সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ব্যাখ্যা-চার কারণে নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েন হয়নি by কাজী হাফিজ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যায়নি_নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এর ব্যাখ্যা জানিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। এতে নির্বাচন কমিশনের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কোনো আলোচনা না হওয়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিস্তারিত কর্ম-পরিকল্পনা পরে জানানো হবে বলা, সময় স্বল্পতার কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত না নিতে পারা এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনে


সেনাবাহিনী ছাড়াই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব বলে মনে করা_এই চারটি মূল কারণ তুলে ধরা হয়েছে।
সশস্ত্র বাহিনীর এই ব্যাখা নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য মনে করছে এবং কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে_সঠিকভাবে যোগাযোগের অভাব এবং ভুল বোঝাবুঝির কারণেই কমিশনের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্ভব হয়নি। এতে সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্ন তোলা ঠিক হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাবে গত ২০ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) পক্ষে বিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড প্লানিং) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান সেনা মোতায়েন না হওয়ার ব্যাখা দেন।
সশস্ত্র বাহিনীর চিঠিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করতে পারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে_ওই নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন সম্পর্কে যে পরিপত্র জারি করে, তাতে সেনাবাহিনী নিয়োগের বিস্তারিত কর্ম-পরিকল্পনা পরে জানানো হবে বলা হয়। সেনাবাহিনী নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সময় স্বল্পতার কারণে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এ ছাড়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী ছাড়াই অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সহায়তায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব।
গতকাল মঙ্গলবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এ টি এম শামসুল হুদা নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েন না করার বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর জবাব পাওয়া গেছে বলে জানান। তিনি বলেন, 'আমরা প্রথম থেকেই আর্মি দেব না বলে রব তুলেছিলাম। আর্মি চাইলে আমরা আর্মির সঙ্গে মিটিং করি। কিন্তু এবার তা করিনি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, আর্মির প্রয়োজন হবে না। আমরা একেবারে শেষ সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন। সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারও হজ করতে গিয়েছিলেন।'
তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন, ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেনি? এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, ''এ বিষয়ে 'সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে' মন্তব্য যত সহজে করা যায়, বিষয়টি তত সহজ নয়। এ ধরনের মন্তব্য অনেক চিন্তা-ভাবনা করে করা উচিত।''
আপনি কি নিজেই সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ করেননি_এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, 'আমি সেদিন (গত ২৮ অক্টোবর) সরকারের অমনোযোগিতার কথা বলেছিলাম। সংবিধান লঙ্ঘনের কথা বলিনি। কিন্তু আমার ওই দিনের বক্তব্য ভুলভাবে প্রচার করা হয়। সেদিন আমার ওই বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ একটি টিভি চ্যানেল থেকে সংগ্রহ করে দেখেছি। তাতে কোথাও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয়নি। সেনা মোতায়েন নিয়ে যা ঘটেছে, তাকে হিউম্যান ম্যানার হিসেবে দেখা উচিত।'
নির্বাচন কমিশন যেভাবে সেনা মোতায়েন চেয়েছিল গত ১৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চার কম্পানি (চার শতাধিক) সেনা চেয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। এদিন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে (পিএসও) পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, কমিশন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভোটগ্রহণের আগের দুদিন, ভোটগ্রহণের দিন এবং ভোটগ্রহণের পরের দুই দিন_মোট পাঁচদিন সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেনা নিয়োগের বিস্তারিত পরিকল্পনা (ডেপ্লয়মেন্ট প্লান) স্থানীয় এসপি, রিটার্নিং অফিসার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।
সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) নিয়োগ না করতে পারার কারণেই নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দেওয়ার আগে ১৩ অক্টোবর সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পাঁচ দিনের জন্য সেনা মোতায়েন হতে পারে। এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন সিইসি বলেছিলেন, 'এ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা আমাদের নেই।'
নির্বাচন কমিশন গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১২টি পৌরসভা এবং জাতীয় সংসদের হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ওই সময় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে এ বিষয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েও জবাব পায়নি নির্বাচন কমিশন। এতে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও ওই সময় অনেকে অভিযোগ করেন। তবে নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে যা বলা হয়েছিল সেনা মোতায়েন সম্পর্কে গত ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছিল, 'নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চার কম্পানি সেনা মোতায়েন থাকবে। এই চার কম্পানির সেনা তিনটি থানায় এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য স্থানে মোতায়েন থাকবে। সেনাবাহিনী কত দিনের জন্য নিয়োজিত থাকবে, তাদের কার্যপরিধি কি হবে অর্থাৎ সেনাবাহিনী নিয়োগের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা পরে জানানো হবে।' এর পরই ২৪ অক্টোবর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর কর্মপরিধি নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দেয়। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের কাছে পাঠানো নির্বাচন কমিশনের এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, নির্ধারিত ওই কর্মপরিধি অনুসারে চার কম্পানি সেনা সদস্যের মধ্যে এক কম্পানিকে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের রিজার্ভ রাখা হবে এবং রিজার্ভ সেনা সদস্যরা ভোটগ্রহণের দিন সকাল থেকে রিটার্নিং অফিসারের কন্ট্রোল রুমের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলবেন। তাঁরা সেখানে অনুমোদিত ব্যক্তির প্রবেশ রহিত করবেন এবং যেকোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করবেন। অন্য তিন কম্পানির মধ্যে এক কম্পানি করে সেনা সদস্য নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকার তিন থানায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকবেন। তাঁদের দায়িত্ব হবে নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে টহল দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
চিঠিতে আরো জানানো হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুসারেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
সেনা মোতায়েন না হওয়ায় সিইসি যা বলেছিলেন নাসিক নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না হওয়ায় গত ২৮ অক্টোবর সিইসি এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের অসহযোগিতা ও অমনোযোগিতাকে দায়ী করে বলেন, 'আমরা সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে চেয়েছিলাম। এ বিষয়ে ওয়াদা করেছিলাম, চেষ্টাও করেছিলাম। চার কম্পানি সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আমরা সময় মতো সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছিলাম। সে চিঠির কোনো জবাব পাইনি। জবাব পাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ, আগেও নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। জবাব ছাড়াই সেনা মোতায়েন হয়েছে। এবার আমরা দুই দিন আগে জানতে পারলাম, সেনা মোতায়েন হচ্ছে না। যদিও লিখিত এবং মৌখিকভাবে আমাদের এখনো কিছু জানানো হয়নি।'
এর পর ৩০ অক্টোবর নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে সিইসি বলেন, 'সেনাবাহিনী কেনো সরকার দেয়নি, আমাদের কাছে এখনো সে তথ্য নেই। আগেও আমি বলেছি, নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এ বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়া করতে হবে। সরকারের ব্যাখা পেলে আমরা বুঝতে পারব, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করা হয়েছে কি না। এ ধরনের ঘটনা এখনই যে ঘটেছে তা নয়। অতীতেও ঘটেছে। পুরনো ফাইল ঘেঁটে দেখেছি, ২০০৩ সালে (ইউপি নির্বাচনে) নির্বাচনে কমিশন লিখিতভাবে সেনাবাহিনী চেয়েও পায়নি। ঢাকা ১০ আসনের উপনির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা। বর্তমান সরকারের আমলেই নয়, সব সরকার আমলেই এ সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এখন যাঁরা বিরোধী দলে তাঁরা যখন সরকারে ছিলেন, তখন তাঁরাও নির্বাচন কমিশনের এ চাহিদা পূরণ করেননি। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে কি করা যায়, তা চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে হবে।'

No comments

Powered by Blogger.