সময়ের প্রতিধ্বনি-বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ কেন? by মোস্তফা কামাল

বার একটি অঘটন ঘটাল ভারত। ট্রানজিটের মতো স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে বিতর্ক শেষ হতে না হতেই ভারত আরেকটি বিতর্কিত ইস্যু সামনে নিয়ে এল। এ মুহূর্তে কেন ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং স্বয়ং বাংলাদেশকে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, 'বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু ভারত করবে না।


' তার পরও ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি করল কেন? তার মানে কি ড. মনমোহনের প্রতিশ্রুতিরও কোনো মূল্য নেই?
তা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার পরও বাংলাদেশকে না জানিয়ে ভারত কী করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিল? তাহলে আর এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে লাভ কী। ভারতের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের জনগণ দারুণভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছে। এই ইস্যুতে সরকারের রহস্যজনক নীরবতায়ও দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। সরকারের এই অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার দায় কে নেবে? ট্রানজিট ইস্যু নিয়েও সরকার একই কাণ্ড করেছিল। কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে আটকে গিয়েছিল সরকার। আর ভারতকে উজাড় করে দেওয়ার জন্য দুই উপদেষ্টা তো প্রস্তুতই আছেন। কাজেই কোনো কিছুর জন্য ভারতের আর চাপ অথবা তাগিদ দিতে হয় না।
টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে সরকার তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়াও জানায়নি। ভারতে নিযুক্ত হাইকমিশনার আহমেদ তারিক করিম বলেছেন, তাঁরা খোঁজখবর নেবেন। সরকারের এই উদাসীনতার মানে কী? তা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর এই প্রকল্প নিয়ে ভারত এত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হলো; আর আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানতেও পারল না! হাইকমিশনার তারিক করিম দিলি্লতে বসে ঘুমিয়ে কাটান কি না, কে জানে! তাঁকে তো আমরা অভিজ্ঞ কূটনীতিক বলে জানতাম। তিনিও কি উপদেষ্টাদ্বয়ের মতো ভারতের ব্যাপারে দাতা হাতেম তাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন!
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ঢাকায় অতিথি রেখে ভারত সফরে চলে গেলেন। তিনিও কি কিছু জানতে পারেননি! কয় দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে তিনি নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়ে মাঝপথে ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। অতিথি বেচারা ঘটনাটি জানার পর কী বিব্রতই না হয়েছেন! জাতিসংঘ মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ একজন অতিথিকে এই অপমান কেন? নাকি না বুঝেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজটি করেছেন?
বিলম্বে হলেও টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বিবিসি বোমা ফাটানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, 'বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর চুক্তিটি দিলি্লতে সই হয়।' মণিপুর সরকার ও প্রকল্পের অন্যতম অংশীদারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি গত শুক্রবার এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না, বিবিসির রিপোর্টটি সঠিক। কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতবার বলেছেন যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প তাঁরা বাস্তবায়ন করবেন না। এ বিষয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দিলি্লতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকেও আশ্বস্ত করা হয়েছিল। পরে যৌথ ইশতেহারেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছর ঢাকা সফরে এসেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একই কথা বলেছেন এবং যৌথ ইশতেহারেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরও ভারত কেন এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ করল?
শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তি করে ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন, পরিবেশ আইন; এমনকি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ নম্বর আর্টিকেলেরও লঙ্ঘন করেছে।
কূটনৈতিক সূত্র এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ভারতের মণিপুর রাজ্যে বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পটি তৈরি হয় ২০০৮ সালে। প্রথম দিকে পরিকল্পনা ছিল শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। পরে এই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তিত পরিকল্পনায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা বলা হয়। বাঁধটির দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার এবং উচ্চতা ১৬২ মিটার।
এই প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ জন্য ছয়টি ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ১৩৮ কোটি রুপি। সাত বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে। আগামী মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওই অঞ্চলে সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি ওই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর কাজ শুরু হওয়ার কথা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বড় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বাংলাদেশই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বরাক যেহেতু আন্তর্জাতিক নদ। সে কারণেই সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রকল্প হাতে নিতে হয়। এটাই আন্তর্জাতিক আইন। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যৌথ সমীক্ষা প্রয়োজন। পুরো অববাহিকার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তার কোনো যৌথ সমীক্ষা করা হয়নি। তার আগেই ভারতের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়া ঠিক হবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ওই অঞ্চলের বড় এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানিতে তলিয়ে যাবে। অনেক প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। ঘরবাড়ি এবং জীবিকা হারাবে অনেক মানুষ। ওই অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চয়ই ভারতের অজানা নয়। তার পরও ভারত কেন প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি করল?
বড় প্রতিবেশী হিসেবে ভারত কি ছোট প্রতিবেশী বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করবে না? বাংলাদেশ তো ভারতের শত্রুরাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের বিশাল অবদানের কথা তো বাঙালি ভুলে যায়নি। এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বর্তমান সরকার স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ামক শক্তি গান্ধী পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পারিবারিক এই সম্পর্ক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কোন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে আমরা জানি।
আমরা মনে করি, শেখ হাসিনা এবং সোনিয়া গান্ধী যৌথভাবে দুই দেশের সম্পর্ককে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে যাবেন। যাতে কোনো কারণেই দুই দেশের মধ্যে আস্থার অভাব না ঘটে। অতীতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে বারবার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সেই সম্পর্কের কিছু উন্নতি হলেও আস্থাহীনতা দূর করা যায়নি।
আমরা জানি, শেখ হাসিনা সরকার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বিশেষভাবে সহযোগিতা দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে তার জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। বাংলাদেশের সহযোগিতায় সেই উদ্বেগের অনেকটাই অবসান হয়েছে। বাংলাদেশ সহযোগিতা না করলে সমস্যাটি আরো বেড়ে যেত। এরপর ভারতীয় গণমাধ্যমই বারবার বলে আসছিল, 'বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে, এখন ভারতের দেওয়ার পালা। দুই হাত ভরে বাংলাদেশকে দিতে হবে।' ভারতের বর্তমান সরকারও নাকি বাংলাদেশকে দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি আন্তরিক। কিন্তু ভারতীয় আমলারা এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। তাঁরা বাংলাদেশ থেকে কেবল নিতে চান। বাংলাদেশকে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের হাত খুলতে চায় না।
ভারতকে মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা সরকার ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে যে সহযোগিতা করেছে তা বাংলাদেশের কোনো সরকারই অতীতে করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। কাজেই শেখ হাসিনা সরকারকে বিব্রত করে ভারত খুব একটা লাভবান হবে না। বরং ভারতের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।
ভারত নিশ্চয়ই জানে, স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই দেশে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন একটি বিরাট অংশ সক্রিয় রয়েছে। পাকিস্তান সরকার এবং সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এসব কারণেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় পর্যন্ত বসেছে। পাকিস্তানপন্থী এই শক্তির মূল স্লোগানই হচ্ছে 'ভারত ঠেকাও'। মানুষের মনে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরিতে এই শক্তিটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। এখনো জাতীয় নির্বাচনের সময় আমরা দেখি, একটি বড় দলের নেতা-নেত্রীরা সভা-সমাবেশে ভারতবিরোধী বক্তব্য দেন। তাঁরাই সাধারণ মানুষকে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখান। সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ভারতের এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না, যাতে আবার সাধারণ মানুষের মনে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়। কোনো কোনো সরকার ভারতবিরোধী হতে পারে। আবার ভারতকে তোষণ করেও চলতে পারে। কিন্তু জনগণ যদি ভারতের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে তা ভারতের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।
পেশাগত কারণেই আমি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ সফর করেছি। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গেও মেশার সুযোগ পেয়েছি। আমি দেখেছি, ভারতের ব্যাপারে ছোট দেশগুলোর মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। বড় দেশ হিসেবে এই ভীতি দূর করার দায়িত্ব ভারতেরই। তাহলে বিশ্বের কাছেও ভারতের গুরুত্ব বাড়বে।
ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে_এ কথা সত্য। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ভারতের। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে এ দেশের মানুষের মনে ক্ষত সৃষ্টি হবে। পরবর্তীকালে কোনো কিছুর বিনিময়েই সেই ক্ষত সারানো যাবে না।
আমরা এখনো আশা করছি, ভারত বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। তার পরও বলব, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এখন সরকারের ভূমিকার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। অথচ সরকার কেন জানি নীরব রয়েছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না তা আমরা জানি না। তবে আমরা বলব, এ বিষয়ে সরকারের জোর প্রতিবাদ জানানো উচিত। প্রয়োজন হলে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হতে পারে সরকার। তাতে জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে। এ দেশের গণমাধ্যমও সক্রিয় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.