নতুন দিনের স্বপ্ন আঁকা নবান্ন দিন
নতুন ধানের ঘ্রাণে এখনও গ্রামবাংলার বাতাসভরে ওঠে। বর্ষার শেষে লাগানো আমন কাটা হয় শীতের শুরুতেই। সেই নতুন ধানে তৈরি হয় খই, মুড়ি-মুড়কি আর রকমারি পিঠা-পায়েস। রাতভর চলতে থাকে গুরু-শিষ্যের লড়াই, লোকগানের আসর। নতুন ধান কাটাও রীতিমতোউৎসবের ব্যাপাররাজু আহমেদ বনিনগরজীবনের হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও একটু কৃত্রিম সুখ পাই যখন প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়গুলো চিন্তা করি। সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমিত হয় দুশ্চিন্তার বিষয়টিও।
ইভেন্ট অব দ্য উইক_ 'নতুন ধান্যে হবে নবান্ন', 'এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে'_ মাল্টি কালচারালদের বহুমাত্রিক স্টাইলিশ বাঙালি উৎসব! অগ্রহায়ণের প্রথমদিকেও তিন পাখাওয়ালা যন্ত্রটা চলতে থাকে ফুল স্পিডে। বন্ধুজন বলে_ 'ঢাকার শীত সহনীয়।' আর অঘ্র-চন্দ্রিমা টিপ্পনি কাটে হতাশা ও শঙ্কার ব্যঞ্জনে। নবান্নের ঘ্রাণ থাকে না আদৌ। কারণ এবার বাম্পার ফলন হয়নি, 'আরে ব্যাটা ডিজেলের খরচই তো উঠলু না, সারা বছর ভাত খাবো কী?' কারা নবান্নের পিঠা-মুড়কি, ক্ষীর আর ঢাকঢোল বাদনে মুখরিত করবে কারি সাহেবের ধান খোলা? ঋতু বৈচিত্র্যতার ফলে মানুষের জীবনযাপনের বড় পরিবর্তনগুলো শুধু লক্ষণীয় নয়, কার্যতও হচ্ছে!
আসলে নবান্ন এমন একটি উৎসব, যা আমাদের বাঙালি চেতনাকে খোঁচা দেয়। সাধারণভাবে আমি যদি এ উৎসবকে বলি_ 'বাংলায় আবহমান কাল থেকেই কৃষিপ্রধান এ দেশের মানুষের মাটির উৎসব নবান্ন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এতে শামিল হয় সবাই বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নতুন ধানের ঘ্রাণে এখনও গ্রামবাংলার বাতাস ভরে ওঠে। বর্ষার শেষে লাগানো আমন কাটা হয় শীতের শুরুতেই। সেই নতুন ধানে তৈরি হয় খই, মুড়ি-মুড়কি আর রকমারি পিঠা-পায়েস। রাতভর চলতে থাকে গুরু-শিষ্যের লড়াই, লোকগানের আসর। নতুন ধান কাটাও রীতিমতো উৎসবের ব্যাপার। ফজরের পরপরই কৃষকরা দলবেঁধে নেমে পড়েন সোনাভরা মাঠে। গানের সুরে ধান কাটা চলে, কাচির বিরাম নেই। ধান মাড়াই হয় গরু বা মেশিন দিয়ে। ভোর রাতে ব্যস্ত মা-বোনরা ধান সিদ্ধ করতেন। সিদ্ধ ধান উঠানে শুকিয়ে দেয় সূর্যিমামা। মেঘ মামা মাঝে মধ্যে আড়ি খেলে। থেমে নেই হাঁস-মুরগির ধান খাওয়া। অতঃপর ঢেঁকিতে ধান ভানা। কল এসে সেই ঢেঁকির আওয়াজ জাদুঘরে! রাতে নতুন চাল পানিতে ভিজিয়ে খুব ভোরে শুরু হয় চাল গুঁড়া করা। সঙ্গে মেশানো হয় নারিকেল চুর। মিশ্রণটি বেটে সঙ্গে মেশানো হয় গুড়, চিনি, দুধ। কখনওবা সঙ্গে দেওয়া হয় তাল-নারিকেলের ফোঁপরা, কচি নারিকেলের লেই, নাড়ূ, ডাবের পানি, কিশমিশ। এভাবেই নতুন অন্নের আত্মকথার সূত্রপাত বলা যেতে পারে।
সাধারণত হিন্দুরা এ নবান্ন আগে গৃহদেবতা, পিতৃপুরুষের সমাধি, গোয়ালঘর এবং কাকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। এরপর পরিবেশন করে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে। মুসলমানরা সাধারণত নতুন চালে ক্ষীর তৈরি করে গ্রামের মসজিদে সবাই একত্রে খায়। আদিবাসীদের মধ্যেও প্রচলন আছে নবান্ন উৎসবের। সাঁওতালদের এ উৎসবের নাম 'সোওরাই', গারোদের 'ওয়ানগালা'। আমাদের নাগরিক জীবনেও নবান্ন উদযাপন করা হয় বেশ ঘটা করে। শেষ রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে পড়ার সময় 'ঝড়াৎ ঝড়াৎ' শব্দ শুনতাম খোলায় ফরাশের ওপর ধান ঝাড়ছে চেঙ্গাড়ার মুনিষরা। বেলা ছোট, বিঘা জমি চুক্তি, এক দিনেই শেষ করা চাই। সেজ মা গমের রুটি আর বেগুন ঘণ্ট রান্না করতে থাকেন। কামলাদের জন্য, তার চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করতাম। এবারও যে দু'দুটো গোলা ভরবে! তারপর দাদির রেখে যাওয়া ঢাউস লোহার কড়াইয়ের বাড়ির নারিকেল মিশ্রিত ক্ষীর রান্না করে গোটা 'সাস্তির পাড়া'য় বিতরণ_ এভাবেই দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়ে দেখলাম গোয়ালের পাশে ধানের গোলা একটা নেই! 'ধান কো যে গোলা থাকপে?' সেজ মার বিরক্তিভরা উত্তর। সার, তেলের দুষ্প্রাপ্যতায় আবাদ কমিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যতার অভিশাপে ক্লান্ত মানুষ। কোনো আয়োজন নেই_ একটি উৎসবের মৃত্যু!
শিল্পায়ন হচ্ছে, মানুষ বাড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আবাসন ও যানবাহনের সংখ্যা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব উদ্বিগ্ন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপগুলোকে সঠিক করার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে আজ থেকে ৫০ বছর পর বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে এবং বাঙালি 'নবান্ন উৎসব' নামে কিছু থাকবে কি-না প্রশ্নটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রশ্নটা সামনে রেখে যদি চিন্তা করি তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তার মধ্যে প্রধানতম বৃষ্টিপাত অনিশ্চয়তা।
আমাদের কৃষি ব্যবস্থা যে অনেক অংশে বর্ষানির্ভর তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। আরেকটি কারণ ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। দেশের মৌসুমি ফসলের বিশাল ঘাটতির ফলে
খাদ্যাভাব দেখা যাবে। আর শৌখিনতার বালাই থাকবে না যদি না
পেটে ভাত না থাকে!
বর্তমান আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে সারা দুনিয়ার পুঁজিবাদী রূপান্তরের চেনা পথ শিল্পায়নের মাধ্যমে যে বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপ নিতে পারে না তা আজ পরিবেশগত বিবেচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পুঁজির ব্যবস্থার ক্ষমতা বিন্যাসও একটি সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নের উপযোগী নয়। বরং অসমতায় হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি। এ ভিত্তিমূলে আঘাত না হেনে পরিবেশগত বিপর্যয় বা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা অসম্ভব। মুনাফার জাঁতাকলে বিপন্ন প্রাণ প্রকৃতি।
এ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মানুষ আর প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার আমূল পরিবর্তন। মানুষ প্রকৃতি সম্পর্কের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর। উৎপাদন ও ভোগের বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল। পশ্চিমা জীবনধারার যে বিশ্বায়ন ঘটেছে তার খপ্পর থেকে বের হয়ে আসা। জলবায়ু সম্মেলনে ধ্বনি উঠেছে_ ঈযধহমব ঃযব ংুংঃবস, হড়ঃ ঃযব পষরসধঃব, বি হববফ ংড়পরধষ পযধহমব ঃড় ষরমযঃ পষরসধঃব পযধহমব. প্রশ্নটা কি সেই সামাজিক পরিবর্তন? কীভাবেইবা তা ঘটবে? নবান্নের উৎসবের রঙে ফিকে হয়ে আসে কথিত সামাজিক পরিবর্তনগুলো।
হসুহৃদ ঢাকা
আসলে নবান্ন এমন একটি উৎসব, যা আমাদের বাঙালি চেতনাকে খোঁচা দেয়। সাধারণভাবে আমি যদি এ উৎসবকে বলি_ 'বাংলায় আবহমান কাল থেকেই কৃষিপ্রধান এ দেশের মানুষের মাটির উৎসব নবান্ন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এতে শামিল হয় সবাই বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নতুন ধানের ঘ্রাণে এখনও গ্রামবাংলার বাতাস ভরে ওঠে। বর্ষার শেষে লাগানো আমন কাটা হয় শীতের শুরুতেই। সেই নতুন ধানে তৈরি হয় খই, মুড়ি-মুড়কি আর রকমারি পিঠা-পায়েস। রাতভর চলতে থাকে গুরু-শিষ্যের লড়াই, লোকগানের আসর। নতুন ধান কাটাও রীতিমতো উৎসবের ব্যাপার। ফজরের পরপরই কৃষকরা দলবেঁধে নেমে পড়েন সোনাভরা মাঠে। গানের সুরে ধান কাটা চলে, কাচির বিরাম নেই। ধান মাড়াই হয় গরু বা মেশিন দিয়ে। ভোর রাতে ব্যস্ত মা-বোনরা ধান সিদ্ধ করতেন। সিদ্ধ ধান উঠানে শুকিয়ে দেয় সূর্যিমামা। মেঘ মামা মাঝে মধ্যে আড়ি খেলে। থেমে নেই হাঁস-মুরগির ধান খাওয়া। অতঃপর ঢেঁকিতে ধান ভানা। কল এসে সেই ঢেঁকির আওয়াজ জাদুঘরে! রাতে নতুন চাল পানিতে ভিজিয়ে খুব ভোরে শুরু হয় চাল গুঁড়া করা। সঙ্গে মেশানো হয় নারিকেল চুর। মিশ্রণটি বেটে সঙ্গে মেশানো হয় গুড়, চিনি, দুধ। কখনওবা সঙ্গে দেওয়া হয় তাল-নারিকেলের ফোঁপরা, কচি নারিকেলের লেই, নাড়ূ, ডাবের পানি, কিশমিশ। এভাবেই নতুন অন্নের আত্মকথার সূত্রপাত বলা যেতে পারে।
সাধারণত হিন্দুরা এ নবান্ন আগে গৃহদেবতা, পিতৃপুরুষের সমাধি, গোয়ালঘর এবং কাকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। এরপর পরিবেশন করে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে। মুসলমানরা সাধারণত নতুন চালে ক্ষীর তৈরি করে গ্রামের মসজিদে সবাই একত্রে খায়। আদিবাসীদের মধ্যেও প্রচলন আছে নবান্ন উৎসবের। সাঁওতালদের এ উৎসবের নাম 'সোওরাই', গারোদের 'ওয়ানগালা'। আমাদের নাগরিক জীবনেও নবান্ন উদযাপন করা হয় বেশ ঘটা করে। শেষ রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে পড়ার সময় 'ঝড়াৎ ঝড়াৎ' শব্দ শুনতাম খোলায় ফরাশের ওপর ধান ঝাড়ছে চেঙ্গাড়ার মুনিষরা। বেলা ছোট, বিঘা জমি চুক্তি, এক দিনেই শেষ করা চাই। সেজ মা গমের রুটি আর বেগুন ঘণ্ট রান্না করতে থাকেন। কামলাদের জন্য, তার চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করতাম। এবারও যে দু'দুটো গোলা ভরবে! তারপর দাদির রেখে যাওয়া ঢাউস লোহার কড়াইয়ের বাড়ির নারিকেল মিশ্রিত ক্ষীর রান্না করে গোটা 'সাস্তির পাড়া'য় বিতরণ_ এভাবেই দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। কিছুদিন আগে বাড়ি গিয়ে দেখলাম গোয়ালের পাশে ধানের গোলা একটা নেই! 'ধান কো যে গোলা থাকপে?' সেজ মার বিরক্তিভরা উত্তর। সার, তেলের দুষ্প্রাপ্যতায় আবাদ কমিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যতার অভিশাপে ক্লান্ত মানুষ। কোনো আয়োজন নেই_ একটি উৎসবের মৃত্যু!
শিল্পায়ন হচ্ছে, মানুষ বাড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আবাসন ও যানবাহনের সংখ্যা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব উদ্বিগ্ন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপগুলোকে সঠিক করার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে আজ থেকে ৫০ বছর পর বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে এবং বাঙালি 'নবান্ন উৎসব' নামে কিছু থাকবে কি-না প্রশ্নটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রশ্নটা সামনে রেখে যদি চিন্তা করি তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তার মধ্যে প্রধানতম বৃষ্টিপাত অনিশ্চয়তা।
আমাদের কৃষি ব্যবস্থা যে অনেক অংশে বর্ষানির্ভর তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। আরেকটি কারণ ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। দেশের মৌসুমি ফসলের বিশাল ঘাটতির ফলে
খাদ্যাভাব দেখা যাবে। আর শৌখিনতার বালাই থাকবে না যদি না
পেটে ভাত না থাকে!
বর্তমান আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে সারা দুনিয়ার পুঁজিবাদী রূপান্তরের চেনা পথ শিল্পায়নের মাধ্যমে যে বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপ নিতে পারে না তা আজ পরিবেশগত বিবেচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পুঁজির ব্যবস্থার ক্ষমতা বিন্যাসও একটি সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নের উপযোগী নয়। বরং অসমতায় হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি। এ ভিত্তিমূলে আঘাত না হেনে পরিবেশগত বিপর্যয় বা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা অসম্ভব। মুনাফার জাঁতাকলে বিপন্ন প্রাণ প্রকৃতি।
এ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মানুষ আর প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার আমূল পরিবর্তন। মানুষ প্রকৃতি সম্পর্কের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর। উৎপাদন ও ভোগের বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল। পশ্চিমা জীবনধারার যে বিশ্বায়ন ঘটেছে তার খপ্পর থেকে বের হয়ে আসা। জলবায়ু সম্মেলনে ধ্বনি উঠেছে_ ঈযধহমব ঃযব ংুংঃবস, হড়ঃ ঃযব পষরসধঃব, বি হববফ ংড়পরধষ পযধহমব ঃড় ষরমযঃ পষরসধঃব পযধহমব. প্রশ্নটা কি সেই সামাজিক পরিবর্তন? কীভাবেইবা তা ঘটবে? নবান্নের উৎসবের রঙে ফিকে হয়ে আসে কথিত সামাজিক পরিবর্তনগুলো।
হসুহৃদ ঢাকা
No comments