অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত by আবুল কাশেম

রাজস্ব আয় বাড়াতে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিলাসবহুল প্রসাধনসামগ্রী ও বিত্তবানদের আনা খাদ্যপণ্য। এসব পণ্যের তালিকা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।একই সঙ্গে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। সরকার আশা করছে, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও রপ্তানি বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকার নির্ভর করছে তৈরি পোশাক খাতের ওপর।


অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর ফলে চলতি অর্থবছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় হবে বলেও সরকার আশা করছে।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইও সরকারের এ উদ্যোগকে যৌক্তিক বলে মনে করছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে নতুন শুল্কহার নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ নভেম্বর কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে সরকারের আয় বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। সে বৈঠকেই ওই দুটি সিদ্ধান্ত হয়।
কোন কোন অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। আর রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা করে ঘোষণা দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন বলেন, হরলিঙ্সহ বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পাউরুটিও আমদানি হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বিলাসী প্রসাধনসামগ্রীও আসছে। এসব পণ্যের আমদানি শুল্কহার বাড়ালে অর্থবছর শেষে সরকারের রাজস্ব আয় কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, 'কোন কোন পণ্যের শুল্ক বাড়ানো যায় তার একটি তালিকা তৈরির জন্য আজ (মঙ্গলবার) সকালেই বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দিয়েছি আমি।'
বাণিজ্যসচিব জানান, চলতি অর্থবছর রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.৫ শতাংশ। অর্থবছরের চার মাস পার হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্ববাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি আয়ের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। বিশেষ করে চলমান
মন্দার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি না কমে বরং বাড়বে। গত অর্থবছরও মন্দার কারণে রপ্তানি বেড়েছিল। এ অবস্থায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরো দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এর ফলে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রা দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ ধরা হলে এ অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াবে দুই হাজার ৭৪১ কোটি ডলার। গত অর্থবছর রপ্তানি আয় হয়েছিল দুই হাজার ২৯২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮১৫ কোটি ডলার। একই সময় রপ্তানি আয় হয়েছে ৮১১ কোটি ডলার।
অন্যদিকে, চলতি অর্থবছর আমদানি শুল্ক বাবদ ১২ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা, আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ ১৩ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা ও আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক বাবদ চার হাজার ৪২০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি শুল্ক দুই হাজার ৮৯১ কোটি টাকা, ভ্যাট দুই হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ও সম্পূরক শুল্ক এক হাজার ৭১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এর অংশ হিসেবেই বাণিজ্যসচিব কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে রপ্তানি আয় ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করেন। প্রস্তাব দুটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার পর সবাই এ বিষয়ে একমত হন।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্য জাতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। বরং এটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়ে আমদানি ব্যয় স্ফীত করছে। এ মুহূর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি।'
শিল্পপতি সংগঠনের এই নেতা মনে করেন, এর ফলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষিত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্তকেও যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।
জানা যায়, আমদানি ব্যয় বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাবি্লউটিও) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারছে না। তাই আমদানি ব্যয় কমানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং বাড়তি রাজস্ব আয়ের জন্য এসব পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সম্প্রসারণের জন্য লাইসেন্স দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর, তা আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিশ্বমন্দার মধ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন বলেন, পোশাক শিল্প ভারতে বিনা শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পেয়েছে। জাপানেও রপ্তানি বাড়ছে। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতেও বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। কম দামের কারণে এসব দেশের পোশাক আমদানিকারকরা বাংলাদেশকেই বেছে নিচ্ছে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে বাণিজ্যসচিব বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সস্তা শ্রমিকের সুবিধা ভোগ করছে। তাই মন্দার সময়ে বাংলাদেশ কম দামের পোশাক সরবরাহ করে রপ্তানি বাড়াতে পারবে। রপ্তানি বাড়ার আরো একটি কারণ হলো, এখন কারখানাগুলোতে গ্রীষ্মকালীন পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই গ্রীষ্মকালীন পোশাকের দাম শীতকালীন পোশাকের চেয়ে অনেক সস্তা হয়।
গোলাম হোসেন বলেন, 'মন্দার সময় গত অর্থবছরেও রপ্তানি বেড়েছিল। এ অর্থবছরেও রপ্তানি না বাড়ার কোনো কারণ দেখছি না।'

No comments

Powered by Blogger.