চিকিৎসাসেবা-জনবান্ধব নীতি চাই
সাম্প্রতিক অতীতেও নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের তালিকায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার সঙ্গে চিকিৎসার কথা উচ্চারিত হতো। নাগরিক অধিকার বিষয়ে সচেতন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো নানাভাবে এগুলো বাস্তবায়নে সরকারের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। বলা হতো, নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এখন বেসরকারি খাতের প্রবল উত্থানের মুখে এসব দাবির কথা সেভাবে উচ্চারিত
হয় না। হলেও সে কথা আমলে আনার কর্তব্যবোধ কাউকে তাড়িত করে বলে মনে হয় না। বেসরকারি খাতের তুমুল উত্থানের পরও পৃথিবীর অনেক উন্নত, গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশে রাষ্ট্র নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ভার বহন করে। কিন্তু আমাদের দেশে সে আদর্শ দূরের কথা_ সেবা খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বাড়তি মুনাফা বিষয়ে রাষ্ট্রের নূ্যনতম সচেতনতার দেখাও অনেক সময় মেলে না। খাদ্যপণ্যসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়লে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাজারের ওপর দায় চাপান। কার্যক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণের উপায় তাদের কব্জায় থাকে না। শিক্ষা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়লেও দায়িত্বশীলরা নির্বাক ভূমিকাই অবলম্বন করেন। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্রমহ্রাসমান ভূমিকা নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। কোনো নিয়মনীতি ও আইন-কানুনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বেসরকারি খাত মাত্রাহীন মুনাফার দিকেই ঝুঁকছে। বর্তমান অবস্থায় কেউই রাষ্ট্রকে সব কিছুর দায় গ্রহণ করতে বলেন না। বরং রাষ্ট্রীয় সেবা খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উত্থানে নাগরিকরা খুশি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণও রেখেছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ বেড়েছে। উন্নত ও আধুনিক সেবা ব্যবস্থাও সুলভ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জনবহুল দেশে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা যত বাড়ানো যায়, ততই তা মঙ্গলজনক বলেই বিবেচিত হয়। তবে নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয় যেভাবে বাড়ছে তাতে বেসরকারি খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার প্রয়োজন গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য যখন কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা বিশেষায়িত সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালের দ্বারস্থ হন, তখন কম মূল্যে সেবা আশা করেন না। হাসপাতালগুলো সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে না। বর্তমানে সাধারণ চিকিৎসাসেবাও দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। সাধারণ অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও রোগীদের মোটা অঙ্কের ফি গুনতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে শুধু ডাক্তার দেখাতেই অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। দেশে প্রয়োজন অনুসারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ফলে বিশেষজ্ঞদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে, সরকারি হাসপাতালে সেবা দিয়ে বাড়তি সময় বের করে রোগী দেখতে হয়। ফলে তারা বাড়তি ফি দাবি করতে পারেন। কিন্তু সে ফি ছয় মাসে, তিন মাসে দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে কোন যুক্তিতে? রোগীর ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট দেখতে গিয়েও তারা ফি দাবি করবেন কেন? আর বিশেষজ্ঞ নন যারা তারাই-বা কোন মানদণ্ডে বাড়তি ফি আদায় করছেন? হাসপাতালগুলোই-বা কোন যুক্তিতে চিকিৎসা ব্যয় ক্রমাগত বাড়িয়েই চলেছে? সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এমন চলতে থাকলে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। সেটি কোনো অবস্থাতেই প্রত্যাশিত হবে না। এজন্য সীমিত হলেও সরকারের একটি জনবান্ধব ভূমিকা প্রত্যাশিত। সরকার যদি স্বাস্থ্যনীতিতে বেসরকারি হাসপাতালের সেবা ও ফি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে তবে তা এক্ষেত্রে সহায়ক হবে। চিকিৎসক, বেসরকারি উদ্যোক্তা, চিকিৎসা অধিকার বাস্তবায়নে কর্মরত সংস্থা, সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি নীতি প্রণয়ন করা গেলে তবে তা সহজে গ্রহণযোগ্য হবে। এমন উদ্যোগ না নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বল্গাহারা গতিতে চলতে দিলে আখেরে এটি নাগরিক পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। তাই স্বাস্থ্যনীতি ও চিকিৎসাসেবা আইনে বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উলি্লখিত হওয়া উচিত। এসব নীতি ও আইনের পাশাপাশি সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেও উন্নততর করতে হবে। চিকিৎসকরা যাতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে উৎসাহী হন সে ব্যাপারে প্রণোদনা জাগাতে হবে।
No comments