আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৮)-প্রিয় শহর, আদি ও অকৃত্রিম ঢাকা by আলী যাকের
ঝুনুর তখন নিজের সংসার হয়েছে। থাকত মতিঝিল কলোনিতে। ওর ওখানে গিয়ে বললাম, 'তোর এখানে আজ খাব।' ঝুনু, দিদি বা মায়ের মতোই ভালো গরুর মাংস রান্না করতে পারত। সেদিন থালা ভরে ভাত খেলাম। তারপর লম্বা একটা ঘুম। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে ভুলেই গেলাম কোনো কালে আমি চাকরি করতাম। বোনকে বিদায় জানিয়ে চললাম আমাদের এক পুরনো আড্ডায়, রমনা পার্কের রমনা রেস্টুরেন্টে। পেঁৗছেই তুমুল আড্ডা। যেন কিছুই হয়নি।
আমার ওই মানসিক অবস্থায় ওই আড্ডাগুলো আমায় অনেক শান্তি দিয়েছে। রমনা ছাড়াও আমাদের আরো একটা আড্ডা ছিল গুলিস্তান সিনেমার নিচে 'সুইট হ্যাভেন' বলে একটা রেস্টুরেন্টে। ওখানে আমাদের এক পট চায়ের সঙ্গে একটা কাপের জায়গায় তিনটা কাপ দিত। ওই রেস্টুরেন্টটা এখন আর নেই। বস্তুতপক্ষে ওই জায়গাটার চেহারাই বদলে গেছে। বড় মনঃকষ্ট হয় ওই পাড়ায় গেলে আজকাল। কেবল ওখানে কেন, গোটা ঢাকা শহর এমন বিচ্ছিরি হয়ে গেছে যে মনে হয় আমার এই প্রিয় শহর নগরে রূপান্তরিত হতে গিয়ে মাঝপথে আটকে গেছে। এ শহরটার কোনো চরিত্র নেই।
যা হোক, কী করব যখন ভাবছি তখন ভাইয়া, আমার বড় ভাই, আমায় একটা টিকিট দিলেন করাচি যাওয়ার। পিআইএর টিকিট। উদ্দেশ্য করাচি বেরিয়ে আসা। ইতিমধ্যে আমার অনার্সের ফল বেরিয়ে গেছে। আমি সেকেন্ড ক্লাস পেলাম। স্থান নবম। সেবার কেউ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। সাবসিডিয়ারি ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ফাংশনাল ইংলিশ এবং আট পেপার অনার্স ও একটা রিসার্চ মনোগ্রাফ_এসব পরীক্ষা দিয়েছি সব নিয়ম শিথিল করে, অধ্যাপক ড. মতিন চৌধুরী আর উপাচার্যের বদান্যতায়। সেবারই বোধ হয় প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রায় ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে নবম স্থান পাওয়া, একেবারে ফেলনা ফল নয়। ভাবলাম যাক, এই বিদ্যা নিয়ে একটা চাকরি জুটবে নিশ্চয়। কিন্তু কোনো কিছু নিয়ে ভাবারও কোনো মানসিক অবস্থা ছিল না। এক সন্ধ্যায় হঠাৎই ঠিক করে ফেললাম যে করাচির টিকিটটার সদ্ব্যবহার করতে হয়। তাই ঢাকার সব বন্ধন ছিন্ন করে একদিন পিআইএর সন্ধ্যার ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। পেছনে পড়ে রইল আমার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের প্রিয় শহর, আদি ও অকৃত্রিম ঢাকা।
রাত ৮টার দিকে পিআইএর বোয়িং বিমানটি যখন করাচির বিমানবন্দরে অবতরণ করল, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। করাচির বিমানবন্দর ভবনটিও ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরের তুলনায় বিশাল আকৃতির, ঝকঝকে তকতকে এবং আলোয় আলোময়। করাচিতে আমি উঠব আমার মেজ মামার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন নাসির হায়দার, যাঁকে আমরা সবুজ মামা বলে ডাকতাম, তাঁর বাসায়। তিনি তখন পিআইএর বোয়িং উড়োজাহাজের কাপ্তান। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। করাচিতে তাঁর অবস্থান। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। যে-পাড়ায় তিনি থাকতেন, সে-পাড়াটির নাম ছিল বাহাদুরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। এটি একটি নতুন আবাসিক এলাকা। প্রায় মরুভূমিকে নানা ধরনের ভবন দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ক্যাপ্টেন নাসির হায়দার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সদ্য গঠিত বাংলাদেশ বিমানের একটি ছোট ডাকোটা বিমানে আরো দুজন পাইলটকে সঙ্গে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট করাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুর্ঘটনায় ওই বিমানের সবার মৃত্যু ঘটে।
করাচি বিমানবন্দর থেকে সবুজ মামার বাড়িতে যাওয়ার জন্য পিআইএর বাসে চড়ে বসলাম। এই বাস প্রথমে নিয়ে যাবে করাচি শহরের মধ্যে অবস্থিত পিআইএর সদর দপ্তরে, সেখান থেকে নিজস্ব পরিবহনে যার যার গন্তব্যে যেতে হবে। যে রাস্তাটি করাচি বিমানবন্দর থেকে শহর পর্যন্ত আসে, তার নাম ছিল তখন ড্রিগ রোড। নামটি সম্প্রতি বদলেছে এবং নতুন নামটি মনে রাখা বড় কঠিন। ফারসি ভাষায় দেওয়া কোনো নাম। এই নাম বদলের পালা শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের আমল থেকে। ফারসি ভাষার প্রতি আইয়ুব খানের দুর্বলতা ছিল নিশ্চয়। তারই সময় পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয় 'পাক সার জমিন সাদ বাদ...' স্কুলে থাকতেই এই গান আমাদের গাইতে হতো, স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে অথবা জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে। ফারসি ভাষাকে অপছন্দ করার আমার কোনো কারণ নেই। বরং আমি জানি, ফারসি ভাষায় অসাধারণ সব সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফেরদৌসীর 'শাহনামা' এমন একটি অমর গ্রন্থ। এমনকি মোগলদের সঙ্গে এই ভাষা যখন ভারতে আসে তখন অনেক অসাধারণ কবি-সাহিত্যিক এ ভাষায় লেখালেখি করতেন। বস্তুতপক্ষে পারস্য দেশের পরেই বোধ করি পাকিস্তানে 'আশরাফ' অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ফারসি ভাষার প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। সম্রাট আকবরের সময় ফারসি ভাষার সঙ্গে হিন্দি ও আরবির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় উর্দু ভাষা। আকবর উর্দু ভাষার প্রচলন করেন যেন তাঁর নানা ভাষার সেনারা সহজে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করতে পারে। হাতে সময় যদি থাকত তাহলে এখনো আমি এই ভাষা রপ্ত করতে উদ্যোগী হতাম। এ ভাষায় অসাধারণ সব কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছিল এবং মূল ভাষায় পড়তে পারলে এসব অমর সাহিত্যের সত্যিকারের স্বাদ গ্রহণ সম্ভব। বস্তুতপক্ষে ওমর খৈয়ামের 'রুবাইয়াৎ' আমি এখনো নিয়মিত ইংরেজিতে পড়ে থাকি এবং বিশেষ আনন্দ পাই। কিন্তু পৃথিবীতে মেলা ভাষাই আছে যার ঋদ্ধ ইতিহাস এবং যে ভাষা অনেকেই রপ্ত করে থাকেন। তবে সেই ভাষা যদি অন্য কোনো অঞ্চলের জাতীয় সংগীতের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে তার কারণ আমার বোধগম্য নয়। আমরা কেউই জানতাম না আমাদের তখনকার জাতীয় সংগীতের অর্থ কী।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যা হোক, কী করব যখন ভাবছি তখন ভাইয়া, আমার বড় ভাই, আমায় একটা টিকিট দিলেন করাচি যাওয়ার। পিআইএর টিকিট। উদ্দেশ্য করাচি বেরিয়ে আসা। ইতিমধ্যে আমার অনার্সের ফল বেরিয়ে গেছে। আমি সেকেন্ড ক্লাস পেলাম। স্থান নবম। সেবার কেউ ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। সাবসিডিয়ারি ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ফাংশনাল ইংলিশ এবং আট পেপার অনার্স ও একটা রিসার্চ মনোগ্রাফ_এসব পরীক্ষা দিয়েছি সব নিয়ম শিথিল করে, অধ্যাপক ড. মতিন চৌধুরী আর উপাচার্যের বদান্যতায়। সেবারই বোধ হয় প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রায় ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে নবম স্থান পাওয়া, একেবারে ফেলনা ফল নয়। ভাবলাম যাক, এই বিদ্যা নিয়ে একটা চাকরি জুটবে নিশ্চয়। কিন্তু কোনো কিছু নিয়ে ভাবারও কোনো মানসিক অবস্থা ছিল না। এক সন্ধ্যায় হঠাৎই ঠিক করে ফেললাম যে করাচির টিকিটটার সদ্ব্যবহার করতে হয়। তাই ঢাকার সব বন্ধন ছিন্ন করে একদিন পিআইএর সন্ধ্যার ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। পেছনে পড়ে রইল আমার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের প্রিয় শহর, আদি ও অকৃত্রিম ঢাকা।
রাত ৮টার দিকে পিআইএর বোয়িং বিমানটি যখন করাচির বিমানবন্দরে অবতরণ করল, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। করাচির বিমানবন্দর ভবনটিও ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরের তুলনায় বিশাল আকৃতির, ঝকঝকে তকতকে এবং আলোয় আলোময়। করাচিতে আমি উঠব আমার মেজ মামার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন নাসির হায়দার, যাঁকে আমরা সবুজ মামা বলে ডাকতাম, তাঁর বাসায়। তিনি তখন পিআইএর বোয়িং উড়োজাহাজের কাপ্তান। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। করাচিতে তাঁর অবস্থান। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। যে-পাড়ায় তিনি থাকতেন, সে-পাড়াটির নাম ছিল বাহাদুরাবাদ হাউজিং সোসাইটি। এটি একটি নতুন আবাসিক এলাকা। প্রায় মরুভূমিকে নানা ধরনের ভবন দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ক্যাপ্টেন নাসির হায়দার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সদ্য গঠিত বাংলাদেশ বিমানের একটি ছোট ডাকোটা বিমানে আরো দুজন পাইলটকে সঙ্গে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট করাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুর্ঘটনায় ওই বিমানের সবার মৃত্যু ঘটে।
করাচি বিমানবন্দর থেকে সবুজ মামার বাড়িতে যাওয়ার জন্য পিআইএর বাসে চড়ে বসলাম। এই বাস প্রথমে নিয়ে যাবে করাচি শহরের মধ্যে অবস্থিত পিআইএর সদর দপ্তরে, সেখান থেকে নিজস্ব পরিবহনে যার যার গন্তব্যে যেতে হবে। যে রাস্তাটি করাচি বিমানবন্দর থেকে শহর পর্যন্ত আসে, তার নাম ছিল তখন ড্রিগ রোড। নামটি সম্প্রতি বদলেছে এবং নতুন নামটি মনে রাখা বড় কঠিন। ফারসি ভাষায় দেওয়া কোনো নাম। এই নাম বদলের পালা শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের আমল থেকে। ফারসি ভাষার প্রতি আইয়ুব খানের দুর্বলতা ছিল নিশ্চয়। তারই সময় পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয় 'পাক সার জমিন সাদ বাদ...' স্কুলে থাকতেই এই গান আমাদের গাইতে হতো, স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে অথবা জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে। ফারসি ভাষাকে অপছন্দ করার আমার কোনো কারণ নেই। বরং আমি জানি, ফারসি ভাষায় অসাধারণ সব সাহিত্য রচিত হয়েছে। ফেরদৌসীর 'শাহনামা' এমন একটি অমর গ্রন্থ। এমনকি মোগলদের সঙ্গে এই ভাষা যখন ভারতে আসে তখন অনেক অসাধারণ কবি-সাহিত্যিক এ ভাষায় লেখালেখি করতেন। বস্তুতপক্ষে পারস্য দেশের পরেই বোধ করি পাকিস্তানে 'আশরাফ' অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ফারসি ভাষার প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। সম্রাট আকবরের সময় ফারসি ভাষার সঙ্গে হিন্দি ও আরবির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় উর্দু ভাষা। আকবর উর্দু ভাষার প্রচলন করেন যেন তাঁর নানা ভাষার সেনারা সহজে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করতে পারে। হাতে সময় যদি থাকত তাহলে এখনো আমি এই ভাষা রপ্ত করতে উদ্যোগী হতাম। এ ভাষায় অসাধারণ সব কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছিল এবং মূল ভাষায় পড়তে পারলে এসব অমর সাহিত্যের সত্যিকারের স্বাদ গ্রহণ সম্ভব। বস্তুতপক্ষে ওমর খৈয়ামের 'রুবাইয়াৎ' আমি এখনো নিয়মিত ইংরেজিতে পড়ে থাকি এবং বিশেষ আনন্দ পাই। কিন্তু পৃথিবীতে মেলা ভাষাই আছে যার ঋদ্ধ ইতিহাস এবং যে ভাষা অনেকেই রপ্ত করে থাকেন। তবে সেই ভাষা যদি অন্য কোনো অঞ্চলের জাতীয় সংগীতের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তবে তার কারণ আমার বোধগম্য নয়। আমরা কেউই জানতাম না আমাদের তখনকার জাতীয় সংগীতের অর্থ কী।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments