হজ পালনে করণীয় by সৈয়দ শামসুল হুদা

মুসলমানদের পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির অন্যতম হলো হজ। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই ইবাদতে শারীরিক কষ্ট, মালের কোরবানি, সময়ের কোরবানি সবকিছুই রয়েছে। হজ পালন যেমন আনন্দের, তেমনি কষ্টের। এর বিধানাবলি যথাযথভাবে পালন করাটা গৌরবের, আনন্দের, মুক্তির, সৌভাগ্যের। যারা ঠিকমতো হজের বিধানাবলি পালন শেষে দেশে ফিরতে পারেন তাদের আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। হজের গুরুত্ব বহুমুখী।


প্রথমত, হজ আদায় করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ প্রদত্ত বড় একটি দায়িত্ব আদায় হয়, তাঁর কাছে উবুদিয়্যাত তথা দাসত্বের পূর্ণ পরীক্ষায় বান্দা উত্তীর্ণ হয়। যেভাবে আমাদের আদি পিতা ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই হজ আদায় করার দ্বারা বিশ্বের সব মুসলমানের যে মিলন ঘটে, তার কোনো তুলনা হয় না। হজকে বিশ্ব উম্মাহর মহাসম্মেলন বলা হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা বর্ণের, নানা পোশাকের, নানা সংস্কৃতির যে সংমিশ্রণ ঘটে এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। সেই দৃশ্য কিয়ামতের দৃশ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। হজের প্রতিটি কাজ আদায় করার সময় লাখ লাখ মানুষের এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, এখানে কেউ কারও দিকে দৃষ্টি দেওয়ার ফুরসত পায় না। প্রত্যেকেই মনে করে, আমি অসহায়। গায়ে সেলাই ছাড়া কাপড়, তাও আবার ধবধবে সাদা, সেটা যেন মৃত্যুর প্রস্তুতি। বাইতুল্লাহর সামনে যখন লাখ লাখ মানুষের ভিড় ঘটে, সেখানে কেউ কারও দিকে নজর দেয় না। কী এক গভীর ভাবনায় বান্দা শুধু চোখের অশ্রুই ফেলে। মনের এক করুণ আকুতি প্রত্যেকের চোখে-মুখে ঝরে পড়ে। কালো গিলাফে ঢাকা একটি ঘরের দিকে তাকিয়ে বান্দার রোনাজারি আর সে কী ক্রন্দন। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। প্রত্যেকের মুখে মুখে তখন এমনই এক তাকবির উচ্চারিত হতে থাকে, যার প্রতিটি শব্দে দাসত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহর বড়ত্ব আর বান্দার অসহায়ত্ব প্রকটভাবে তুলে ধরে এই তাকবির। বান্দা বলতে থাকে_ হে মহান আল্লাহ! আপনার কুদরতি পায়ের সামনে বান্দা হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আপনি অদ্বিতীয়, প্রশংসা-গুণকীর্তন সবই আপনার, রাজত্ব আপনার, ক্ষমতা আপনার। আমরা শুধু অসহায় বান্দা ছাড়া আর কিছুই নই। আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই, কোনো শক্তিও নেই। আমরা দুর্বল।
যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের প্রত্যেকের উচিত জীবনে একবার এই হজে গমন করা। নতুবা পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার গৌরব থেকে সে বঞ্চিত হবে। এই হজে গমন নিয়ে দুই শ্রেণীর মানুষ আমাদের সমাজে লক্ষ্য করা যায়। একটি শ্রেণী হলো_ যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে তারা সময়মতো হজ আদায় করে না। হজ পালনকে গুরুত্ব দেয় না। টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেললেও নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও এদিকটির প্রতি খেয়াল করে না। আবার আরেক শ্রেণী আছে যারা বারবার হজ আদায় করছে। একেক ব্যক্তি ২০-৩০ বার হজ আদায় করছেন। এই দুটি শ্রেণীই সঠিক কাজ করছে বলে মনে হয় না। যারা হজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালনে ঢিলেমি করেন, অথবা যাব যাব করে জীবনে আর যাওয়ার সুযোগই আসে না, তাদের মতো হতভাগ্য আর কেউ নেই। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাইতুল্লাহর কালো গিলাফ ধরে নিজেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন, যারা মহানবীর রওজার পাশে দাঁড়িয়ে একবার দরুদ শরিফ পাঠের সৌভাগ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেন, তার চেয়ে হতভাগা আর কে? অন্যদিকে যারা বারবার হজ পালন করেন, সেই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। আমরা যারা মিডিয়ার মাধ্যমে খোঁজখবর রাখি তারা জানি, হজের হুকুম-আহকামগুলো পালন করা বর্তমানে খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সৌদি বাদশাহদের পক্ষ থেকে যতই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে তাতে কোনো কষ্টই কমছে না। সামর্থ্যবান মুসলমান, যিনি জীবনে প্রথম হজে গমন করছেন, যে আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে হজে যাচ্ছেন, তিনি ঠিকমতো আদায় করতে পারছেন না হজের রুকন-আরকানগুলো। এর জন্য অন্যতম একটি প্রতিবন্ধক হলো পুরনো হাজি সাহেবান, যারা জীবনে ২০-৩০ বার হজ আদায় করেছেন। তাদের আবার কেউ কেউ এ উদ্দেশ্যেও হজে যান, তিনি যাতে গর্ব করে বলতে পারেন_ আমি জীবনে ৪০ বার হজ করেছি। শুধু অহঙ্কারের বশেও সেখানে অনেকে যান। বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে। বর্তমানে হজে এত বেশি লোকের সমাগম হচ্ছে যে, হজের রুকনগুলো পালন করতে গিয়ে অনেকে মৃত্যুর আশঙ্কাও করেন। জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন কি-না তা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকেন। এর জন্য একটি নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শীর্ষ ওলামাদের এগিয়ে আসতে হবে। কেননা এ কারণে অন্য মুসলমানদের কষ্ট হচ্ছে। একজন মানুষ ফরজ আদায় করতে মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন, আর অন্যজন প্রতিবছর নফল হজ আদায় করে ফরজ আদায়কারীর কাজে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করছেন। আমরা জানি, মসজিদে একজন ফরজ আদায়কারী নামাজির নামাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াতের মতো অত্যন্ত সওয়াবের কাজও নিষিদ্ধ। তেমনি হজ পালন সওয়াবের কাজ। তাই নফল হাজিদের ভিড়ে ফরজ আদায়কারীরা কষ্ট পাবেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত।
alhuda_wf@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.