হারিয়ে যাচ্ছে কত জাতের ধান!-সংরক্ষণে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে

ছোটবেলায় পড়া সেই বিখ্যাত ছড়াটির কথা মনে পড়ছে। সব ভুলে যেত বলে চাকরটি বাজারের ফর্দ মুখস্থ করতে করতে যাচ্ছিল, অবশ্য সেখানেও সে গোল বাধিয়েছিল। ফর্দটিতে ছিল, দাদখানি চাল, মসুরের ডাল, চিনিপাতা দই, ডিমভরা কই_এমন আরো কিছু জিনিস। কিন্তু এখন ঢাকার প্রধান বাজারগুলো খুঁজলেও দাদখানি চাল পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তেমনি রাজদিঘা, লক্ষ্মীদিঘা, বাঁশফুল, চিনিবিলাস_আরো কত রকমের ধান ছিল।


ধানবিজ্ঞানীদের মতে, একসময় এ দেশে উৎপাদিত হতো এমন ধানের জাত ছিল প্রায় ১৮ হাজার কিংবা তার বেশি। এখন সেসব দেশি জাতের মধ্যে শখানেক জাত কোনো রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদের কেবলই অধিক ফলনশীল জাতের ধানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। কে জানে এই শখানেক জাতও কবে হারিয়ে যাবে!
আশার কথা, মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা প্রাচীন সেসব দেশি জাতের কিছু কিছু বীজ সংরক্ষণ এবং পরীক্ষামূলক উৎপাদনও করছে। গবেষণা চলছে এসব ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে। কিন্তু সে সংখ্যা কত? ব্রি তার বীজব্যাংকে ভূমিনির্ভর প্রায় পাঁচ হাজার জাতের বীজ সংরক্ষণ করতে পেরেছে। তার পরও ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে ১৩ হাজারের বেশি ধানের জাত। এসব ধানের মধ্যে যে গুণাবলি ছিল, তা ফিরিয়ে আনাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ধান উৎপাদনকারী প্রায় সব দেশেই একই অবস্থা। স্থানীয় জাতগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও আশা জাগিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাদের সংগ্রহশালায় এক লাখ ২০ হাজারের ওপর ধানের জাত রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশেরও বহু জাত আছে।
পুরনো দিনের ধানের কথা বলতে গিয়ে পুরনো দিনের বহু মানুষ নস্টালজিক হয়ে পড়েন। সেসব ধানের কত না বৈশিষ্ট্য ছিল! কিছু ধান ছিল জমির পাশ দিয়ে গেলে সুবাসিত বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দিত। মুড়ি তৈরির জন্য বিশেষ কিছু জাতের ধান ছিল। সেই মুড়ির স্বাদ আজকালের মুড়িতে পাওয়া যায় না। তেমনি কিছু ধান ছিল ক্ষীর, পায়েশ বা সেমাইয়ের জন্য। ভালো চিঁড়ার জন্যও শালি ধানসহ বিশেষ বিশেষ ধান ছিল। কিছু ধানের বিশেষ ধরনের পিঠা এখনো জিভে জল আনে। কোথায় গেল সেসব ধান? উড়কি ধানের মুড়কি আর বিনি্ন ধানের খই কোথায় হারিয়ে গেছে! আমাদের সাহিত্যে, কবিতায়, গানে এ রকম বহু ধানের উল্লেখও রয়েছে_এ সবই কি অর্থহীন হয়ে পড়বে? শুধু নস্টালজিকতার জন্যই নয়, গবেষণার জন্যও এসব ধানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, খুঁজে বের করা এবং সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়কে পুরনো ধান সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.