চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-পাকিস্তানের মদদপুষ্ট বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী by যতীন সরকার
১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের যে অংশটি পরিচিত ছিল 'পশ্চিম পাকিস্তান' নামে, সেটিই এখন পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের কিছু মানুষের চৈতন্যের বাতায়ন উন্মুক্ত থাকলেও তাদের সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। অনুমান করতে পারি, সে সংখ্যা খুব বেশি হবে না এবং তারা সংগঠিতও নয়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানপ্রেমিক কুলাঙ্গারের সংখ্যা মোটেই কম নয় এবং তারা সাংগঠনিক শক্তিতেও একান্তই শক্তিমান।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশে তারা সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৭৩ সালেই ময়মনসিংহ শহরের দোকানপাট ও বাড়িঘরে 'মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ'_এ রকম দেয়াললিখনেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ বাঁকা কথার ভেতর তার প্রমাণ পেয়েছি।
সেই পাকিস্তান আজও (এই ২০১১ সালেও) সমানে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়েই যাচ্ছে। অনেক বিলম্বে হলেও এ দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে, তখন সেই বিচারকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকে ঠেকানোর লক্ষ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের মঞ্চে যে নাট্যদৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন, সেই দৃশ্যটি হয়তো অনেকের স্মৃতিপট থেকে আজও মুছে যায়নি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাপক আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল শক্তির চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। শেখ মুজিবকে অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ বলে জানতেন যদিও, তবু মুক্তির প্রাক্কালে তাঁকে ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানের সঙ্গে 'কোনো রকম যোগসূত্র' রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ১০ জানুয়ারিতেই ভুট্টো সাহেবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের কথা স্বাধীন বাংলার জনগণের সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভুট্টোই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা বাগিয়ে নেন এবং সর্বতোভাবে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালাতে থাকেন। ১৯৭৩ সালে ভুট্টো কর্তৃক পুনর্বিন্যস্ত পাকিস্তানের সংবিধানেও বাংলাদেশের 'পূর্ব পাকিস্তান' আখ্যা বহাল রেখে এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা হয়_'পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।'
বাংলাদেশকে কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করার_তা না পারলে এ দেশটিতে অন্তত পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনার বিস্তার ঘটানোর_প্রয়াসে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী অদ্যাবধি ক্ষান্ত হয়নি। এই অপপ্রয়াসে তারা সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশেরই ভেতরকার বিভিন্ন অপশক্তিকে। সে অপশক্তিগুলো সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকাল থেকেই নানাভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। সেসব অপশক্তির ভেতর চরম দক্ষিণপন্থীরা যেমন ছিল, তেমনই ছিল চরম বামপন্থীরাও।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের সময় যারা দৃশ্যত স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষভুক্ত রূপে সংগ্রামীদের ভেতর মহলে অবস্থান করেই প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তান ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পি বহন করে চলছিল, সেই দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যকার খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষীর প্রকৃত পরিচয় আজ আর কারোরই অজানা নয়। এ রকম আরো অন্যদের পরিচয়ও ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে 'দুই কুকুরের লড়াই' আখ্যা দিয়েছিল যে চরম বামপন্থীরা, তারা তো নিজেরাই তাদের পরিচয় প্রকাশ করেছিল। এদেরই এক গোষ্ঠীর নেতা আবদুল হক স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে বসেই ভুট্টোকে 'আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী' সম্বোধন করে চিঠি লিখতে একটুও লজ্জিত হন না। ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভুট্টোকে তিনি লেখেন_
'আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
পুতুল মুজিবচক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়্যারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।'
এই চিঠিটি আবদুল হক লিখেছিলেন ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর এক মাস পর (অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি) এটি ভুট্টোর হাতে পেঁৗছায়। চিঠিটি পেয়ে ভুট্টো এর লেখক আবদুল হককে 'সৎ লোক' বলে প্রশংসা করে তাঁকে 'কার্যকর সাহায্য' দেওয়ার নানা পথের অনুসন্ধান করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার জন্য ভুট্টোর গভীর ষড়যন্ত্রের বিবরণ অনেক গবেষকের লেখায়ই উঠে এসেছে। সেসবের সাহায্য নিয়ে সাংবাদিক সোহরাব হাসান লিখিত 'বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পাকিস্তানের যোগসূত্র' শীর্ষক একটি ছোট্ট নিবন্ধ সম্প্রতি ('মত ও পথ' ১৬ আগস্ট, ২০১১) প্রকাশিত হয়েছে। ছোট্ট হলেও নিবন্ধটি অত্যন্ত সারগর্ভ ও অনেক তথ্যসংবলিত।
যদিও স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকেন, তবু কৌশল হিসেবে নিজেই তিনি ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ দেশটিকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি জানিয়ে বসেন এবং সে বছরের জুনে ঢাকা সফরে আসেন।
সোহরাব হাসান লিখেছেন_"বাংলাদেশ সফরের আগে ভুট্টো একটি অগ্রবর্তী দল পাঠিয়েছিলেন, যারা সাবেক মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল উপহার হিসেবে বাসমতি চালও নিয়ে এসেছিল। দেশে ফিরে গিয়েও ভুট্টো বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।
বাংলাদেশের নেতা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) এসব অপতৎপরতা সম্পর্কে জানতেন। এর প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যায় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণে ও সাক্ষাৎকারে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, 'ভুট্টো সাহেব বক্তৃতা করেন, বাংলাদেশের অবস্থা কী? ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, ফ্রন্টিয়ারের অবস্থা কী? এরোপ্লেন দিয়ে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর অবস্থা কী? ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান।'
এরপর তিনি সাফ জানিয়ে দেন, আমার সম্পদ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধুত্ব হতে পারে না।"
বাংলাদেশের সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে যে ফেরত পাওয়া যায়নি, এ কথা যেমন আমাদের সবারই জানা, তেমনি জানি যে বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কেরও উন্নয়ন হয়নি। ভুট্টোর মতো পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল অনেকেই যে বাংলাদেশের পাকিস্তানি দালাল ও চামচাদের বঙ্গবন্ধু হত্যায় মদদ জুগিয়েছিল, সে বিষয়টি দেশি-বিদেশি অনেক তীক্ষ্নধী পর্যবেক্ষকের চোখেও ধরা পড়েছে। যেমন আমেরিকান গবেষক স্ট্যানলি ওলপার্ট তাঁর লেখা ভুট্টোর জীবনীতেও জানিয়েছেন, 'দুই বছর যাবৎ ভুট্টো কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তাঁর গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং এর বিনিময়ে ফল লাভ করেছিলেন।'
২০০০ সালে এই ওলপার্ট ঢাকায় এলে একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বিনিময়ে ফললাভ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? মুজিব হত্যায় কি পাকিস্তান জড়িত ছিল?' জবাবে ওলপার্ট বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, আপনি তা বলতে পারেন।'
মুজিব হত্যার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ঘাড়ে পাকিস্তানের ভূত (অর্থাৎ পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা) চেপে বসতে এবং এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হতে পেরেছে। পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক জেড এ সুলোরির মতেও মুজিব বেঁচে থাকলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক 'স্বাভাবিক হতে পারত না'। সুলেরি যে সম্পর্ককে 'স্বাভাবিক' বলেছেন, বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তিসংগ্রামীদের দৃষ্টিতে তা অবশ্যই 'অস্বাভাবিক'। এ রকম অস্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারই সুযোগ পেয়ে গেছে মুজিব হত্যার পর পাকিস্তান এবং তার বাংলাদেশি দালালরা।
এ ধরনের অস্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই কাম্য ছিল সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের শাসকগোষ্ঠীর। আমরা দেখেছি, ১৯৭৩ সালে কোনো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে সৌদি বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয় এবং তাঁকে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর অনুরোধ জানান। তখন বাদশাহ আমাদের দেশটিকে 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' করার প্রস্তাব দেন। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সে প্রস্তাব গ্রহণ করা কোনো মতেই সম্ভব ছিল না।
তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সৌদি বাদশাহ ফয়সল খুশিতে বাগবাগ হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার জবরদখলদার খন্দকার মোশতাকের কাছে বার্তা পাঠান, 'আমার প্রিয় ভাই, নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে আমি নিজের ও সৌদি জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।'
বাংলাদেশকে সরাসরি 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' ঘোষণা করা না হলেও অপরিমেয় রক্ত ও সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত এই স্বাধীন দেশটির স্বাধীনতার অন্তঃসারের প্রায় সব কিছুই ক্রমে অপহৃত হয়ে যেতে থাকে খন্দকার মোশতাক ও তাঁর উত্তরসূরি শাসকচক্রের হাতে। সেই চক্রটি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পোষ্য পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলদের মদদ নিয়েই পুষ্ট হয়ে উঠেছে এ কথা কে অস্বীকার করবে?
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments