্দেহ হলে পরিবারের লোকজন তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর সানি স্বীকার করে, বাবার সঙ্গে নিজেদের ওয়ার্কশপে কাজ করলেও প্রতি সপ্তাহে তাকে হাত খরচ বাবদ ১০০ টাকা দেওয়া হতো। তবে সে সপ্তাহে ৭০০ টাকা দাবি করে। তার বাবা তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে বাবার ওপর বিরক্ত হয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর সে তার চাচাতো ভাই আল আমিন ও বন্ধু শরীফকে নিয়ে বাবাকে হত্যা করে।
ঘটনাক্রম-২ : 'আমার স্ত্রী রিনা ঈদের আগের রাতে নিখোঁজ হয়েছে। আজও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। মাকে না পেয়ে বাচ্চা দুটি কাঁদছে।' কথাগুলো বলতে বলতে স্ত্রীর একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি হাতে ধরিয়ে দিল আলম মিয়া ওরফে ঝিনুক। সঙ্গে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, 'নরসিংদীর শিবপুর থানায় ১০ নভেম্বর জিডি করেছি।' পত্রিকায় একটি নিখোঁজ খবর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে সে। এর দু'দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সন্ধান মেলে রিনা বেগমের মাথাবিহীন দেহের। লাশটি শনাক্ত করে আলম মিয়া নিজেই। তখনও কেউ ধারণাই করেনি_ এই আলম মিয়াই নিজের স্ত্রীকে হত্যার পর বস্তায় ভরে মাথাবিহীন লাশটি ফেলে দিয়েছিল কমলাপুরের একটি নর্দমায়। আর মাথাটি ফেলেছিল পাশের ডাস্টবিনে।
সবুজবাগ থানার এসআই দীপক কুমার পাল বলেন, আলম মিয়ার সাজানো নাটকে প্রথমদিকে তারা কিছুই বুঝতে পারেননি। তিনি আরও জানান, শিবপুর থানায় জিডিতে আলম উল্লেখ করে, নরসিংদীর শিবপুর থেকে তার স্ত্রী রিনা নিখোঁজ হন। তবে পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানতে পারে ঈদের আগে রিনা শিবপুর যাননি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেটটি রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় সক্রিয় ছিল। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আলম মিয়াকে গ্রেফতার করা হলে সে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে।
জবানবন্দিকে আলম মিয়া বলে, সম্পর্কের অবনতির জের ধরে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সে। ৬ নভেম্বর রাতে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান ঘুমিয়ে পড়ার পরও সে জেগে থাকে। এরপর গভীর রাতে একটি ধারালো ছুরি দিয়ে ঘুমন্ত রিনাকে গলাকেটে হত্যা করে। এ সময় রিনার গলা দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বের হতে শুরু করলে সে দু'হাতে গলার কাটা স্থান চেপে ধরে। রক্তে বিছানা ভিজে যাচ্ছিল বলে সে কাঁথা দিয়ে রিনার দেহটি মুড়িয়ে রাখে। পরে একটি বস্তায় রিনার দেহ ও একটি ব্যাগে তার মাথা ভরে বিছানার চাদরসহ রক্তমাখা স্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করে। সকাল ৬টায় বাসার সামনে থেকে একটি রিকশায় করে বস্তা ও ব্যাগ নিয়ে কমলাপুর ফুটওভার ব্রিজের কাছে যায় আলম। সেখানে বস্তাটি রেখে অল্প দূরে গিয়ে প্রস্রাবের ভ্যান করে ম্যানহোলের ভেতরে কাটা মাথাসহ ব্যাগটি ফেলে আবার মাণ্ডার বাসায় ফেরে।
ঘটনাক্রম-৩ : মডেলকন্যা তাহিয়া তাবাসসুম আদৃতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ৩১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে অবস্থিত বিজ্ঞাপন নির্মাতা একটি প্রতিষ্ঠানের চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতপরিচয়ের এক তরুণীর লাশ। এর চারদিন পর পরিচয় মেলে এ মেয়েটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র রেহানের প্রেমিকা মডেলকন্যা আদৃতা। অবিশ্বাস্য হলেও এ রেহানই আদৃতাকে হত্যা করে লাশটি ফেলে রেখেছিল সেখানে। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় সাজায় নাটক। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ জানায়, আদৃতার পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর প্রেমিক রেহানকে তারা দু'দফা থানায় ডেকে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে আদৃতার হত্যার ব্যাপারে সে কিছুই জানে না বলে জানায়। উল্টো প্রেমিকার এমন মৃত্যুতে সে শোকাহত হয়ে পড়ে। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে সে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয় রেহান। জবানবন্দি ও গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে রেহান জানায়, ৩০ অক্টোবর সে আদৃতাকে তাজমহল রোডের ওই বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির কাছে ডেকে নেয়। সেখানে তারা ইয়াবা সেবন করে। একপর্যায়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হলে সে আদৃতাকে গলা টিপে ধরে ও তার ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য রেহান আদৃতাকে হত্যার পর তার দেহের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে নখের খামছি দিয়ে এটিকে ধর্ষণের পর হত্যা বলে সাজানোর চেষ্টা করে। আদৃতার লাশটি সেখানেই ফেলে রেখে তার মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠায়। এ থেকে সে প্রমাণের চেষ্টা করে, সে নিজেও নিখোঁজ আদৃতাকে খুঁজছে। আদৃতাকে হত্যার পরও নিজে আত্মগোপনে না গিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে থাকে রেহান।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, রেহানের সব নাটকই হার মানে গোয়েন্দা তদন্তের কাছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সে আদালতেও হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে এখন কারাগারে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.