থিম্পুতে ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ এক জলবায়ু সম্মেলন-সমকালীন প্রসঙ্গ by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
ঢাকায় ক'দিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্নতম দেশগুলোর জোট বা সিভিএফ (ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম)ভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলন। আবার এ মাসের শেষের ক'দিন ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে চলবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ইউএনএফসিসি (টঘঋঈঈ) বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন,কোপ-সেভেনটিন (ঈড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব চধৎঃরবং ১৭)। এই দুই বড় আয়োজন নিয়ে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম
যখন খুবই ব্যস্ত, তখন অনেকটা নিভৃতে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনুষ্ঠিত হলো জলবায়ু বিষয়ক একটি পূর্ব হিমালয় আঞ্চলিক সম্মেলন। অপর দুটি সম্মেলনের তুলনায় ছোট, কিন্তু আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটি।
পূর্ব হিমালয়ের চারটি দেশ_ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুবই ঝুঁকির মুখোমুখি। তবে এ অঞ্চলের দেশগুলো এবং এখানকার মানুষ এর জন্য মোটেই দায়ী নয়। দায়িত্ব উন্নত বিশ্বের। বিগত দেড়-দুইশ' বছর ধরে ওই দেশগুলো যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে আসছে তারই ফলে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি স্বীকৃত। তবে উন্নত বিশ্ব তাদের দায়দায়িত্ব মেনে নিলেও কর্তব্য পালনে অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস দ্রুত কমিয়ে আনা এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোকে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সমস্যা মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাস্তব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে না। অঙ্গীকার অবশ্য একেবারে কম করেনি; কিন্তু অঙ্গীকার রক্ষায় ঘাটতি বিস্তর।
পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং ছোট একটি অঞ্চলে বিশাল জনসংখ্যাসহ অন্যান্য কারণে খুবই নাজুক অবস্থায় এমনিতেই আছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এ অঞ্চলের চারটি দেশেই দারিদ্র্য প্রকট। আর দরিদ্র মানুষের ওপরই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রধানত বর্তায়। এ দেশগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও দারিদ্র্য নিরসনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরিকল্পনা এবং নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করে এলেও দারিদ্র্য এখনও প্রকটই থেকে গেছে। যদিও আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে না। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত দরিদ্রদের অতিদরিদ্র এবং অতিদরিদ্রদের নিঃস্ব মানুষের পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা করা জরুরি।
যেহেতু এ অঞ্চলের প্রত্যেক দেশই ভৌগোলিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং নানাভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীল, কাজেই এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কারণ নেই যে, দেশগুলো যদি একই সঙ্গে সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করে, তাহলে প্রত্যেক দেশই এবং প্রত্যেক দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ একা চলার চেয়ে অধিকতর উপকার নিশ্চয়ই পেতে পারে। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব গবেষণা হয়েছে, তা থেকে এ বক্তব্য জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
উপযুক্ত বাস্তবতাকে ধারণ করে বছরখানেক আগে পূর্ব হিমালয়ের উলিল্গখিত চারটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ওই লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে থিম্পুতে একটি শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শীর্ষ বৈঠকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও জীববৈচিত্র্য_ এ চারটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়। একেকটি দেশ একেকটি বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে বিগত এক বছর ধরে একযোগে কাজ করে প্রত্যেক বিষয়ে যুগপৎ কাজ করার সম্ভাব্য ক্ষেত্র ও কৌশল চিহ্নিত করে। বাংলাদেশ পানি, ভুটান জীববৈচিত্র্য, ভারত খাদ্য নিরাপত্তা ও নেপাল জ্বালানি বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়। প্রত্যেক বিষয়ে অবশ্য প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি সহকারে কর্মদল বা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। প্রত্যেক দলই বিভিন্ন সভায় মিলিত হয়ে করণীয় চিহ্নিত করে। সবশেষে প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি নিয়ে শীর্ষ বৈঠকের জন্য ঘোষণাপত্র, সহযোগিতা কাঠামো এবং বাস্তবায়ন কৌশলের খসড়া তৈরি করে। আমি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রায় প্রথম থেকেই জড়িত ছিলাম ও শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করি।
১৮ নভেম্বর ২০১১ তারিখ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে পরিবেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দলিলগুলো চূড়ান্ত করা হয়। ১৯ নভেম্বর ভুটানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াইন জিগমে ওয়াই থিনলের সভাপতিত্বে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনটি দেশের পরিবেশমন্ত্রী ও ভারতের পরিবেশ সচিব সহযোগিতা কাঠামো এবং বাস্তবায়ন কৌশলসহ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন।
আমি মনে করি, চারটি দেশ যে এক সঙ্গে বসে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার এবং কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তা একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে খুবই আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
কয়েকটি চিহ্নিত পদক্ষেপের কথা উলেল্গখ করা যায়। জ্বালানির ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে চারটি দেশ এক সঙ্গে কাজ করবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে_ একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে সবার জন্য জ্বালানি নিশ্চিত করা; জ্বালানির বহুমুখী সরবরাহ ও ব্যবহার; আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন এবং প্রয়োজন অনুসারে সম্প্রসারণ; জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি খাতে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীলতা নিশ্চিত করা।
পানি ব্যবস্থাপনায় একযোগে কাজ করার লক্ষ্যে যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয় এগুলোর মধ্যে উলেল্গখযোগ্য হচ্ছে প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কমানো; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদ্ধতি ও কর্মসূচি গ্রহণ; পানি সংরক্ষণে লোকায়ত ও আধুনিক ব্যবহার সংমিশ্রণে পানির ব্যবহারে অপচয় রোধ; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারে সফল চর্চা ও উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং সংশিল্গল্গষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ; জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যগাথা আদান-প্রদান, বিশেষ করে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার লক্ষ্য হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় খাপ খাওয়ানোর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পরিবর্তন এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ; বিপন্ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, তথ্য ও জ্ঞান আদান-প্রদান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব হিমালয় অঞ্চলজুড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ-অঞ্চল সৃষ্টি; জীববৈচিত্র্যের সুষ্ঠু ও টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও আয় বৃদ্ধি, তথ্য ও জ্ঞান আদান-প্রদান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রত্যেক লক্ষ্যের আওতায় উলেল্গখযোগ্য সংখ্যক পদক্ষেপ বা করণীয়ও চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেক দেশ থেকে মনোনীত প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত সমন্বয়কারী দল গৃহীত ঘোষণাপত্র ও সহযোগিতা কাঠামো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি প্রত্যেক দেশের মনোনীত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে। প্রত্যেক দেশ থেকে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে, যা সমন্বয়কারী দল মূল্যায়ন করবে। গৃহীত প্রকল্পগুলো যত দূর সম্ভব এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। তবে প্রয়োজনে অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। দ্রুত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য প্রত্যেক দেশই আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সমন্বয়কারী দলের প্রথম সভা আগামী এক বছরে থিম্পুতে অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই এ দল পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দেশেও বৈঠকে বসবে। অবশ্যই গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং দারিদ্র্য নিরসনে উলেল্গখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে যেন অগ্রগতি শল্গথ না হয়ে যায় সেদিকে রাজনৈতিক তদারকি নিয়মিত থাকতে হবে।
সবশেষে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, সম্মেলনে এ দাবিও উত্থাপন করা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার খাপ খাওয়ানো কার্যক্রম যুগ যুগ ধরে চলতে পারে না। উন্নত বিশ্বকে অবশ্যই এর কারণ নিরসনে অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০২০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৮৫-৯০ শতাংশ কমে আসে। অবশ্য এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার দায় রয়েছে এবং নিজ নিজ সক্ষমতার আলোকে অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ অতি সামান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করলেও ইতিমধ্যেই অর্থ ও প্রযুক্তি প্রাপ্তি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও দারিদ্র্য নিরসন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হওয়াসাপেক্ষে স্বল্প কার্বনভিত্তিক উন্নয়ন পন্থা অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ
পূর্ব হিমালয়ের চারটি দেশ_ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুবই ঝুঁকির মুখোমুখি। তবে এ অঞ্চলের দেশগুলো এবং এখানকার মানুষ এর জন্য মোটেই দায়ী নয়। দায়িত্ব উন্নত বিশ্বের। বিগত দেড়-দুইশ' বছর ধরে ওই দেশগুলো যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে আসছে তারই ফলে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে এবং সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি স্বীকৃত। তবে উন্নত বিশ্ব তাদের দায়দায়িত্ব মেনে নিলেও কর্তব্য পালনে অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস দ্রুত কমিয়ে আনা এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোকে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সমস্যা মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাস্তব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে না। অঙ্গীকার অবশ্য একেবারে কম করেনি; কিন্তু অঙ্গীকার রক্ষায় ঘাটতি বিস্তর।
পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং ছোট একটি অঞ্চলে বিশাল জনসংখ্যাসহ অন্যান্য কারণে খুবই নাজুক অবস্থায় এমনিতেই আছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এ অঞ্চলের চারটি দেশেই দারিদ্র্য প্রকট। আর দরিদ্র মানুষের ওপরই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রধানত বর্তায়। এ দেশগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও দারিদ্র্য নিরসনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরিকল্পনা এবং নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করে এলেও দারিদ্র্য এখনও প্রকটই থেকে গেছে। যদিও আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে না। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত দরিদ্রদের অতিদরিদ্র এবং অতিদরিদ্রদের নিঃস্ব মানুষের পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা করা জরুরি।
যেহেতু এ অঞ্চলের প্রত্যেক দেশই ভৌগোলিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং নানাভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীল, কাজেই এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কারণ নেই যে, দেশগুলো যদি একই সঙ্গে সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং দারিদ্র্য নিরসনে কাজ করে, তাহলে প্রত্যেক দেশই এবং প্রত্যেক দেশের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ একা চলার চেয়ে অধিকতর উপকার নিশ্চয়ই পেতে পারে। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব গবেষণা হয়েছে, তা থেকে এ বক্তব্য জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
উপযুক্ত বাস্তবতাকে ধারণ করে বছরখানেক আগে পূর্ব হিমালয়ের উলিল্গখিত চারটি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ওই লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণে থিম্পুতে একটি শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শীর্ষ বৈঠকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও জীববৈচিত্র্য_ এ চারটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়। একেকটি দেশ একেকটি বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে বিগত এক বছর ধরে একযোগে কাজ করে প্রত্যেক বিষয়ে যুগপৎ কাজ করার সম্ভাব্য ক্ষেত্র ও কৌশল চিহ্নিত করে। বাংলাদেশ পানি, ভুটান জীববৈচিত্র্য, ভারত খাদ্য নিরাপত্তা ও নেপাল জ্বালানি বিষয়ে নেতৃত্ব দেয়। প্রত্যেক বিষয়ে অবশ্য প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি সহকারে কর্মদল বা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। প্রত্যেক দলই বিভিন্ন সভায় মিলিত হয়ে করণীয় চিহ্নিত করে। সবশেষে প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধি নিয়ে শীর্ষ বৈঠকের জন্য ঘোষণাপত্র, সহযোগিতা কাঠামো এবং বাস্তবায়ন কৌশলের খসড়া তৈরি করে। আমি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রায় প্রথম থেকেই জড়িত ছিলাম ও শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করি।
১৮ নভেম্বর ২০১১ তারিখ ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে পরিবেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দলিলগুলো চূড়ান্ত করা হয়। ১৯ নভেম্বর ভুটানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াইন জিগমে ওয়াই থিনলের সভাপতিত্বে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনটি দেশের পরিবেশমন্ত্রী ও ভারতের পরিবেশ সচিব সহযোগিতা কাঠামো এবং বাস্তবায়ন কৌশলসহ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেন।
আমি মনে করি, চারটি দেশ যে এক সঙ্গে বসে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার এবং কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, তা একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে খুবই আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
কয়েকটি চিহ্নিত পদক্ষেপের কথা উলেল্গখ করা যায়। জ্বালানির ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে চারটি দেশ এক সঙ্গে কাজ করবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে_ একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে সবার জন্য জ্বালানি নিশ্চিত করা; জ্বালানির বহুমুখী সরবরাহ ও ব্যবহার; আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন এবং প্রয়োজন অনুসারে সম্প্রসারণ; জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং জ্বালানি খাতে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীলতা নিশ্চিত করা।
পানি ব্যবস্থাপনায় একযোগে কাজ করার লক্ষ্যে যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয় এগুলোর মধ্যে উলেল্গখযোগ্য হচ্ছে প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কমানো; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদ্ধতি ও কর্মসূচি গ্রহণ; পানি সংরক্ষণে লোকায়ত ও আধুনিক ব্যবহার সংমিশ্রণে পানির ব্যবহারে অপচয় রোধ; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারে সফল চর্চা ও উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং সংশিল্গল্গষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ; জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যগাথা আদান-প্রদান, বিশেষ করে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার লক্ষ্য হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় খাপ খাওয়ানোর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পরিবর্তন এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ; বিপন্ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, তথ্য ও জ্ঞান আদান-প্রদান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব হিমালয় অঞ্চলজুড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ-অঞ্চল সৃষ্টি; জীববৈচিত্র্যের সুষ্ঠু ও টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও আয় বৃদ্ধি, তথ্য ও জ্ঞান আদান-প্রদান এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক কৌশল ও পদ্ধতি নির্ধারণ।
প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রত্যেক লক্ষ্যের আওতায় উলেল্গখযোগ্য সংখ্যক পদক্ষেপ বা করণীয়ও চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেক দেশ থেকে মনোনীত প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত সমন্বয়কারী দল গৃহীত ঘোষণাপত্র ও সহযোগিতা কাঠামো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি প্রত্যেক দেশের মনোনীত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে। প্রত্যেক দেশ থেকে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে, যা সমন্বয়কারী দল মূল্যায়ন করবে। গৃহীত প্রকল্পগুলো যত দূর সম্ভব এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। তবে প্রয়োজনে অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। দ্রুত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য প্রত্যেক দেশই আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সমন্বয়কারী দলের প্রথম সভা আগামী এক বছরে থিম্পুতে অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই এ দল পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দেশেও বৈঠকে বসবে। অবশ্যই গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং দারিদ্র্য নিরসনে উলেল্গখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে যেন অগ্রগতি শল্গথ না হয়ে যায় সেদিকে রাজনৈতিক তদারকি নিয়মিত থাকতে হবে।
সবশেষে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, সম্মেলনে এ দাবিও উত্থাপন করা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার খাপ খাওয়ানো কার্যক্রম যুগ যুগ ধরে চলতে পারে না। উন্নত বিশ্বকে অবশ্যই এর কারণ নিরসনে অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০২০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৮৫-৯০ শতাংশ কমে আসে। অবশ্য এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার দায় রয়েছে এবং নিজ নিজ সক্ষমতার আলোকে অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ অতি সামান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করলেও ইতিমধ্যেই অর্থ ও প্রযুক্তি প্রাপ্তি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও দারিদ্র্য নিরসন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হওয়াসাপেক্ষে স্বল্প কার্বনভিত্তিক উন্নয়ন পন্থা অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ :অর্থনীতিবিদ চেয়ারম্যান, পিকেএসএফ
No comments