নির্বাচনী আনন্দবন্যার পলল-রাজনীতি by আসিফ কবীর

ৎসবমুখর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিন সপ্তাহের বেশি পার হওয়ার পর কয়েকটি প্রতিআলোচ্য এখন আমাদের সামনে। ইলেকট্রিক ভোটিং পদ্ধতির ব্যবহার, তৈমুর আলম খন্দকারের নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে-পরের বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া, গণমাধ্যমের শক্তিমত্তা অনুভব করা ইত্যাদিই এর মধ্যে প্রধান।


ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন। এ পদ্ধতিতে ভোটারদের অভ্যস্ত হতে পারা, গৃহীত ভোটের সঠিক গণনা, সব ভোটকেন্দ্রকে এ পদ্ধতির আওতায় আনার সম্ভবপরতার প্রশ্নগুলো এ প্রসঙ্গে আলোচিত। নারায়ণগঞ্জে এ পদ্ধতির সফল প্রয়োগ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বিবৃত হয়েছে। ক্রমেই এ পদ্ধতির প্রয়োগ বাড়বে। ইতিমধ্যে নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সব কেন্দ্রকে ই-ভোটিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে ইসি জানিয়েছে। গণমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ আলোচিত ই-ভোটিং মেশিনের উদ্ভাবকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আশ্বস্ত করেছে ভোট গণনায় হেরফেরের সুযোগ বা ঝুঁকি কেন নেই এ মেশিনে। সেখানে উদ্ভাবকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইভিএম মেশিনগুলো ভোট শুরুর আগের পরীক্ষাসাপেক্ষে সচল করার পর, মাঝপথে বন্ধ বা ত্রুটি দেখা দেওয়ার সুযোগ নেই। যন্ত্রটি খুলে ফেলে অনাহূত হস্তক্ষেপে ত্রুটি তৈরি করলে ভুল গণনার ঝুঁকি একেবারে নেই।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা 'ব্রতীর' সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানি, তাদের জরিপের আওতায় সাতশ' জন ভোটারের ৮৫ ভাগ ব্যালটের চেয়ে ইভিএমকে ভালো মনে করেছেন। ৮২ ভাগ এ যন্ত্রকে নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে বুঝে নিতে হবে তাদের অধীনে নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় আসবেন নির্ঘাত, তা কিন্তু নয়। জনমতকে পক্ষে রাখতে ও টানতে না পারলে পুনর্বার ক্ষমতাসীন হওয়া যাবে না। বিরোধী দল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কট বা বাইরে থেকে গেলে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে তাও নয়। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী মোতায়েন না থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু হয়েছে ও বাধ্য হয়ে দেওয়া তার মধ্যরাতের ঘোষণাকে তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর বলে সাংবাদিকদের বলেছেন।
এ থেকে সরকারি দলের শাসন কাজে আরও সাফল্য দেখানো এবং বিরোধী দলের নির্বাচনমুখীন রাজনীতিতে ব্রতী হওয়া উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে বা নির্বাচনের বাইরে থেকে যথাক্রমে সরকারি ও বিরোধী দলের মোলায়েম পথে কোনো অর্জন হাতে এসে যাবে না। জনগণকে স্বস্তিদায়ক পরিসেবা, দেশকে দূরদর্শিতার সঙ্গে সমৃদ্ধ ও বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সম্পন্ন এবং দলীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলার নিবেদিত চেষ্টা করতে হবে মহাজোট সরকারকে। অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্য ক্ষমতায় এলে দেশ-জনগণকে আরও ভালো মর্যাদা ও জীবনমান দেওয়ার জন্য তাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রস্তুতির কথা মানুষকে জানাতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলের ব্যর্থতার জের এখনও টেনে যাওয়ায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি গ্রহণযোগ্য করতে তাদের স্বাভাবিকভাবে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকটায় তাদের অগ্রাধিকার মনোনিবেশ করা জরুরি। বরং প্রধান ইস্যু নির্বাচন বয়কট হলে তারা লাভবান হবেন না, এটা নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যার্শীদের টিভি-পত্রিকার বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রকাশমান হয়েছে।
এনসিসি নির্বাচনে কয়েকটি বিষয় ও সময় প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে ঘটে গেছে। শত শত জোড়া চোখের সতর্ক সচেতন সচকিত পাহারায় নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর সুযোগ আজ লুপ্তপ্রায়। ইলেকশন কমিশন নিজেদের সুনাম সাফল্যের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট। এ ক্ষেত্রে সচেতন ব্যক্তি হিসেবে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে নিজেদের দেদীপ্যমান স্থান লাভের ব্যাপারে কমিশনারদের আচরণও প্রাসঙ্গিক। আত্মসচেতন ব্যক্তি মাত্রই তার হাতে বা সময়কালে ভালো কাজ করার ওপর জোর দেন। আগামীতেও কমিশন পুনর্গঠনে নিজের সুনাম-সম্মান নিয়ে যত্নবান ব্যক্তিদের নিয়োগদান নিশ্চিত করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিকতার উৎকর্ষে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অনিবার্যই আরও অগ্রগামী হবে। এ নির্বাচনে বিকল্প রাজনৈতিক ধারার ধারণার সম্ভাবনা নিয়ে কথা উঠেছে। অনেকে এ থেকে প্রণোদনা লাভ করেছেন। কমিউনিস্ট রাজনীতিকরা কেউ কেউ ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর জয়লাভ থেকে শিক্ষণীয় বস্তুগুলো খুঁজতে অনুজ-আত্মজদের পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও বাস্তবতার বিচারে স্থানীয় রাজনীতি দিয়ে ১৫ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পুরোটার গতিধারা বোঝা যায় না। এক সময়ের কানসাটখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিদ্যুতের পর্যাপ্ত দাবির আন্দোলনের (২০০৫) নেতা গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী করার কথা পত্রিকান্তরে এসে এসেও হয়ে ওঠেনি। আজ দেশের মানুষ এ আলোচিত ব্যক্তিকে যথারীতি ভুলেও গেছেন। তাই অসম্ভব অনুমান বা স্বপ্নবাস না করে জাতীয় রাজনীতি ও জনসমর্থনপুষ্ট দলগুলোর দুর্বলতার গঠনমূলক সমালোচনাকেই আমাদের করণীয় হিসেবে দেখা ভালো।
গণমাধ্যমের শক্তিমানতা আমরা এ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করলাম। তাদের প্রাক্-মূল্যায়ন ও জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর যথার্থতার প্রমাণও হাতেনাতে আমরা পেলাম। আমরা প্রধান আলোচিত তিন প্রার্থীকে নিয়ে যে সংবাদ, কার্টুন, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় পাঠ করেছি তাতে মোদ্দাবার্তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিদের রাজনীতির সামনের সারি থেকে সরিয়ে নিতে প্রধান দলগুলোকে সম্মত করানোর। গণমাধ্যমের এ চাওয়াকে তীব্রতর করতে প্রাপ্যের চেয়ে অনেক গুরুত্ব ও মনোযোগও (নেতিবাচকভাবে হলেও) প্রার্থীরা পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের উপস্থাপনায় সময় সময় রুচিশীলতার ঘাটতিও লক্ষ্য করা গেছে। এককথায় গণমাধ্যম নিজেও নিরাবেগ ও পক্ষপাতমুক্ত থাকতে পারেনি। তবু তার প্রভাববিস্তারী ক্ষমতা অটুট থেকেছে। কিন্তু দেশের রাজনীতিকে নৈয়ায়িক ও আদর্শ প্রধান করে তুলতে যে মৌলিক বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া উচিত তা হলো_ রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, অসহযোগ ও বিষোদ্গারের অনুশীলন নিরুৎসাহিত করা। বর্তমানে সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে ক্লেশ স্বীকার করতে হয়, তার সমান বা কখনও বেশিও মনোযোগ দিতে হয় ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল মোকাবেলায়। গণমাধ্যম তার স্বকীয়তা
নিয়ে ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় পাশে থাকলেও কূটকৌশল প্রকাশে স্পষ্টভাষী হলে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রেই শ্লাঘনীয় অগ্রসরমানতা দেখা যাবে।

আসিফ কবীর : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.