সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও বাস্তবতা by তানিম ইশতিয়াক

গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদ হচ্ছে প্রধান স্তম্ভ। সংসদ সদস্যরা এর প্রাণ। আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং সরকারের জবাবদিহিতা_ এই তিন ধরনের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের চর্চা ও গুরুত্ব বজায় রাখেন সংসদ সদস্যরা।
সংসদ সদস্যরা নিয়মিতভাবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেন এবং জাতীয় সংসদের কার্যবিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে থাকেন।কিন্তু আমাদের দেশে এসব কি আমরা সচরাচর দেখতে পাই?
এক্ষেত্রে বিরোধী দলের কথা তো বলাই বাহুল্য। সামান্য অজুহাতে তারা সংসদ বর্জন করছেন দিনের পর দিন। অথচ বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুবিধা গ্রহণে ভুল করছেন না। এ জন্য সরকারি দলের আচরণ খানিকটা দায়ী। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দল পার্লামেন্ট পরিচালনায় তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বিরোধী দল বা লঘিষ্ঠ দলের কণ্ঠ রোধ হবে। পঞ্চম সংসদ চলাকালে বিএনপি, সপ্তম সংসদে আওয়ামী লীগ, অষ্টম সংসদে আবার বিএনপি বিরোধী দলকে উপযুক্ত সময় ও সুবিধা দেয়নি। বর্তমান সংসদেও সে ধারা অব্যাহত আছে। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত আটটি সংসদে বেসরকারি সদস্যদের উত্থাপিত মোট ২৫৫টি বিলের মধ্যে পাস হয়েছে মাত্র ছয়টি। পাস হওয়া বিলগুলোর বেশির ভাগই আবার শাসক দলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। চলতি সংসদে ১৪টি বেসরকারি বিল উত্থাপনের একটি পাস হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সমীক্ষার কথা আমরা জানি। যেটা নিয়ে সম্প্রতি সংসদে বেশ তোলপাড় হয়েছে। টিআইবির সে সমীক্ষায় জাতীয় সংসদের সদস্যদের আইন ও সংসদবহির্ভূত কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত থাকার একটি দুঃখজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। 'নবম জাতীয় সংসদের সদস্যদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা পর্যালোচনা' শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলা হয়, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মোট কার্যদিবসের ৭৮ শতাংশ বর্জন সংসদের প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালনে অন্যতম অন্তরায়। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের পদটিকে অনেকেই লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করার কারণে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছেন।
সংসদ সদস্যদের এমন চিত্রের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই, সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য সংসদের কার্যক্রমে সদস্যদের নিয়মিত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু সে জন্য তাদের যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকতে হবে। আমাদের দেশে রাজনীতি একটা ব্যবসার মতো হয়ে উঠেছে অথবা ব্যবসায়ীরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রথম সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ছিল ১৭.৫ শতাংশ। অষ্টম সংসদে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশ। বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ী আছেন ১৬৯ জন।
এ সংসদের প্রথম দুই বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সংসদে পাস হওয়া ৪০টি বিল কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই 'হ্যাঁ' উক্তির মাধ্যমে কর্তব্য শেষ করেছেন এমপিরা। ১১৩টি বিলের ব্যাপারে বিরোধী দলের দেওয়া নোটিশ নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি। বিরোধী দল ছাড়াও অনেক সদস্য সংসদেই যাচ্ছেন না। কোনো কোনো বৈঠকে প্রথম সারির ৩০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন উপস্থিত। এমনকি প্রস্তাব উত্থাপনের তালিকাভুক্ত পাঁচজনের চারজনই অনুপস্থিত।
অন্যদিকে আছে অনুচ্ছেদ ৭০। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এটি যুক্ত করা হলেও সংসদ সদস্যরা মুক্তচিত্তে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন না (অনেক ক্ষেত্রে পারেন না দলনেত্রীর ভয়ে)। সরকারের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নীতিগত, বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বপূর্ণ বিরোধিতা বা সমালোচনা হয় না। সদস্যরা বিলগুলো আলোচনার বা সংশোধনের সুযোগ পেয়েছে কম। সব শাসনামলেই সংসদে যে আকারে বিল উত্থাপিত হয়েছে, সে আকারেই পাস হয়ে গেছে। সংসদ হয়েছে 'রাবার স্টাম্প'।
দক্ষ ও যোগ্য পার্লামেন্টারিয়ান হওয়া একটি দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা ও অনুশীলনের ব্যাপার। বাংলাদেশের তরুণ সংসদের অনেকের মধ্যেই দ্রুত ও কম পরিশ্রমে সংসদীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক জীবনে সাফল্য লাভের প্রবণতা বিদ্যমান। এ থেকে মুক্ত হয়ে দেশসেবার আন্তরিক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আগ্রহ ও যোগ্যতা বিবেচনা করে তাদের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা থাকা উচিত। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র মূল্যবোধ চর্চার প্রসার ঘটিয়ে এবং শীর্ষ নেতৃত্বকে তাৎক্ষণিক দলীয় ও উপদলীয় স্বার্থ অগ্রাহ্য করে যোগ্য, আগ্রহী ও প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তিরা যাতে মনোনয়ন পান সেদিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। এমন সংসদ সদস্যদের নিয়েই সরকারি দল রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতা এবং জনগণের ভালোবাসা পেতে পারে।
য়তানিম ইশতিয়াক :শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
tanim.ishtiak@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.