চারুশিল্প: গ্যালারি কায়ায় কলকাতার ছয় ছাপচিত্রীর শিল্পকর্ম- ছাপাই ছবি by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
২৪ নভেম্বর গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে কলকাতার ছয় ছাপচিত্রীর প্রদর্শনী। কলকাতার শিল্পীদের ছাপচিত্রের দক্ষতা সম্পর্কে আরও বেশি নিশ্চিত হওয়া যায় এ প্রদর্শনীর ছয়জন শিল্পীর ৫২টি কাজ দেখে। কাঠখোদাই, এচিং বা ধাতু-তক্ষণ মাধ্যমে আঁকা ছাপচিত্রে রং ও বিষয়ের নিরীক্ষায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনযাপন, জীবনবোধ, কলকাতার গ্রামীণ জনপদের রোজকার মুহূর্ত।
ছয়জন শিল্পীর মধ্যে হরেন দাস ১৯৯৩ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অন্য পাঁচ শিল্পীর মধ্যে আশির দশকের দুজন শিল্পী রয়েছেন। শিল্প নির্মাণের ভাবনা ও কৌশলে দুই প্রজন্মের প্রকাশক্ষমতা বোঝা যায় এ প্রদর্শনীর কাজগুলো দেখে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিল্পীরা এসে ভারতীয় শিল্পের নিজস্বতার সঙ্গে যুক্ত করেন ইউরোপীয় ধারা। তখন এক নতুন শিল্পকর্ম উপহার দেন ভারতের শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এ প্রদর্শনীর শিল্পীদের পরাবাস্তব চিন্তার প্রয়োগ দেখা যায়। অতিন বসাক (১৯৬৬) ও জয়ন্ত নস্কর (১৯৭৫)-এর কাজ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। দুই প্রজন্মের শিল্পীদের ছবির বিষয় নিয়ে নিরীক্ষার ধারাবাহিক প্রবণতা স্পষ্ট এসব কাজে। হরেন দাস (১৯২১-১৯৯৩) তাঁর কাজে বাস্তবধর্মী চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। নিসর্গ, মানুষ, প্রকৃতির গায়ে আলো-ছায়ার বৈপরীত্য হরেন দাসের ছবিতে প্রকাশ পায়। মানুষের দেহাবয়বের নানা ভঙ্গি, জনজীবনের উৎসব, দুর্ভোগ তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ওঠে। কাঠখোদাই করে রঙের প্লেট আলাদা করে বাস্তবধর্মী অসাধারণ শিল্পকর্মে হরেন দাস আমৃত্যু মনোযোগী ছিলেন। অমিতাভ ব্যানার্জির (১৯২৮) কাজগুলো ধাতব পাত (প্লেট) খোদাই করে করা, মানুষের মুখ, প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা লতা, গুল্ম অমিতাভের ছবি আঁকার বিষয়। তাঁর ছবির মাধ্যমে একটি বার্তা দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেন।
তাঁর দ্য লস্ট গ্লোরি, দ্য মঙ্ক, আফটার দ্য বাথ—এ তিনটি ছবিতে তিন ধরনের বার্তা দেন। একজন শাসকের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান, ব্রাহ্মণের আলো প্রজ্বালন, নারীর সৌন্দর্যের বিষয়কে আলাদা করে অমিতাভ তাঁর ছবিতে বলেন, এচিং পদ্ধতিতে আঁকা ছবির তলে একরকম বুনট তৈরি হয় শিল্পীর ইচ্ছায়। অমিতাভ ব্যানার্জি ছবির প্লেটে বুনট সৃষ্টি করেন যত্নের সঙ্গে, সুহাস রায় (১৯৩৬) এচিং মাধ্যমে করা ছবিগুলোর শিরোনাম দিয়েছেন আনটাইটেল্ড বা শিরোনামহীন। সুহাস বিষয় হিসেবে বেছে নেন মানুষের মুখ, শরীর, জ্যামিতিক আকৃতি; রং ও রেখার আকৃতির সংযোগ সাধন সুহাসের কাজের লক্ষ্য। তাঁর ১২টি কাজে ঘুরেফিরে বিষয়ের মিল দেখা যায়, ‘শিরোনামহীন-৩’ ছবিতে মানুষের মুখের ব্যাকগ্রাউন্ডে বুনটের সৃষ্টি করে মানব মনের ভেতরে থাকা ভয়ংকর রূপ তুলে এনেছেন। ‘শিরোনাম-৪’ ছবিতে বড় একটি পিরামিড আকৃতির পেছনে দূরে আরও দুটি পিরামিড আকৃতির সঙ্গে ছবির পেছনে ও সামনে দুটি বৃত্তের মাধ্যমে সূর্য ও বিকেলের আকাশের রূপ তুলে এনেছেন। চন্দন দাস (১৯৫৭) কাজ করেছেন ছাপচিত্রের তিনটি মাধ্যমে—এচিং, রিলিফ এচিং, ভিসকোসিটি। ছয়টি কাজের বিষয়ে রয়েছে ভিন্ন ধরন, ‘পেপার টাইগার’ ছবিটি উজ্জ্বল লাল জমিনে হাঁ করা বাঘের জ্যামিতিক রূপ, ‘ভিক্টিম কার অ্যান্ড জেব্রা ক্রসিং’ শিরোনামের এচিং প্রিন্টে রাস্তায় চলার মুহূর্তে দুর্ঘটনাকে প্রকাশ করেছেন এখানে মানুষ, রাস্তা, গাড়ি সব জ্যামিতিক রূপের আশ্রয়ে আঁকা। অতিন বসাক (১৯৬৬) কাজ করেন রঙিন এচিং মাধ্যমে। মানুষের ফিগারের সঙ্গে দেয়াল, দরজা, সিঁড়ি, নাগরিকের পরিশীলিত বেশভূষায় আকৃতি মানুষের রূপ প্রকাশ করেন ছবির মাধ্যমে। প্রদর্শনীর সাতটি কাজ এচিং মাধ্যমে করা, ছবিতে বাস্তবধর্মী আলো-ছায়ার প্রতি মনোযোগ রেখে অতিন বসাক তাঁর শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন।
মানুষের ফিগার ছাড়াও তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে জড়বস্তু, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি। আলো-ছায়া, একেবারে অন্ধকারে ছবির জমিন ঢেকে দেওয়ায় অতিনের ছবিকে আলাদাভাবে চেনা যায়। জয়ন্ত নস্কর (১৯৭৫) শূন্য দশকে শিল্পশিক্ষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। রবীন্দ্রভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক দুই অবস্থাতেই নিজেকে নিয়োজিত করেছেন ছবির নিরীক্ষায়। তাঁর ছবির মানুষের মস্তক কাটা কিন্তু কথা বলে, কথোপকথনে ব্যস্ত থাকে ছবির মানুষগুলো। জয়ন্ত নস্কর এ প্রদর্শনীর ১০টি কাজই এচিং মাধ্যমে করেছেন। তাঁর কাজে মানুষের শরীর প্রধান বিষয়, রেখার ব্যবহার ও চিত্রতলের জমিনে বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে বুনট সৃষ্টি করেন শিল্পী। ভিক্টিম অব রিসেশান-২ ছবিতে নীল ও ছাই রং জমিনে একদল মানুষের কৌতূহলী অবস্থান লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির দ্য লাস্ট সাপারের কৌতূহলী চাহনির ভঙ্গি মনে করায়। জয়ন্ত মানুষগুলোর মাথার এক অংশ ভেঙে দেন। পুরো শরীরের পোশাক-পরিচ্ছদে আড়াআড়ি রেখার ব্যবহারের জন্য মানুষ হয়ে উঠেছে সমাজের যাতনাক্লিষ্ট চরিত্রে। ‘পেস্ট্রি অব দ্য পাওয়ার’ শিরোনামের প্রিন্টে কৌণিক অবস্থানে মানুষ ও পেস্ট্রির প্লেট। হালকা সবুজ রঙে ভারতীয় মুদ্রার ছাপ ছবির জমিনে। ক্ষমতা, শ্রেণীবৈষম্যের চেহারা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন এ ছবিতে। এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য বাস্তবধর্মী হরেন দাসের কাজ। সাদা-কালো কাঠখোদাই; রঙিন কাঠখোদাই, এচিং ও রঙিন এচিং মাধ্যমে করা ছাপচিত্রে হরেন দাস বাস্তবধর্মী বিষয়ের সঙ্গে আলো-ছায়ার তীব্র বৈপরীত্য নিশ্চিত করেছেন, প্রান্তিক মানুষের জীবনঘন মুহূর্তকে স্পষ্ট করে দেখান হরেন দাস তাঁর ছবিতে। ৫২টি ছাপাই ছবির কোনো কোনো ছবিকে জীবনবোধের গভীর উপলব্ধির ভাষা হিসেবে অভিহিত করা যায়। এসব শিল্পকর্ম দর্শকচৈতন্যে নতুন বোধের উন্মেষ ঘটবে নিশ্চিত, ছয়জন শিল্পীর কাজে আত্মার আবেগের সম্মিলন হয়েছে। প্রদর্শনীটি শেষ হবে আগামী ৪ ডিসেম্বর।
তাঁর দ্য লস্ট গ্লোরি, দ্য মঙ্ক, আফটার দ্য বাথ—এ তিনটি ছবিতে তিন ধরনের বার্তা দেন। একজন শাসকের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান, ব্রাহ্মণের আলো প্রজ্বালন, নারীর সৌন্দর্যের বিষয়কে আলাদা করে অমিতাভ তাঁর ছবিতে বলেন, এচিং পদ্ধতিতে আঁকা ছবির তলে একরকম বুনট তৈরি হয় শিল্পীর ইচ্ছায়। অমিতাভ ব্যানার্জি ছবির প্লেটে বুনট সৃষ্টি করেন যত্নের সঙ্গে, সুহাস রায় (১৯৩৬) এচিং মাধ্যমে করা ছবিগুলোর শিরোনাম দিয়েছেন আনটাইটেল্ড বা শিরোনামহীন। সুহাস বিষয় হিসেবে বেছে নেন মানুষের মুখ, শরীর, জ্যামিতিক আকৃতি; রং ও রেখার আকৃতির সংযোগ সাধন সুহাসের কাজের লক্ষ্য। তাঁর ১২টি কাজে ঘুরেফিরে বিষয়ের মিল দেখা যায়, ‘শিরোনামহীন-৩’ ছবিতে মানুষের মুখের ব্যাকগ্রাউন্ডে বুনটের সৃষ্টি করে মানব মনের ভেতরে থাকা ভয়ংকর রূপ তুলে এনেছেন। ‘শিরোনাম-৪’ ছবিতে বড় একটি পিরামিড আকৃতির পেছনে দূরে আরও দুটি পিরামিড আকৃতির সঙ্গে ছবির পেছনে ও সামনে দুটি বৃত্তের মাধ্যমে সূর্য ও বিকেলের আকাশের রূপ তুলে এনেছেন। চন্দন দাস (১৯৫৭) কাজ করেছেন ছাপচিত্রের তিনটি মাধ্যমে—এচিং, রিলিফ এচিং, ভিসকোসিটি। ছয়টি কাজের বিষয়ে রয়েছে ভিন্ন ধরন, ‘পেপার টাইগার’ ছবিটি উজ্জ্বল লাল জমিনে হাঁ করা বাঘের জ্যামিতিক রূপ, ‘ভিক্টিম কার অ্যান্ড জেব্রা ক্রসিং’ শিরোনামের এচিং প্রিন্টে রাস্তায় চলার মুহূর্তে দুর্ঘটনাকে প্রকাশ করেছেন এখানে মানুষ, রাস্তা, গাড়ি সব জ্যামিতিক রূপের আশ্রয়ে আঁকা। অতিন বসাক (১৯৬৬) কাজ করেন রঙিন এচিং মাধ্যমে। মানুষের ফিগারের সঙ্গে দেয়াল, দরজা, সিঁড়ি, নাগরিকের পরিশীলিত বেশভূষায় আকৃতি মানুষের রূপ প্রকাশ করেন ছবির মাধ্যমে। প্রদর্শনীর সাতটি কাজ এচিং মাধ্যমে করা, ছবিতে বাস্তবধর্মী আলো-ছায়ার প্রতি মনোযোগ রেখে অতিন বসাক তাঁর শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন।
মানুষের ফিগার ছাড়াও তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে জড়বস্তু, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি। আলো-ছায়া, একেবারে অন্ধকারে ছবির জমিন ঢেকে দেওয়ায় অতিনের ছবিকে আলাদাভাবে চেনা যায়। জয়ন্ত নস্কর (১৯৭৫) শূন্য দশকে শিল্পশিক্ষায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। রবীন্দ্রভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক দুই অবস্থাতেই নিজেকে নিয়োজিত করেছেন ছবির নিরীক্ষায়। তাঁর ছবির মানুষের মস্তক কাটা কিন্তু কথা বলে, কথোপকথনে ব্যস্ত থাকে ছবির মানুষগুলো। জয়ন্ত নস্কর এ প্রদর্শনীর ১০টি কাজই এচিং মাধ্যমে করেছেন। তাঁর কাজে মানুষের শরীর প্রধান বিষয়, রেখার ব্যবহার ও চিত্রতলের জমিনে বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে বুনট সৃষ্টি করেন শিল্পী। ভিক্টিম অব রিসেশান-২ ছবিতে নীল ও ছাই রং জমিনে একদল মানুষের কৌতূহলী অবস্থান লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির দ্য লাস্ট সাপারের কৌতূহলী চাহনির ভঙ্গি মনে করায়। জয়ন্ত মানুষগুলোর মাথার এক অংশ ভেঙে দেন। পুরো শরীরের পোশাক-পরিচ্ছদে আড়াআড়ি রেখার ব্যবহারের জন্য মানুষ হয়ে উঠেছে সমাজের যাতনাক্লিষ্ট চরিত্রে। ‘পেস্ট্রি অব দ্য পাওয়ার’ শিরোনামের প্রিন্টে কৌণিক অবস্থানে মানুষ ও পেস্ট্রির প্লেট। হালকা সবুজ রঙে ভারতীয় মুদ্রার ছাপ ছবির জমিনে। ক্ষমতা, শ্রেণীবৈষম্যের চেহারা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন এ ছবিতে। এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য বাস্তবধর্মী হরেন দাসের কাজ। সাদা-কালো কাঠখোদাই; রঙিন কাঠখোদাই, এচিং ও রঙিন এচিং মাধ্যমে করা ছাপচিত্রে হরেন দাস বাস্তবধর্মী বিষয়ের সঙ্গে আলো-ছায়ার তীব্র বৈপরীত্য নিশ্চিত করেছেন, প্রান্তিক মানুষের জীবনঘন মুহূর্তকে স্পষ্ট করে দেখান হরেন দাস তাঁর ছবিতে। ৫২টি ছাপাই ছবির কোনো কোনো ছবিকে জীবনবোধের গভীর উপলব্ধির ভাষা হিসেবে অভিহিত করা যায়। এসব শিল্পকর্ম দর্শকচৈতন্যে নতুন বোধের উন্মেষ ঘটবে নিশ্চিত, ছয়জন শিল্পীর কাজে আত্মার আবেগের সম্মিলন হয়েছে। প্রদর্শনীটি শেষ হবে আগামী ৪ ডিসেম্বর।
No comments