উত্তাল মিসর

সেনাশাসন অবসানের দাবিতে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে আবারও লাখো মানুষের বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে উঠেছে মিসর। ক্ষমতাসীন সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিল এলবারাদিকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এলবারাদি এখনও প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছেন কি-না তা জানা যায়নি। এর আগে সোমবার গভীর রাতে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর অধীনে গঠিত মন্ত্রিসভা সেনাশাসন বিরোধী ব্যাপক সহিংস আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ


করেছে। পদত্যাগকারী মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে বলা হয়, দাঙ্গা পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের অব্যাহত রক্তক্ষয়ী সহিংসতা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবির মুখে তারা পদত্যাগ করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল দিনভর বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার পর সামরিক কাউন্সিল একটি আপদকালীন জাতীয় সরকার গঠনে একমত হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচিত বেসামরিক প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজন হলে গণভোট আয়োজন করা হবে বলেও সামরিক কাউন্সিল জানিয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ২৮ নভেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনও যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে বলে সামরিক কাউন্সিল প্রধান ফিল্ড মার্শাল হোসেইন তানতাবি এক টেলিভিশন ভাষণে জানিয়েছেন। মিসরের সহিংস পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
শনিবার থেকে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে সেনাশাসনের অবসান চেয়ে লাখো জনতা সহিংস বিক্ষোভে অংশ নেয়। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সংঘর্ষে ৩৫ জন নিহত ও সহস্রাধিক লোক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দাঙ্গা পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে গতকাল সকালে ইসমালিয়া শহরে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়। বিক্ষোভ কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ইসমালিয়া এবং সুয়েজ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সহিংস গণঅভ্যুত্থানে একনায়ক হোসনি মোবারকের পতনের ১০ মাসের মাথায় ফের উত্তাল হয়ে উঠেছে কায়রোর তাহরির স্কয়ার। গতকাল টানা চতুর্থ দিনে ১০ লক্ষাধিক লোক জড়ো হয় তাহরির স্কয়ারে। বিক্ষোভকারীরা ২৮ নভেম্বরের
পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, সংবিধানে বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করা না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করবে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন সুপ্রিম কাউন্সিল সংকট নিরসনে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটির সবচেয়ে সুসংগঠিত 'দ্য মুসলিম ব্রাদারহুড' আলোচনায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছে, তারা এতে অংশ নেবে। এদিকে সেনা সুপ্রিম কাউন্সিল জাতিসংঘের সাবেক পারমাণবিক পর্যবেক্ষক দলের প্রধান এলবারাদিকে নতুন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
১০ লক্ষাধিক লোকের জমায়েত : কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গতকাল ১০ লক্ষাধিক মানুষ বিক্ষোভ করেছে। কোয়ালিশন অব রেভল্যুশন ইয়ুথ এবং এপ্রিল সিক্স মুভমেন্ট মঙ্গলবার এক মিলিয়ন মানুষকে তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানায়। বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে তারা এ আহ্বান জানিয়েছে। সংযুক্ত বিপ্লবী ইয়ুথ এবং এপ্রিল সিক্স মুভমেন্ট গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর সুপ্রিম কাউন্সিল এই প্রথম বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ে। সোমবার রাত থেকেই তাহরির স্কয়ারে জড়ো হতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। গতকাল বিকেল ৪টার পর সমাবেশ শুরু হয়। গভীর রাত পর্যন্ত তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করে লাখ লাখ মানুষ। অনেকে সেখানেই রাত কাটায়।
সংকটে সুপ্রিম কাউন্সিল : চার দিনব্যাপী বিক্ষোভকারীদের সরকারবিরোধী লাগাতার আন্দোলন ও সংঘর্ষে ক্ষমতাসীন সামরিক কাউন্সিল সংকট উত্তরণে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। গতকাল কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের উদ্বেগ : যুক্তরাষ্ট্র সোমবার মিসরের সহিংস পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে যথাশিগগির সম্ভব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কারনে বলেন, মিসরে সহিংসতায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডিক্টোরিয়া নু ল্যান্ড মিসরে নির্ধারিত সময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে উদ্ধৃত করে মুখপাত্র মার্টিন নেসকি বলেন, মহাসচিব বান কি মুন মিসরে হতাহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সেখানে বেসামরিক লোকদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা চেয়েছেন।
অ্যামনেস্টির নিন্দা : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কায়রো এবং মিসরের অন্যান্য শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংস হামলার নিন্দা জানিয়েছে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, হোসনি মোবারকের শাসনামলের চেয়ে বর্তমানে মিসরে মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ক্ষমতাসীন সেনাশাসনের অধীনে মিসরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে অ্যামনেস্টি 'শোচনীয়' বলে বর্ণনা করেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার একইভাবে দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে বলে অ্যামনেস্টি মন্তব্য করে।
মুসলিম ব্রাদারহুড আলোচনায় অংশ নেবে : মিসরের বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড সুপ্রিম কাউন্সিল আহূত আলোচনায় অংশ নেবে বলে জানিয়েছে। জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টির মহাসচিব সাদ আল কাতাতানি বলেন, মঙ্গলবার সুপ্রিম কাউন্সিল বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে আমরা অংশ নেব।
আলোচনার প্রস্তাব নাকচ : তাহরির স্কয়ারে আন্দোলনরত জনতা সামরিক কাউন্সিলের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিক্ষোভকারীরা বলছে, হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখে আলোচনার প্রস্তাব অর্থহীন।
ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাবির দীর্ঘদিন ধরে মোবারক সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এখন সুপ্রিম সামরিক কাউন্সিলের প্রধান। অন্তর্বর্র্তীকালীন সেনাশাসকরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছেন বলে বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছে।
তাহরির স্কয়ার থেকে আলজাজিরার প্রতিনিধি জামাল এলশাইয়াল জানান, সেনা আদালতে বেসামরিক লোকদের বিচার কার্যক্রম পুনরায় চালু, সরকারবিরোধীদের ওপর নির্যাতন ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ঘটনার পর সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রধান ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাবির ওপর সাধারণ মিসরীয়রা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।
তাহরির স্কয়ারে প্রায় ২০ হাজার বিক্ষোভকারী তাঁবু গেড়ে রাত-দিন অবস্থান করছে। সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনের সংগঠকরা এ সংখ্যাকে লাখে পরিণত করতেই গতকাল বিকেলে গণবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যেসব বিক্ষোভকারী মোবারকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তাদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন সংগঠকরা।
শেয়ারবাজার বন্ধ ঘোষণা : গতকাল কায়রোতে প্রধান শেয়ারবাজারের সূচক ৪ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট কমে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে লেনদেন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। মিসরের প্রধান শেয়ারবাজারের ওয়েবসাইটে সূচক ১৭২ দশমিক ৮২ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৬৮৮ দশমিক ১৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। শনিবার থেকে তাহরির স্কয়ারে সহিংসতা শুরু হলে সূচক ক্রমেই কমতে থাকে। এ কারণে গতকাল লেনদেন সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.