প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আজ শুরু-অনিয়মের দায়ে ৪০০ এনজিওর সঙ্গে চুক্তি বাতিল by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
সারা দেশে গত বছর অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অনিয়মের কারণে ৪০০ এনজিওর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে মন্ত্রণালয়। কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তিনটি এনজিওকে। এ অবস্থায় এনজিও-সংশ্লিষ্টতার বাইরে থেকেই আজ বুধবার শুরু হচ্ছে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এবার পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৫ জন পরীক্ষার্থী।
সারা দেশে আজ প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীন বক্তব্য দেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদারের বক্তব্যে গত বছরের পরীক্ষায় অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে চার শ এনজিওর সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তি বাতিলের তথ্যটি বেরিয়ে আসে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, পুরনো ৬০টি উপজেলার এডুকেশন সার্ভিস প্রোভাইডার (ইএসপি) হিসেবে কর্মরত চার শ স্থানীয় এনজিওর সঙ্গে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। গত বছর যেসব ভুয়া পরীক্ষার্থী ধরা পড়েছে সেসব উপজেলায় কোনো এনজিওকে সার্ভিস চার্জ, শিক্ষককে দ্বিতীয় সেমিস্টারের বেতন এবং ভুয়া শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ভাতা দেওয়া হয়নি। ভুয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইএসপি হিসেবে তিনটি স্থানীয় এনজিওকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো_মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার সেভ আওয়ার সোসাইটি, টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার জনগোষ্ঠী উন্নয়ন ও গবেষণা পরিষদ এবং নওগাঁর পোরশা উপজেলার এএসওবি (এসোড)। জয়পুরহাটের এনজিও অ্যাসেট ও মানব সহায়ক কেন্দ্রকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ভুয়া পরীক্ষার্থী ধরা পড়ার ঘটনা নিয়ে জয়পুরহাট সদরে একটি ফৌজদারি মামলা চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, চলতি বছর থেকে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল গ্রেডে প্রকাশ করা হবে। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পরীক্ষা হবে। প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা ১৫ মিনিট অতিরিক্ত সময় পাবে। তিনি বলেন, পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তি দেওয়া হবে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বৃত্তির আওতাও বাড়ানো হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ২৩ লাখ ১৬ হাজার ২২৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ইবতেদায়িতে তিন লাখ ২০ হাজার ৯৯১ জন। এ ছাড়া চার হাজার তিনজন শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং রিচিং আউট অব চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় ঝরে পড়া ৪৫ হাজার ৬৬৫ জন পরীক্ষার্থী রয়েছে। গত বছর এ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৯।
প্রাথমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬৭ জন ছাত্র এবং ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৫৬ জন ছাত্রী। আর ইবতেদায়িতে এক লাখ ৫০ হাজার ৬৪ জন ছাত্র এবং এক লাখ ৭০ হাজার ৯৪৮ জন ছাত্রী। ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা চার হাজার ৯২০।
সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সারা দেশে কয়েক শ এনজিওর সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ছিল। কিন্তু গত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে চার শ এনজিওর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ওই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার মোট ছয় হাজার ১৭৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হবে। দুর্গম এলাকার কেন্দ্র সংখ্যা ১৭৫। দুর্গম কেন্দ্র ও বিদেশের কেন্দ্রগুলোতে আগেই প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। দেশের বাইরে আটটি পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ৬৩২ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। কেন্দ্রগুলো হলো_সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা, কাতারের দোহা, সংযুক্ত আবর আমিরাতের আবুধাবি ও রাস আল খাইমা, লিবিয়ার ত্রিপোলি, বাহরাইন এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা।
আনন্দ স্কুল : চলতি বছর দেশের ৪৪টি উপজেলায় রিচিং আউট অব চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিশুদেরও পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত স্কুলকে বলা হয় আনন্দ স্কুল। চলতি বছর প্রাথমিকের সমাপনীতে ৪৫ হাজার ৬৬৫ জন পরীক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেবে। গত বছর আনন্দ স্কুলের অধীনে অংশ নিয়েছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৬৬ জন। এক বছরে এ স্কুলের পরীক্ষার্থী কমে গেছে ৯৭ হাজার ৮০১ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্যান্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় আনন্দ স্কুলের পরীক্ষার্থী হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়। গত দুই বছর ধরে এ চিত্র চলে আসছে। পরীক্ষার দিনে তা পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে। এ অবস্থায় এবার আনন্দ স্কুলের বিষয়ে ভুয়া পরীক্ষার্থী যাতে না থাকে সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আনন্দ স্কুলের পরীক্ষার্থীদের ছবিযুক্ত প্রবেশপত্র ইস্যু করা হয় এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যর্থাথতা যাচাই করা হয়। প্রত্যেক আনন্দ স্কুলের শিক্ষক, মাস্টার ট্রেনার, শিক্ষার্থীদের ছবি ও মাতার নামসহ 'আনন্দ স্কুল প্রোফাইল' প্রণয়ন করা হয়েছে। সমাপনী পরীক্ষা চলাকালে এ প্রোফাইল যাচাই করা হবে।
এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন বলেন, গত বছর আনন্দ স্কুল নিয়ে যা হয়েছে এবার তা হবে না। আর হবে না দেখেই এ বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।
গ্রেডিং পদ্ধতি : চলতি বছর থেকে প্রথমবারের মতো এ পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়েছে। ফলে পরীক্ষার ফল থেকে বিভাগ পদ্ধতি উঠে গেল। গ্রেডিং বিন্যাস হচ্ছে_এ প্লাস (৮০-১০০), এ (৭০-৭৯), ৪ মাইনাস (৬০-৬৯), বি (৫০-৫৯), সি (৪০-৪৯), ডি (৩৩-৩৯) এবং এফ (০-৩২)। এ ছাড়া পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হবে উপজেলা সদরে বসে। শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়নের পর প্রধান পরীক্ষক তা যাচাই-বাছাই করবেন। প্রধান পরীক্ষক আসবেন অন্য উপজেলা থেকে। পরীক্ষা শেষের এক মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হবে।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষ : পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানাতে মন্ত্রণালয়ে এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের ফোন নম্বর হলো_৭১৭১৫২৬, ৯০০০৩২৬ ও ৯০১২৯২০। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরীক্ষার সময়সূচি : প্রাথমিক সমাপনীতে ২৩ নভেম্বর গণিত, ২৪ নভেম্বর বাংলা, ২৭ নভেম্বর ইংরেজি, ২৮ নভেম্বর পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান, ২৯ নভেম্বর পরিবেশ পরিচিতি সমাজ এবং ৩০ নভেম্বর ধর্ম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনীতে ২৩ নভেম্বর গণিত, ২৪ নভেম্বর বাংলা, ২৭ নভেম্বর ইংরেজি, ২৮ নভেম্বর পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান, ২৯ নভেম্বর আরবি, ৩০ নভেম্বর কুরআন ও তাজবিদ এবং আকাইদ ও ফিকহ।
No comments