নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজেডি-জীবন-ছন্দ ফিরুক পোশাকশিল্পে
সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডের পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলেও আশুলিয়া এবং গার্মেন্ট শিল্পের প্রধান প্রধান কেন্দ্রে এখনও আগুন-আতঙ্ক কাটেনি। সামান্য ধোঁয়া বা গুজবেও শ্রমিকরা আতঙ্কিত বা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। চলছে খণ্ড মিছিল, অবরোধ; এমনকি রাজপথে ভাংচুর।
দায়দায়িত্ব না নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও লক্ষণীয়। তৈরি পোশাক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতৃত্ব এবং সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিক নিহতদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। সরকার ও মালিকপক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কিছু ক্ষতিপূরণও প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানাগুলোতে শ্রমের পরিবেশ উন্নত এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে সম্ভাব্য সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও এ নিশ্চয়তা মিলছে না যে, আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন পোশাক শিল্প দুঃস্বপ্নের দিন চিরতরে পেছনে ফেলে এসেছে। নতুন কোন কারখানায় অভিশাপ নেমে আসবে, আগুন লেগে কিংবা অন্য কোনো আতঙ্কে পদপিষ্ট হয়ে দলে দলে শ্রমিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে_ এমন শঙ্কা প্রবল। জীবনের মূল্য কি কেবলই লাখখানেক টাকা_ কাজ করতে করতেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া শ্রমিকের পরিবার যখন এ প্রশ্ন তোলে, তার জবাব কারও জানা নেই। আমাদের পোশাকের প্রধান ক্রেতাদের কাছ থেকেও আসছে চরম সতর্কবার্তা। কেউ বাংলাদেশকে নেতিবাচক তালিকায় ফেলতে চাইছে। কেউবা দেখেশুনে চলার কথা বলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা তাজরীনের ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিশেষভাবে বলেছেন শ্রমের পরিবেশ উন্নত করার কথা। অবশ্যই এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। উন্নত বিশ্বের ক্রেতারা এখন কেবল সস্তায় পোশাক পেয়েই সন্তুষ্ট হয় না। যারা তা তৈরি করছে তাদের বেতন-ভাতা ঠিকঠাক দেওয়া হয় কি-না, কাজের পরিবেশ কেমন_ এসব বিষয়েও তারা খোঁজখবর রাখে। তাদের অনেকের কাছেই কারখানার 'কমপ্লায়ান্স' বা অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হচ্ছে অপরিহার্য শর্ত। এসব উপেক্ষা করলে আমাদের পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ বাজার ক্রমে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তবে কেবল বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্যই কমপ্লায়েন্স_ এ মনোভাবও ঠিক নয়। পোশাকের কারখানাগুলোতে যদি শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা ও আনন্দদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে উৎপাদনশীলতা অবশ্যই বাড়বে এবং তার সুফল ভোগ করতে পারবে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই। সার্বিক অর্থনীতিও এতে উপকৃত হবে। এসব কাজের প্রধান দায় অবশ্যই মালিকপক্ষের। তাদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতৃত্বেরও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। নামকাওয়াস্তে কমপ্লায়েন্সকে এখন আর কেউই মেনে নিতে চাইবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ এবং সড়ক-রেল যোগাযোগ ও বন্দর সুবিধা উন্নত হলে ব্যবসার সার্বিক ব্যয় কমে আসবে এবং এ অবস্থায় মালিকরা নিজ নিজ কারখানায় শ্রমের পরিবেশ অধিকতর উন্নত করায় মনোযোগী হতে পারবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পৃথক পোশাক পল্লী স্থাপনের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণে সরকারকেই নিতে হবে মুখ্য ভূমিকা। এটা মনে রাখতে হবে যে, শিল্পের স্বার্থ এখন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। এখানে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিল্পের প্রাণ হিসেবে পরিচিত লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাও আর চলতে দেওয়া যায় না।
No comments