ঐতিহ্য-আহছান মঞ্জিল জাদুঘর আসছে নতুন রূপে by নওশাদ জামিল

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী আহছান মঞ্জিল জাদুঘর দেখা যাবে নতুন রূপে। জাতীয় জাদুঘরের পর ডিজিটাইজড হচ্ছে এ জাদুঘরও। এর সুবাদে জাদুঘরের গ্যালারিতে স্থান পাওয়া নিদর্শনগুলো ইন্টারনেটে দেখার সুযোগ হবে।সরেজমিনে দেখা যায়, ডিজিটাইজ করার লক্ষ্যে আহছান মঞ্জিল জাদুঘরের গ্যালারিগুলো সাজানো হয়েছে নতুন রূপে। আগের ২৩ গ্যালারির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন ১১টি গ্যালারি। সেসব গ্যালারির জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে ৯২টি নিদর্শন।


এ ছাড়া ভবিষ্যতে আহছান মঞ্জিলের অন্দর মহলের কক্ষগুলোতে নতুনভাবে নিদর্শন উপস্থাপনের চিন্তাভাবনা আছে। প্রাঙ্গণের চারদিকে পায়ে চলার পথ এবং কয়েকটি ফোয়ারা নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে।
আহছান মঞ্জিল জাদুঘরের উপসংরক্ষক ড. মোহাম্মদ আলমগীর কালের কণ্ঠকে জানান, জাদুঘরের আধুনিকায়নে প্রাথমিকভাবে সোয়া দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রংমহলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টি কক্ষে প্রদর্শনী গ্যালারি নতুন করে সাজানো হয়েছে। আরো ১১টি গ্যালারি নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। আপাতত ২০টি গ্যালারি খুলে দেওয়া হয়েছে। এর ৯টি গ্যালারি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিৎজকপের তোলা আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো। এগুলো হলো : খাবার ঘর, বিলিয়ার্ড কক্ষ, হিন্দুস্তানি কক্ষ, কাঠের সিঁড়িঘর, পাঠাগার, তাস খেলার ঘর, অতিথিদের শয়ন কক্ষ, বসার ঘর ও নাচঘর। তিনি আরো জানান, ঢাকার নবাব এস্টেটের পুরনো অফিস 'এডওয়ার্ড হাউস' থেকেও কিছু জিনিস সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ফ্রিৎজকপের তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নকশা করে প্রয়োজনীয় আসবাব তৈরি করে প্রদর্শনী কক্ষ সাজানো হয়েছে। বাকি কক্ষগুলোও ভবনের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল রেখে সাজানো হয়েছে।
জাদুঘর তথ্য যোগাযোগ ও ডিজিটাইজেশন কার্যক্রমের পরিচালক ড. শিখা নূর মুন্সী গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, আহছান মঞ্জিল জাদুঘর ডিজিটাইজড করার কাজ শুরু হয়েছে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে। প্রাথমিকভাবে ডকুমেন্টেশন কার্যক্রম চলছে। আগামী বছরের জুন মাস নাগাদ কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরো জানান, ডিজিটাইজড করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিদর্শনের আইডি, মানবসম্পদ তথ্য, অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজমেন্ট, ডায়নামিক ওয়েবসাইট, লাইব্রেরি ও আর্কাইভস ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা। এ কাজগুলো শেষ হলে এমআইএস ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে ওয়েবসাইট তৈরি করা হবে।
জানা যায়, বর্তমানে জাদুঘরের ২৩টি গ্যালারিতে নবাবদের ব্যবহৃত তিন হাজার ১৮৯টি নিদর্শন রয়েছে। সম্প্রতি নবাব পরিবারের সদস্যদের থেকে অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করা হয়েছে আরো ৯২টি তৈজসপত্র। সব মিলিয়ে বর্তমানে এ জাদুঘরে নিদর্শন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২৮১টি। এর মধ্যে নির্বাচিত নিদর্শনগুলো ইন্টারনেটে দেখানোর ব্যবস্থা থাকছে।
আহছান মঞ্জিল জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম আজিজুর রহমান জানান, শুধু আহছান মঞ্জিল জাদুঘর নয়, জাতীয় জাদুঘরসহ দেশের সব জাদুঘরকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে এসব কার্যক্রম শেষ হবে।
এদিকে আহছান মঞ্জিলের ভেতরে সংস্কার হলেও বাইরের অংশে তেমন উন্নয়ন দেখা যায়নি। আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সুউচ্চ ভবন। দেয়াল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু অস্থায়ী দোকানপাট। পশ্চিম ফটকের পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ভবনের সামনের দিকে অর্থাৎ বুড়িগঙ্গামুখী দরজাটি বন্ধ। দেয়াল ঘেঁষে মলমূত্র ও আবর্জনার জঞ্জাল।
এ ব্যাপারে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক প্রকাশ চন্দ্র দাস জানান, তাঁরা আহছান মঞ্জিলের ঐতিহ্য রক্ষায় আশপাশের জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। উপসংরক্ষক ড. আলমগীর বলেন, আহছান মঞ্জিলের পাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের বিষয়টি অবহিত করে এর আগে রাজউকসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফল হয়নি।
পেছন ফিরে দেখা : ঢাকায় উনিশ শতকে ধ্রুপদি বৈশিষ্ট্যে নির্মিত একটি অনবদ্য স্থাপত্য নিদর্শন আহছান মঞ্জিল। ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণাংশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই সুরম্য অট্টালিকাটি নির্মাণ করা হয়। নবাব খাজা আবদুল গনি একটি ফরাসি কুঠি পরিবর্ধন করে এই বৃহৎ ও অনুপম প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এবং শেষ হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। ইংরেজদের বিখ্যাত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মার্টিন অ্যান্ড কম্পানি ভবনটির নির্মাণকাজ করে। নবাব আবদুল গনি তাঁর ছেলে খাজা আহছানউল্লাহর নামে প্রাসাদটির নামকরণ করেন 'আহছান মঞ্জিল'। ১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল টর্নেডোর আঘাতে আহছান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে নবাব আহছানউল্লাহ দেশের খ্যাতনামা প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়কে দিয়ে এটি পুনর্নির্মাণ করান।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর নবাব পরিবারের উত্তরাধিকারীরা অর্থাভাবে ভবনটি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহছান মঞ্জিলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর প্রাসাদটি বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেন। একই সঙ্গে তিনি এটিকে সংরক্ষণ করে সেখানে জাদুঘর ও পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ঢাকা জাদুঘরের পক্ষ থেকে এক কোটি ৬৪ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের পর ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহছান মঞ্জিল জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.