রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বেসরকারীকরণ by আবুল কাসেম হায়দার

দেশের শিল্প খাত বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক পরিমাণ মিল-কারখানার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাঁচ বছর যাবৎ দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে নতুন কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমানে দেশে নেই বললেই চলে।অন্যদিকে সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চিত্র আরো করুণ। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র নিয়ে কিছু পর্যালোচনা দরকার।


বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। বস্ত্র ও পাট এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ৩৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৪টিই লোকসানে চলছে। ১৩টি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকার মতো। দায়দেনার পরিমাণ সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার ওপরে। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান সার্বিক অবস্থা জানার জন্য প্রাইভেটাইজেশন কমিশন সরেজমিনে গিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। 'সমীক্ষা প্রতিবেদন-১১' নামে এ প্রতিবেদন কমিশনের পক্ষ থেকে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে।
প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিল এ প্রসঙ্গে জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন নেই, অভ্যন্তরীণ চাহিদা কিংবা রপ্তানি কিছুতেই কোনো অবদান নেই, কর্মসংস্থান নেই, আছে লোকসান। লোকসানি এসব প্রতিষ্ঠান পাহারা দিতে চলছে ব্যয়ের উৎসব। মির্জা জলিল বলেন, 'দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার মেশিনারিজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান আর কোনোভাবেই চালু করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ সাশ্রয়ের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের মাধ্যমে চালু করা জরুরি। আমাদের গরিব দেশের পক্ষে বছরের পর বছর এসব লোকসানি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দায়দেনা এবং লোকসান বহন করা সম্ভব নয়।' সূত্র জানায়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ টেঙ্টাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি) পরিচালিত ১৫টি টেঙ্টাইল মিল পরিদর্শন করে সমীক্ষা দল। এর মধ্যে একমাত্র তালিকা উলেন মিলস করপোরেশন বর্তমানে চালু অবস্থায় পাওয়া গেছে। পাঁচটি মিল আংশিকভাবে সার্ভিস চার্জে চলছে। সার্ভিস চার্জে চলা পাঁচটির মধ্যে চারটিই লোকসান দিচ্ছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো না লাভ না ক্ষতির ভিত্তিতে চলছে। টেঙ্টাইল মিলস করপোরেশন পরিচালিত বাকি ৯টি মিল বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তালিকায় উলেন মিলসহ বন্ধ ১৪ মিলের দায়দেনার পরিমাণ ৮৮২ কোটি ১৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। খুলনা টেঙ্টাইল মিলের দায়দেনার তথ্য পাওয়া যায়নি। টেঙ্টাইল মিলস করপোরেশনের অধীনে এই ১৫ মিলের মধ্যে ১২টির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৮৬২ কোটি দুই লাখ ১৯ হাজার টাকা। এ খাতের অবশিষ্ট তিনটি মিলের আর্থিক লোকসানের তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে রাজশাহী জুট মিলের দায়দেনার পরিমাণ ১৯৪ কোটি ১৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) পরিচালিত কাগজ, চামড়া, সিমেন্ট খাতের মোট ৯টি মিলের চলতি ও দীর্ঘমেয়াদি এবং অন্যান্য মিলে দায়দেনার পরিমাণ এক হাজার ৯৭৩ কোটি ৫১ লাখ ২১ হাজার টাকা। পরিদর্শনকৃত ৯টির মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। চালু পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই লোকসানি। উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরির করপোরেশনের অধীনে এ আটটি প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ এক হাজার ২১০ কোটি ৩৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা পরিচালিত চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দায়দেনার পরিমাণ ৪৬০ কোটি ৭৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। পরিদর্শনকৃত এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি লাভজনক এবং একমাত্র চট্টগ্রাম ড্রাইডকের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৫৯৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অবশিষ্ট তিন প্রতিষ্ঠানের লাভের পরিমাণ ৩১ কোটি ৭৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বন্ধ ১০টি মিলের সব কয়টি চালু অবস্থায় থাকলেও ৯টিই লোকসানি প্রতিষ্ঠান। কেরু অ্যান্ড কম্পানি এ খাতের একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান। চালু বাকি ৯ প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৮২৯ কোটি ৪২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। সমীক্ষা দলের পরিদর্শনকৃত ছয়টি মিলের দায়দেনার পরিমাণ ৭৯৪টি কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। সমীক্ষা দল বাকি চারটি মিলের প্রকৃত দায়দেনার হিসাব উদ্ধার করতে পারেনি।
উত্তরণের উপায় : ১. বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু বন্ধ শিল্প-কারখানা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক ক্রেডিট অর্জন করা। বাস্তবে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই কালবিলম্ব না করে দ্রুত সব রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানাকে বিরাষ্ট্রীকরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ১৯৭২ সালে তখনকার সরকার না বুঝে সব শিল্প-কারখানা ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয়করণ করে। পরে ১৯৭৫ সালের পর সরকার আবার সব সরকারি শিল্প-কারখানার লোকসান থেকে বাঁচার জন্য বিরাষ্ট্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিগত বছরগুলোতে ধীরে ধীরে অনেক শিল্প-কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সরকারও কোটি কোটি টাকার লোকসান থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে বর্তমান শিল্পমন্ত্রী ও সরকার, ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা শিল্প-কারখানা বিরাষ্ট্রীকরণ প্রক্রিয়াকে ধীরগতিতে নিয়ে আসে। তাতে জাতীয়ভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। ২. প্রধানমন্ত্রীকে বিরাষ্ট্রীকরণ বিষয়টি ভালোভাবে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুবা দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ইতিমধ্যে দেশের বৃহত্তর পুঁজিবাজার ধ্বংসের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছে। কোনো উদ্যোগই পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে পারছে না। তেমনি সরকারি শিল্প-কারখানাগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসানে দেশের পুরো অর্থনীতি বিশাল ক্ষতিতে পড়ে যাবে। তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেসরকারীকরণ উদ্যোগকে দ্রুতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। ৩. বেসরকারি শিল্প কমিশনকে আরো বেশি শক্তিশালী হতে হবে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ঠিক সময়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের সচেতন মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। এই প্রতিবেদনের পরও যদি সরকার তাদের কাজ বন্ধ করে রাখে, তাহলে জাতি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ৪. রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনোভাবেই লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণ করা যাবে না। সত্যিকার অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে সব লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। ৫. দুর্নীতিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতে হবে। বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়ায় নানা দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেওয়া সহজ। অতীতে বহু দুর্নীতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও কর্মকর্তাদের সৎ হতে হবে। দেশের স্বার্থে দুর্নীতি যাতে কেউ করতে না পারে, তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি সজাগ থাকতে হবে। যদি আমাদের দেশের মন্ত্রী, এমপিরা দুর্নীতিমুক্ত হতে পারেন বা থাকেন, তাহলে দেশ থেকে সহজে ৭০ শতাংশ দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ দুর্নীতি দূর করতে হবে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতি এই আশা করতেই পারে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম দেশে পরিণত হতে হলে দুর্নীতি ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে প্রধান শত্রু হিসেবে গ্রহণ করে বাস্তব উদ্যোগ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

No comments

Powered by Blogger.