শেকড়ের ডাক-তারুণ্যের জয়, সত্য ও সুন্দরের জয় by ফরহাদ মাহমুদ
আচ্ছা, আপনি কি বিশ্বাস করেন, মানুষ এখনকার মতো সব সময় একে অন্যকে হত্যা করে এসেছে, আর তারা সব সময় মিথ্যাবাদী, প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ, দস্যু, আহাম্মক, চোর, বদমাশ, পেটুক, মদ্যপায়ী, কৃপণ, হিংসুটে, দুরাশা পোষণকারী, রক্তপিপাসু, পরনিন্দুক, ব্যভিচারী, গোঁড়া, কপট আর বোকা ছিল?' ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের (১৬৯৪-১৭৭৮) ক্যানডিড নাটকের মূল চরিত্র ক্যানডিড ওই নাটকেরই আরেক চরিত্র মারটিনকে এ প্রশ্ন করেছিলেন।
বর্তমান সময়কে দোষারোপ করার এমন বহু উল্লেখ বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে। আর তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ করার ইতিহাস আরা অনেক পুরনো। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মূলত তরুণদের নিয়েই দর্শনচর্চা করতেন। তার পরও তৎকালীন গ্রিসের সাধারণ তরুণ সমাজের ওপর তিনি ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। তাঁর মতে, এরা বিলাসিতাপ্রিয়, স্বেচ্ছাচারী, বড়দের সম্মান করতে জানে না এবং এরা মা-বাবারও অবাধ্য। 'সোজা কথায়, এরা খুবই খারাপ।' তাঁরও আগে হেসিয়ড (৭২০ খ্রি.পূ.) তরুণ সমাজের অবস্থা দেখে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আর সে কারণে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, এদের সহনশীলতা নেই, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সোজা কথায়, এরা ভয়ানক। তারও আগে ২০০০ খিস্টপূর্বাব্দের এক মিসরীয় ধর্মীয় নেতার যে উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, তাতে তরুণ সমাজের অধঃপতনের উল্লেখ করে বলা হয়, 'মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শেষ আর খুব বেশি দূরে নয়।' প্রায় সব যুগেই পুরনো প্রজন্ম নতুন প্রজন্মকে এভাবেই দোষারোপ করে এসেছে। এর মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো, নতুন প্রজন্ম পুরনো প্রজন্মের কাছ থেকে যেমন কিছু শিক্ষা পায়, তেমনি পরিবর্তিত পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে ভিন্নতর কিছু শিক্ষাও পায়, যা চিন্তার প্রাক-কাঠামো ক্রিয়াশীল থাকায় তারা খুব একটা নিতে পারে না। তাই পুরনো প্রজন্মের ধ্যানধারণা থেকে ভিন্ন সেই আচরণকে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। আর তখনই তাদের মনে হয়, নতুন প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাচ্ছে। তার অর্থ এই নয় যে তরুণ প্রজন্মের অংশবিশেষ খারাপ হয় না।
ক্যানডিডের প্রশ্নের জবাবে মারটিন পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি কি বিশ্বাস করো, কোনো বাজপাখি নাগালে পেলে কবুতরকে খেয়ে ফেলে?' ক্যানডিড জবাব দিলেন, 'নিশ্চয়ই।' মারটিন তখন পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, 'তাহলে তুমি মানুষের স্বভাব বদলাবে বলে আশা করো কেন?' ক্যানডিডের প্রশ্নে মানুষের যত দোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি দোষ মানুষের মধ্যে আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বরং বলা যায়, ভলতেয়ারের পরবর্তী ৪০০ বছরে অপরাধ নতুন নতুন মাত্রা পেয়েছে, ব্যাপকতা পেয়েছে। সত্য হলো, তার পরও মানবসভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। কারণ মানুষের মধ্যে কেবল দোষ নয়, গুণও আছে এবং মানুষ ক্রমেই উন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে। নতুন প্রজন্মের ভেতর থেকেই ক্রমে উন্নততর গুণাবলিসমৃদ্ধ মানুষ বেরিয়ে আসে। আবার তরুণ প্রজন্মই একসময় পুরনো প্রজন্মের রূপ নেয় এবং তারাও আগের প্রজন্মের মতো তারুণ্যের প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সমালোচনার পরও পুরনো প্রজন্মই তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখায়। যখন যে সমাজে এই প্রক্রিয়ার অভাব হয়, সেই সমাজ পিছিয়ে পড়ে, ধ্বংসও হয়।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যে অনেক বেশি বিবেচক, তার প্রমাণ দেখতে চাইলে আমরা অনেক দেখতে পাব। তাদের প্রতিযোগিতা কিংবা এগিয়ে চলার ধরন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তারা এগোচ্ছে। যুগে যুগান্তরে এটাই সত্য। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনেও এটা সত্য ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধেও ছিল সমান সত্য। সে সময়ের তরুণরাই মূলত পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। আর স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই কিছু লোক। তাদের মধ্যেও তরুণ প্রজন্মের একটি বিভ্রান্ত অংশ ছিল। তারা হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতনে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ৪০টি বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি চাপা পড়েছিল। এই দীর্ঘ নীরব সময়টাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারীরা রাষ্ট্রক্ষমতায়ও এসেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং নাগরিক সমাজের সচেতন প্রতিনিধিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি সফলভাবে তুলে ধরেছিলেন। আর তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল এ দেশেরই তরুণ সমাজ। তারাই মূলত সেই দাবিটি এগিয়ে নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। তাই মহাজোটকে তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। পরবর্তী সময়ে মহাজোট সরকার তাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে, সেই বিচার করার সময় এখনো আসেনি। আবার তারুণ্যই সেই বিচারের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু আমরা যে কথাটি জোর দিয়ে বলতে পারি, তরুণরা কেবল বিপথে যায় না, সমাজ পরিবর্তনেও তারা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা সেই সত্যকেই জেনে এসেছি। এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। নির্বাচনে মোট তিনজন প্রার্থী প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সেলিনা হায়াত আইভী ছাড়া বাকি দুজনের বিরুদ্ধেই ছিল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। সেখানে দলীয় রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে তরুণ সমাজই মূলত সৎ ও যোগ্যতর প্রার্থী হিসেবে আইভীকে জেতানোর ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই এ বিজয় তারুণ্যেরই বিজয়। দেশব্যাপী এ বিজয়ের ধারা যত প্রবল হবে, দেশ তত এগিয়ে যাবে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সৎ ও শুভবুদ্ধি তত বেশি বিজয়ী হবে। নিজেদের স্বার্থে তারুণ্যকে যারা বিপথগামী করার চেষ্টা করে, সেই সব অপশক্তির হাত তত দুর্বল হবে। পাশাপাশি তারুণ্যকে কেবল আবেগ নয়, কিছুটা হলেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। যুক্তির শানে তারুণ্যের দেশপ্রেমকে শানিত করতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অসচেতনতাকেই কাজে লাগায় অশুভ ও অন্ধকারের শক্তি।
লেখার শুরুতে তারুণ্যের প্রতি পুরনো প্রজন্মের যে নেতিবাচক ধারণার উল্লেখ করা হলো, সেটি একটি খণ্ডিত চিত্র। মানবমনের ভাবনাগুলো সব সময় একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে না। সেদিক থেকে এই নেতিবাচক ধারণাগুলো পূর্বোলি্লখিতদের ক্ষণিকের ভাবনাও বলা যেতে পারে। যে সক্রেটিস তরুণ সমাজকে খারাপ বলেছেন, সেই সক্রেটিসের শিষ্যরাও ছিলেন মূলত তরুণ, সে কথা আগেই বলেছি। তৎকালীন রাষ্ট্র সক্রেটিসকে যেসব কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, তার মধ্যে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগও ছিল, যদিও সেটি ছিল তরুণ সমাজকে আলোকিত করারই প্রচেষ্টা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে বারবারই তারুণ্যের জয়গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যেও তারুণ্যের জয়গান একটি বড় অংশ দখল করে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, অনেক সমালোচনার পরও প্রায় সব যুগেই তরুণরাই এর প্রতিকার করবে_এ ধরনের আশাবাদও ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশে আজ সুশাসনের অভাব বড় বেশি প্রকট। গণতন্ত্র বড় বেশি কেতাবি হয়ে পড়েছে। রাজনীতিকে আজ একটি দূষিত পরিবেশে টেনে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে প্রবলভাবে। আমরা কি সেই ধারাতেই চলতে থাকব? জঙ্গি ও মৌলবাদী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা কি আজকের রক্তাক্ত পাকিস্তানকে অনুসরণ করব? বিষয়গুলো আমাদের তরুণ সমাজকে ভেবে দেখতে হবে। তা না হলে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে তারুণ্যের এই জাগরণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একই সঙ্গে এটাও সত্য, আগে যারা আমাদের দেশ দখল করে, উপনিবেশ বানিয়ে শোষণ করেছিল, তারা এখনো আমাদের শোষণ করে। তবে তা করে ভিন্ন কায়দায়, নানা রকম মুখোশের আড়ালে। তাদের সে কায়দাগুলো বুঝতে হবে। বিদেশি বহুজাতিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আমাদের দেশে এখনো একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী রয়েছে। তাদের চিনতে হবে, তাদের স্বরূপ জানতে হবে। তাই তারুণ্যকে শুধু আবেগ নয়, যুক্তিতেও সবল হতে হবে। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্রম-অগ্রসরমান এই বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকেও ক্রমান্বয়ে সুদৃঢ় করতে হবে। চিন্তাচেতনায়, মননে ও সৃজনশীলতায় সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর তখনই তারুণ্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে
লেখক : সাংবাদিক
ক্যানডিডের প্রশ্নের জবাবে মারটিন পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি কি বিশ্বাস করো, কোনো বাজপাখি নাগালে পেলে কবুতরকে খেয়ে ফেলে?' ক্যানডিড জবাব দিলেন, 'নিশ্চয়ই।' মারটিন তখন পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, 'তাহলে তুমি মানুষের স্বভাব বদলাবে বলে আশা করো কেন?' ক্যানডিডের প্রশ্নে মানুষের যত দোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি দোষ মানুষের মধ্যে আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বরং বলা যায়, ভলতেয়ারের পরবর্তী ৪০০ বছরে অপরাধ নতুন নতুন মাত্রা পেয়েছে, ব্যাপকতা পেয়েছে। সত্য হলো, তার পরও মানবসভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। কারণ মানুষের মধ্যে কেবল দোষ নয়, গুণও আছে এবং মানুষ ক্রমেই উন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে। নতুন প্রজন্মের ভেতর থেকেই ক্রমে উন্নততর গুণাবলিসমৃদ্ধ মানুষ বেরিয়ে আসে। আবার তরুণ প্রজন্মই একসময় পুরনো প্রজন্মের রূপ নেয় এবং তারাও আগের প্রজন্মের মতো তারুণ্যের প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সমালোচনার পরও পুরনো প্রজন্মই তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখায়। যখন যে সমাজে এই প্রক্রিয়ার অভাব হয়, সেই সমাজ পিছিয়ে পড়ে, ধ্বংসও হয়।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যে অনেক বেশি বিবেচক, তার প্রমাণ দেখতে চাইলে আমরা অনেক দেখতে পাব। তাদের প্রতিযোগিতা কিংবা এগিয়ে চলার ধরন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তারা এগোচ্ছে। যুগে যুগান্তরে এটাই সত্য। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনেও এটা সত্য ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধেও ছিল সমান সত্য। সে সময়ের তরুণরাই মূলত পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। আর স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল এ দেশেরই কিছু লোক। তাদের মধ্যেও তরুণ প্রজন্মের একটি বিভ্রান্ত অংশ ছিল। তারা হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতনে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর ৪০টি বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি চাপা পড়েছিল। এই দীর্ঘ নীরব সময়টাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারীরা রাষ্ট্রক্ষমতায়ও এসেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং নাগরিক সমাজের সচেতন প্রতিনিধিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি সফলভাবে তুলে ধরেছিলেন। আর তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল এ দেশেরই তরুণ সমাজ। তারাই মূলত সেই দাবিটি এগিয়ে নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। তাই মহাজোটকে তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। পরবর্তী সময়ে মহাজোট সরকার তাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে, সেই বিচার করার সময় এখনো আসেনি। আবার তারুণ্যই সেই বিচারের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু আমরা যে কথাটি জোর দিয়ে বলতে পারি, তরুণরা কেবল বিপথে যায় না, সমাজ পরিবর্তনেও তারা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা সেই সত্যকেই জেনে এসেছি। এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। নির্বাচনে মোট তিনজন প্রার্থী প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সেলিনা হায়াত আইভী ছাড়া বাকি দুজনের বিরুদ্ধেই ছিল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। সেখানে দলীয় রাজনীতির ঊধর্ে্ব উঠে তরুণ সমাজই মূলত সৎ ও যোগ্যতর প্রার্থী হিসেবে আইভীকে জেতানোর ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। কাজেই এ বিজয় তারুণ্যেরই বিজয়। দেশব্যাপী এ বিজয়ের ধারা যত প্রবল হবে, দেশ তত এগিয়ে যাবে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সৎ ও শুভবুদ্ধি তত বেশি বিজয়ী হবে। নিজেদের স্বার্থে তারুণ্যকে যারা বিপথগামী করার চেষ্টা করে, সেই সব অপশক্তির হাত তত দুর্বল হবে। পাশাপাশি তারুণ্যকে কেবল আবেগ নয়, কিছুটা হলেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। যুক্তির শানে তারুণ্যের দেশপ্রেমকে শানিত করতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অসচেতনতাকেই কাজে লাগায় অশুভ ও অন্ধকারের শক্তি।
লেখার শুরুতে তারুণ্যের প্রতি পুরনো প্রজন্মের যে নেতিবাচক ধারণার উল্লেখ করা হলো, সেটি একটি খণ্ডিত চিত্র। মানবমনের ভাবনাগুলো সব সময় একই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে না। সেদিক থেকে এই নেতিবাচক ধারণাগুলো পূর্বোলি্লখিতদের ক্ষণিকের ভাবনাও বলা যেতে পারে। যে সক্রেটিস তরুণ সমাজকে খারাপ বলেছেন, সেই সক্রেটিসের শিষ্যরাও ছিলেন মূলত তরুণ, সে কথা আগেই বলেছি। তৎকালীন রাষ্ট্র সক্রেটিসকে যেসব কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, তার মধ্যে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার অভিযোগও ছিল, যদিও সেটি ছিল তরুণ সমাজকে আলোকিত করারই প্রচেষ্টা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে বারবারই তারুণ্যের জয়গান ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যেও তারুণ্যের জয়গান একটি বড় অংশ দখল করে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, অনেক সমালোচনার পরও প্রায় সব যুগেই তরুণরাই এর প্রতিকার করবে_এ ধরনের আশাবাদও ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্যই বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশে আজ সুশাসনের অভাব বড় বেশি প্রকট। গণতন্ত্র বড় বেশি কেতাবি হয়ে পড়েছে। রাজনীতিকে আজ একটি দূষিত পরিবেশে টেনে নেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে প্রবলভাবে। আমরা কি সেই ধারাতেই চলতে থাকব? জঙ্গি ও মৌলবাদী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা কি আজকের রক্তাক্ত পাকিস্তানকে অনুসরণ করব? বিষয়গুলো আমাদের তরুণ সমাজকে ভেবে দেখতে হবে। তা না হলে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে তারুণ্যের এই জাগরণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একই সঙ্গে এটাও সত্য, আগে যারা আমাদের দেশ দখল করে, উপনিবেশ বানিয়ে শোষণ করেছিল, তারা এখনো আমাদের শোষণ করে। তবে তা করে ভিন্ন কায়দায়, নানা রকম মুখোশের আড়ালে। তাদের সে কায়দাগুলো বুঝতে হবে। বিদেশি বহুজাতিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আমাদের দেশে এখনো একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী রয়েছে। তাদের চিনতে হবে, তাদের স্বরূপ জানতে হবে। তাই তারুণ্যকে শুধু আবেগ নয়, যুক্তিতেও সবল হতে হবে। জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্রম-অগ্রসরমান এই বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকেও ক্রমান্বয়ে সুদৃঢ় করতে হবে। চিন্তাচেতনায়, মননে ও সৃজনশীলতায় সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর তখনই তারুণ্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে
লেখক : সাংবাদিক
No comments