সর্বনাশা জাহিদ by মাসুম মিজান
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব পরিচয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন হাফিজুর রহমান জাহিদ। বিত্তশালী ও সুন্দরী পাত্রীর অভিভাবকরাই ছিল তার প্রধান টার্গেট। নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে নিমেশেই তাদের মন জয় করতেন জাহিদ। এরপর শুরু হতো ওইসব পরিবারকে সর্বস্বান্ত করার অমানবিক খেলা। এভাবে গত চার বছরে অসংখ্য মেয়ের চরম সর্বনাশ করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত পাঁচটি বিয়ে ও শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি নিজের পিতার সঙ্গেও তিনি প্রতারণা করেছেন। বিদেশে পাঠানো ও সরকারি কর্মকর্তাদের বদলির কথা বলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তার গ্রেফতারের খবর পেয়ে অনেক ভুক্তভোগী ছুটে আসেন র্যাব-২-এর কার্যালয়ে। এরপর থেকে জাহিদের প্রতারণার অনেক অজানা তথ্য বের হয়ে আসছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মিথ্যা পরিচয়ে পত্রিকায় 'পাত্রী চাই' বিজ্ঞাপন দিয়ে মেয়েদের ফাঁদে ফেলার একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে গত বুধবার রাতে র্যাব-২-এর একটি বিশেষ দল রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ১৮/এ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জাহিদকে গ্রেফতার করে। পরদিন প্রতারণার দায়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএম আনোয়ার পাশা দুই বছর কারাদ দিয়ে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছেন। মিথ্যা পরিচয়ে বিয়ে করার অপরাধে হাফিজের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এবং সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। র্যাব-২-এর উপপরিচালক মেজর সাইফুল করিম জানান, একটি জাতীয় দৈনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পরিচয়ে 'পাত্রী চাই' শিরোনামে মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন হাফিজ। বিজ্ঞাপনে শিক্ষাগত যোগ্যতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি করার কথা উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বর আর বাবার নাম ছাড়া সব তথ্যই মিথ্যা। এমনকি তার জীবিত বাবাকে মৃত বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞাপনে।
বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ােগাযোগ করলে হাফিজ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। এ পর্যন্ত পাঁচটি বিয়ে করা ছাড়াও শতাধিক নারীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন হাফিজ। তাদের ১৪-১৫ জনকে বিয়ের আশ্বাসও দেওয়া হয়। হাফিজ কখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, কখনও সিনিয়র সহকারী সচিব পরিচয় দিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে চাকরি ও বিদেশে পাঠানোর কথা বলে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিলেন।
তার কাছে পাওয়া জীবনবৃত্তান্তে হাফিজ নিজের নাম লিখেছেন ড. শরিফুল ইসলাম (জাহিদ)। পদবি সিনিয়র সহকারী সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শাখা-৩ (প্রশাসন), জেলা নরসিংদী। ব্যাচ নম্বর ২১তম বিসিএস, ১৯৯৮ সাল। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯।
জীবন বৃত্তান্তে তার বাবা নজরুল ইসলাম এবং তিনি যুগ্ম সচিব ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। বড় ভাই শাহীনুর ইসলাম কর্নেল, বর্তমানে তিনি জাতিসংঘ মিশনে। বড় বোন ডা. মারিয়া ইসলাম কানাডার স্থায়ী নাগরিক। ছোট বোন সুমাইয়া ইসলাম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং ছোট ভগি্নপতি ডা. আমিনুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। 'পাত্রী চাই' বিজ্ঞাপনে জাহিদ অবিবাহিত ও ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে বলে উল্লেখ করেন। এতে আরও বলা হয়, 'প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত, মিষ্টি চেহারার অধিকারী পাত্রী চাই।' সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে সরকারি মনোগ্রাম ব্যবহার করে চার রঙের ভিজিটিং কার্ডও বানান জাহিদ। কার্ডে বাসার ঠিকানা দেওয়া হয় গুলশান-২-এর ৪১ নম্বর রোডের ৪৪ নম্বর বাড়ি।
জাহিদের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকারযুক্ত একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ-২৯-৬৯৭০) উদ্ধার করেছে র্যাব। গাড়িটির মালিক মোশতাক আরেফিন জানান, জাহিদ প্রায়ই তাদের গাড়ি ভাড়া নিতেন এবং নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করতেন। আর তিনি জাহিদকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবেই জানতেন। র্যাব কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ এসব অভিযোগ স্বীকার করে জানান, প্রতিদিন আড়াই হাজার টাকায় রেন্ট-এ কার থেকে একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করে সেটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে পাত্রীপক্ষ ফোনে যোগাযোগ করলে হাফিজ ওই গাড়িতে করেই যেতেন।
সর্বশেষ গত মাসে সাভারের অনার্স পড়ূয়া একটি মেয়েকে বিয়ে করেন জাহিদ। এই মেয়ের মামা জানান, আগামী ১৫ ডিসেম্বর তার ভাগি্নকে তুলে নেওয়ার কথা ছিল। এর আগে জাহিদ মেয়ের বাবাকে সাভারের বাড়ি বিক্রি করে দিতে বলেন। কারণ জাহিদের পরিবারের সদস্যরা ওই বাড়ির বর্তমান অবস্থা দেখলে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে বলা হয়। এছাড়া এ ক'দিনে আড়াই লাখ টাকা এই পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়। বিয়ের পর ওই মেয়েটিকে নিয়ে ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে রাত কাটান জাহিদ।
সেদিন র্যাব কার্যালয়ে ছুটে আসেন জাহিদের প্রথম স্ত্রী ও কলেজপড়ূয়া মেয়ে। প্রথম স্ত্রী জানান, নব্বইয়ের দশকে তাদের বিয়ে হয়েছে। এ সময় জাহিদ একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। পরে কয়েক বছর মালয়েশিয়া কাটিয়ে চার বছর আগে দেশে ফিরেই প্রতারণা শুরু করেন। স্ত্রী ও কলেজপড়ুয়া মেয়ে অনেক বাধা দিলেও জাহিদকে ওই পথ থেকে ফেরাতে পারেননি। এমনকি বরগুনার আমতলী গ্রামের পৈতৃক ভিটা বিক্রি করতে জাহিদ তার বাবাকে বাধ্য করেন। ওই টাকাও আত্মসাৎ করেন জাহিদ। জাহিদকে বিয়ে করে প্রতারণার শিকার আরও দুই নারী ছুটে আসেন র্যাব কার্যালয়ে। তারা অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। জাহিদের প্রতারণার শিকার কয়েকটি পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
No comments