জবাবদিহিতা জরুরি-সুশাসন by রণেশ মৈত্র

বাবদিহিতামূলক গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য যারা উপলব্ধি করেন, যারা এর প্রয়োজনীতা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, তারা অত্যন্ত উৎসাহিত বোধ করেছিলেন যখন বিগত প্রধান বিচারপতি তার সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেছিলেন এবং অতঃপর পরপর আরও তিনজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তা দাখিল করেন। তখন আমি লিখেছিলাম, একটি চমৎকার নজির সৃষ্টি হলো। এখন এটাকে কার্যকর একটি ব্যবস্থায় পরিণত করতে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টসহ অধস্তন সব বিচারক


তার এবং নিকটজনদের সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেন প্রতি বছর এবং গণমাধ্যমগুলোয় তা প্রকাশেরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, তার অবসর গ্রহণের পর আর তেমন কোনো ঘটনা ঘটল না। বিষয়টি কি এখন হিমাগারেই স্থান পেল?
কিছুদিন আগে অনুরূপ একটি খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখে উৎসাহিত বোধ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তার সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেছেন এবং তার মন্ত্রিসভার সব সদস্যকেও তা দাখিল করতে বলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই কথা অনুযায়ী কাজটি হলো কি-না তা আজও জানা গেল না। ধরে নেওয়া যায়, এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই এখন দাবি করব, প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিন, আইন করুন, যাতে মন্ত্রিসভার সব সদস্য, সংসদের সব সদস্য, বিচার বিভাগের সব সদস্য, সব সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সব কর্মকর্তা তাদের কাজে যোগদানের সময় একবার এবং পরবর্তী সময় প্রতি বছর তাদের সম্পত্তির হিসাব দাখিল করবেন ও গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তা নিয়মিত জনগণকে অবহিত করবেন। একই সঙ্গে তাদের স্ত্রী অথবা স্বামী ও ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির হিসাব এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বার্ষিক জমা-খরচ-ব্যালেন্সও জানাবেন। জবাবদিহিতার এটি একটি চমৎকার ও অনন্য নজির হতে পারে। আর এর মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপকতা বিস্তর পরিমাণে কমে আসবে নিশ্চিতভাবে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বর্তমান সরকার নির্বাচন-পূর্বকালে যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিল তাতে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল_ তারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলে বছর বছর তাদের সম্পত্তির হিসাব জনগণকে অবহিত করা হবে। ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকারের কার্যকাল তিন বছর অতিক্রম করল; কিন্তু বহু প্রতিশ্রুতির মতো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিটিও যথার্থভাবে পালনের কোনো লক্ষণ এ পর্যন্ত ফুটে উঠল না।
রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতার কোনো বিকল্প নেই। শুধু পদ্মা সেতুর ব্যাপারই নয়_ এটা দীর্ঘকাল ধরে ওপেন-সিক্রেট যে, তাবৎ নির্মাণ কাজে এবং অপরাপর উন্নয়নমূলক কাজে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই যেসব ঠিকাদার নিযুক্ত হন তার অনেক ক্ষেত্রেই বেনামিতে মন্ত্রী, এমপি, বড় বড় আমলা বা তাদের স্ত্রী, ছেলে বা ভাইবোনদের নামে ঠিকাদারি ফার্ম খুলে তার নামে বরাদ্দ পাইয়ে দেওয়া হয় এবং এভাবে বরাদ্দকৃত অর্থের একটি অংশ লোপাট হয়ে যায়। দেখা যায়, নির্দিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে বরাদ্দকৃত মোট টাকার ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। বাকিটা ভাগবাটোয়ারা করে সংশ্লিষ্টরা নিয়ে নেন। এ বিষয়টির যে সুরাহা হওয়া দরকার কোনো দলীয় বা অরাজনৈতিক সরকারকেই তা করতে দেখলাম না। কিন্তু এখানে যদি প্রকৃত অর্থে জবাবদিহিতা থাকত তাহলে এই পুকুরচুরি অব্যাহতভাবে ঘটে যেতে পারত না। নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কাজও মানসম্মত হতো এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কথা জনগণের টাকায় কোনো অপব্যয় ঘটত না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তার অধীন দফতরগুলো যে দুর্নীতির বিষে জর্জরিত তা দেশের সবারই জানা। একজন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব পদে নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, প্রমোশন প্রভৃতির কোনো কিছুই অর্থের বিনিময় ছাড়া সচরাচর ঘটে না বলে ব্যাপক অভিযোগ গুনে আসছি সেই কতকাল থেকে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততা প্রশ্নাতীত; কিন্তু তার মন্ত্রণালয় আজও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে শুনি। এদিকে আরও অনেক কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প দেখি না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তি নিয়ে যে তাণ্ডবের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে_ সে বিষয়টিও উদ্বেগের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ব্যাপকভাবে ওষুধ চুরি, ডাক্তার-নার্সদের দুর্নীতি, রোগীর প্রতি অযত্ন-অবহেলা সীমাহীন। এমনকি অতি সামান্য সময় হাসপাতালে কাজ করে তার দ্বিগুণ সময় ডাক্তাররা নানা ক্লিনিকে কাজ করছেন এবং ক্লিনিকে রোগীদের আসতে হাসপাতাল থেকেই নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
সরকারের বাজেটে প্রাধান্য দিতে হবে উৎপাদনশীল খাতে, শিক্ষা খাতে, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল করার কাজে ও বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কাজে। আশা করব, আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকেই ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটের খসড়া তৈরি করে তা নিয়ে অর্থমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, শিশু বিষয়কমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী জেলাগুলো সফর করে বাজেট প্রণয়ন কাজকে গণমুখী করতে এগিয়ে আসবেন। বছরান্তে বাজেটের কোন কোন প্রকল্প কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলো, কতটুকু হলো না, কেনইবা হলো না, কতদিনে হবে_ জনগণকে তা বোঝাবেন, জানাবেন। একেই আমরা সর্বোত্তম জবাবদিহিতা বলে বিবেচনা করতে পারি। যে সরকারগুলো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসে, জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা অবশ্যই থাকতে হবে। এটাই গণতন্ত্রের বিধান।

রণেশ মৈত্র :কলাম লেখক
raneshmsitra@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.