সমকালীন প্রসঙ্গ-উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে কেন? by মোহাম্মদ নুরুল হক

য়াসার পানি সংকটে, প্রায়ই বিদ্যুৎ সংকটে, সাময়িকভাবে যানজট নিরসনে, জাতীয় ভোটার তালিকা তৈরির গুরুদায়িত্বে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরির মতো দায়িত্বে এবং পাহাড়সম জাতীয় বিপর্যয়গুলোতে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রয়োজনেই ডাকা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনসহ দেশের যে কোনো নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি কি জনগণের মধ্য থেকে ওঠে না? এগুলো সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বাড়তি কাজ নয়। নৈতিক দায়িত্ব


গত ১৭ অক্টোবর ২০১১ তারিখে একটি দৈনিকে 'মেট্রো রেলে বন্দুকের ছায়া' শিরোনামে লেখা পড়লাম। শুরুতেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, 'বন্দুক' প্রতীক দিয়ে কিন্তু সাধারণত সেনাবাহিনীকে বোঝায়। মেট্রো রেলের বিষয়টিতে কিন্তু সেনাবাহিনী জড়িত নয়। তাই শিরোনামে মেট্রো রেলে বিমানবাহিনীর কোনো প্রতীকের ছায়া অর্থপূর্ণ ও যথাযথ হতো বলে মনে হয়।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ টানছি। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানিক শ'র জীবনচরিত্র Field Marshal Sam Manekshaw : Soldiering with Dignity বইটিতে তার সহকর্মী অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল দীপেন্দর সিং ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানিক শ'কে উদ্ধৃত করে লিখেছেন,ÔCan those of our Political Masters who are responsible for the security and defence of this country, cross their hearts and say they have ever read a book on military history, on strategy or on weapon developments? Can they distinguish a mortar from motor, a gun from howitzer, a guerrilla from a gorilla? though a vast majority of them resembles the latterÕ (Bangladesh Defence Journal-July 2011 (Page 11). অর্থাৎ 'আমাদের ওই সব রাজনৈতিক প্রভু যারা এই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদের বুকে হাত রেখে তারা কি বলতে পারবেন যে, তারা কখনও সামরিক ইতিহাস অথবা যুদ্ধবিদ্যা অথবা রণ-চাতুর্য অথবা বিভিন্ন অস্ত্রের ক্রমোন্নয়নের ওপর লেখা একটি বইও কখনও পড়েছেন? তারা কি মর্টার ও মোটরের পার্থক্য বোঝেন? গান (এঁহ) থেকে হাউজ্জ্যার (ঐড়রিঃুবৎ) আলাদা করতে পারেন? গেরিলা যোদ্ধা ও গরিলার মধ্যে পার্থক্য বোঝেন? যদিও তাদের মধ্যে বেশিরভাগ দেখতে উলি্লখিত শেষ উদাহরণের প্রাণীর মত।'
সম্প্রতি যে স্তিমিত প্রায় বিতর্কের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আরও একটি বিখ্যাত উক্তি ও পাল্টা উক্তি উপস্থাপন না করেই পারছি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান ও কোরিয়ার ত্বরিত পুনর্গঠন নিয়ে সম্মিলিত শক্তির বিজয়ী সেনানায়ক ও তদানীন্তন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, 'ডধৎ ÔWar is a serious thing, should not be dealt by Generals.Õ ' অর্থাৎ 'যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা জেনারেলদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া উচিত না।' ওই সময় সম্মিলিত শক্তির (অষষরবফ ভড়ৎপবং) বিজয়ী জেনারেলরা কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি। জেনারেলরাও উত্তরে বলেছিলেন, 'চড়ষরঃরপং ÔPolitics is also a very serious subject, should not be dealt by Politicians only ' অর্থাৎ 'রাজনীতিও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা শুধু রাজনীতিবিদদের দ্বারাই সম্পন্ন হওয়া উচিত।' আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, যুগে যুগে এই দুই মেরুর উলি্লখিত পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জুতসই সমাধান পৃথিবীজুড়ে উন্নততর দেশসহ অনেক দেশে কিন্তু আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, ওই সময়ই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল সে দেশের একজন বিখ্যাত সেনানায়কই_ তার নাম জেনারেল আইজেন হাওয়ার। এরপরও ওরা কিন্তু দল ও মত নির্বিশেষে বক্তব্য দুটিকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে দিনের পর দিন উন্নত থেকে উন্নততরই হয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে আজও হচ্ছে। আর আমরা বাস্তবে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর ভূমিকায় থেকেও ঘাড়ের রগ বাঁকা করার প্রচেষ্টায় দিনের পর দিন কৃষ্ণ গহ্বরের (ইষধপশ যড়ষব) দিকেই ধাবিত হচ্ছি উদ্দেশ্যবিহীনভাবে।
মূল কথা হলো_ রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা, পতাকা ও দেশপ্রেম ইত্যাদি কখনোই কারও একক ঠিকাদারি নয়। আসলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কমবেশি ভালো-মন্দ সবকিছু মিশিয়েই কিন্তু এর পরিপূর্ণতা। তাই আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, দেশের সশস্ত্র বাহিনী এর বাইরে কখনোই নয়। কোনো একজন অথবা দু'জন, একটি অথবা দুটি বিষয়ে অবাস্তবতা, অসামঞ্জস্যতা, বিফলতা অথবা হঠকারিতা থাকতেই পারে। কিন্তু তার জন্য প্রতিনিয়ত সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে সকাল-বিকেল টানাহেঁচড়া করা কি সমীচীন?
আমি জানি, এ প্রসঙ্গে সামরিক শাসন এবং ১/১১-এর কথা বলা হবে এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার সশস্ত্র বাহিনীর ঘাড়ে সহজেই চাপিয়ে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কাজটি খুবই সহজ। কারণ, সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত কেউ যখন-তখন যে কোনো বক্তব্য বা পাল্টা বক্তব্য দিতে পারে না। রাষ্ট্রের নীতিগত কারণে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের। অথবা সরকারের পক্ষ থেকে আইএসপিআরের।
কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখা যাক, কেন সামরিক শাসন এবং ১/১১-এর আবির্ভাব হয়? বাস্তবতায়, বাংলাদেশের সব সামরিক শাসন এবং ১/১১-এর আবির্ভাব হয়েছে মূলত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও বেশিরভাগ বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে। রাজনীতিবিদদেরই স্থূল স্বার্থে। এর সঙ্গে সবসময়ই যুক্ত ছিল সুশীল সমাজের অনেক বোদ্ধা।
আলোচ্য লেখায় ডিজিএফআইকে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানের আইএসআইর আদলে তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ডিজিএফআই তো নিজেরা নিজেদের তৈরি করে না বা করতে পারেও না। আর আইএসপিআরও তাই। এই সংস্থা দুটি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি অংশ। বলা যায়, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীনে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই হলেন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তাহলে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নীতিগত ব্যর্থতার দায়ভার কেবলই সশস্ত্র বাহিনীর ওপর চাপবে কেন? এটা 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে'র মতো ব্যাপার হলো না?
বস্তুত ডিজিএফআই ও আইএসপিআর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর দৈনন্দিন কার্যক্রম দেশে সামরিক শাসনের জন্য মূলত দায়ী দেশের ওই সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকার, বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা, বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো ও সুশীল সমাজের বেশ বড় একটা অংশ। কাজেই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স পরিবর্তনের দায়ভার এককভাবে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর বর্তাবে কেন? আর আলোচ্য লেখায় সশস্ত্র বাহিনীর বেতন অনেক বাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টিও সত্যের অপলাপ মাত্র।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে কখনোই এককভাবে সশস্ত্র বাহিনীর বেতন বাড়ানো হয়নি। সবসময়ই সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জাতীয় পে-কমিশনের মাধ্যমে সবারই বেতন তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেখানে সশস্ত্র বাহিনীও সবসময়ই অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সশস্ত্র বাহিনী থেকে জনপ্রশাসনে কে কোথায় নিয়োজিত হবে তা সরকারের বিবেচ্য বিষয়। আমার জানা মতে, জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজনের তাগিদেই এসব নিয়োগ দিয়ে থাকে।
ওয়াসার পানি সংকটে, প্রায়ই বিদ্যুৎ সংকটে, সাময়িকভাবে যানজট নিরসনে, জাতীয় ভোটার তালিকা তৈরির গুরুদায়িত্বে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরির মতো দায়িত্বে এবং পাহাড়সম জাতীয় বিপর্যয়গুলোতে সশস্ত্র বাহিনীকে প্রয়োজনেই ডাকা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনসহ দেশের যে কোনো নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি কি জনগণের মধ্য থেকে ওঠে না?
অবসরপ্রাপ্ত একজন সৈনিক হিসেবে আমি জোর গলায় বলতে চাই, এগুলো সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বাড়তি কাজ নয়। নৈতিক দায়িত্ব। যে কোনো দৈব-দুর্বিপাক এবং জাতীয় কঠিন সময়গুলোর মধ্যে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সদা নিবেদিত বলেই অদ্যাবধি প্রমাণিত এবং বাংলাদেশের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের সামগ্রিকভাবে আস্থা অর্জন করেই চলেছে।

ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নুরুল হক, পিএসসি : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
haquenoor@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.