বিচিত্রিতা- মান্নান ভাই এখনো by রাজীব হাসান
বটগাছটা সেখানেই আছে। বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় সেটাকে দেখাচ্ছে আলসে এক বুড়োর মতো। গাছটা এত বছরেও পাল্টায়নি। কিন্তু তার পরও কী যেন একটা নেই। কী একটা শূন্যতা! মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এই বটগাছের সবচেয়ে কাছের সঙ্গীটিই নেই। মান্নান ভাই গেলেন কোথায়?
একজন হদিস দিল, ‘মান্নান ভাইকে আর এখানে পাবেন না। উনি এখন থাকেন স্কুলের গেটের পাশে।’ ফিরে এলাম গেটে। হ্যাঁ, এই তো দেখা যাচ্ছে তাঁর সেই পরিচিত সাইকেল-রিকশার চাকা লাগানো কাঠের ছোট্ট দোকান। ওই তো বয়ামে তাঁর হাতে বানানো বিখ্যাত হজমি, ঘুগনি, পাপড়ভাজা, বাদাম, আচার। কিন্তু লোকটা কোথায়? বলতে না-বলতেই উঁকি দিলেন স্কুলের গেটে।
পরনে লম্বা পাঞ্জাবি, হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে গেছে গোড়ালি অব্দি। কাঁচাপাকা চুল, পাকার আধিক্যই বেশি। একমুখ দাড়িগোঁফ। মেহেদি করিয়েছেন দাঁড়িতে। মুখের ভাঁজে বয়সের রেখাচিত্র। এই কয় বছরে অনেকটাই পাল্টে গেছেন। কিন্তু একটুও পাল্টায়নি তাঁর সেই হাসি। হাসি দেখে এক পলকেই চিনে ফেলা যায়—মান্নান ভাই, আমাদের মান্নান ভাই!
রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রদের কাছে এই এক নামেই তিনি পরিচিত। ৫০ বছর ধরে এই স্কুলে চানাচুর-ঝালমুড়ি বেচে আসছেন। রংপুর জিলা স্কুলে প্রথম এসেছিলেন যখন, ছিলেন ৩০ বছরের টগবগে যুবক। ‘আমার আসল বাড়ি ঢাকার শরীয়তপুরে। বড় ভাই পরথম এইখানে কাপড়ের ব্যবসা করতে আসেন। আমিও আসি। তখন মনে হয় আইয়ুবের শাসন...নাহ্ ইস্কান্দর মির্জাই হইব। সালটা মনে আছে, ১৯৬২।’ জিলা স্কুলে নিজের প্রথম আগমনের বৃত্তান্ত জানান মান্নান ভাই।
সেই থেকেই আছেন এই স্কুলে। আর কোনো পেশা বেছে নেননি। নিতান্তই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী না হলে স্কুলে আসবেনই। শুধু পেটের দায় নয়, এখন মিশে গেছে মনের দায়ও। ‘স্কুলে না আসলে ভালো লাগে না। যত ঝড়-তুফান হোক, আসবই। একজন ছাত্রও না আসলেও আমি আসি। বিশ্বাস না গেলে জিজ্ঞাস কইরা দেখতে পারেন।’ মান্নান ভাইয়ের এই কথার সত্যতার জন্য কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন পড়ে না, তাঁর চোখে স্কুল নিয়ে ভর করা আবেগের প্রতিচ্ছবিটাই সব বলে দেয়।
স্কুলে সবচেয়ে বেশি হাজিরা দেওয়ার পুরস্কার থাকলে, কোনো ছাত্র নয়, নিঃসন্দেহে সেটা মান্নান ভাই-ই পেয়ে যেতেন প্রতিবছর! অবশ্য একটা সময় গেছে, অনেক দিন স্কুলে আসতে পারেননি। ১৯৭১ সালে! মান্নান ভাইয়ের কাছে শোনা গেল সেই সময়ের গল্প, ‘হেই সময় একদিন স্কুলে গাছের নিচে বইসা আছি। হুট কইরা আর্মির জিপ ঢুইকা গেল। এখন যেই পুরানা বটগাছটা আছে, সেইটার ভেতরে একটা ফোকরে ঢুইকা শুইয়া ছিলাম। পরে তো স্কুল বন্ধই হইয়া গেল। পরে স্কুলের এই রাস্তাতেই বসল চেকপোস্ট। আমারে এক পাঞ্জাবি জিগায়, “তোমহারা পাস মিঠাই হ্যায়?” আমি বললাম, “না, মিঠাই নাই।” খাবলা দিয়া চকলেট নিয়া কয়, “এই তো মিঠাই।” আমি বললাম, “ইয়ে মিঠাই নাহি, ইয়ে চকলেট হ্যায়।”’
রোজ এই চেকপোস্টে বখরা দিতে দিতে মান্নান ভাই বিরক্ত। আরেক দিন তাঁকে আটকিয়ে পাঞ্জাবি সেনা জিজ্ঞাস করল, ‘তুম কলেমা জানতা হায়?’ বিরক্ত মান্নান ভাই, দ্বিগুণ সাহস নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তুম জানতা হ্যায়?’ সেই স্মৃতি রোমন্থন করে ফিক করে হেসে দিয়ে আমাদের বললেন, ‘হেই ব্যাটা তো কলেমা জানে না। আমার প্রশ্ন শুইনা ছাইড়া দিল। আর কখনো আটকায় নাই।’
স্কুলকে যেমন ভালোবেসেছেন, স্কুলও তেমনি ভালোবেসেছে। ভালোবেসেছে স্কুলের ছাত্ররা। এখনো মান্নান ভাইকে কেউ ভুলতে পারে না। এমনি কজন ছাত্রের গল্পও শোনা গেল। অস্ট্রেলিয়া থেকে রংপুর জিলা স্কুলের এক ছাত্র স্থানীয় এক আইনজীবী বন্ধুর মাধ্যমে বেশ আগে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ‘আমি তো টাকা নিবই না। কিন্তু সেই উকিল বলল, আপনি না নিলে ও খুব মন খারাপ করবে। তখন নিলাম।’ সেই টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলেন। সেই গরু থেকে ১০টা গরুও হয়েছিল তাঁর।
আরেকবার এক সেনা কর্মকর্তা এসেছিলেন। ‘দেখি একজন আর্মির গাড়ি থেইকা নামল। আমি তো ভয় পায়া গেলাম। কিন্তু আইসা আমারে পাজার (জড়িয়ে) ধরল। কয়, আপনার হাতে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্যই এত দূর আসছি’—মান্নান ভাইয়ের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে আবেগের জল!
এত দিনে তাঁর ভূমিকা একটু একটু করে পাল্টেছে দেখলাম। আমরা যেমন মান্নান ভাই বললাম, এখন অনেকেই তাঁকে বলে দাদু। একই সঙ্গে ভাই এবং এই নাতিদের নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। তবে বটগাছটার নিচে কেন বসেন না, সেই উত্তর দিলেনই না। একজনের কাছে শোনা গেল, বর্তমান প্রধান শিক্ষক নাকি অনুমতি দিচ্ছেন না। কিন্তু তিনি এ নিয়ে কোনো নালিশ করতে নারাজ, ‘আরে না। আপেল স্যার অনেক ভালো। তিনিও তো একসময় এখানকারই ছাত্র ছিলেন। আমার দোকানে তিনিও তো খাইছেন।’
বলতে বলতে কথা ফুরিয়ে আসে। মান্নান ভাইয়ের হাতে বানানো সেই বিখ্যাত, পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে ফিরে আসি। ফেরার পথেই মনে পড়ে, ‘আরে তাঁর পুরো নামই তো শোনা হলো না। এটা তো সাংবাদিকতার নীতির লঙ্ঘন।’ একবার মনে হলো ফিরে চাই। আবার ভাবলাম, কী দরকার! হোক না নিয়মের লঙ্ঘন। তিনি আমাদের মান্নান ভাই, মান্নান ভাই থাকুন!
পরনে লম্বা পাঞ্জাবি, হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে গেছে গোড়ালি অব্দি। কাঁচাপাকা চুল, পাকার আধিক্যই বেশি। একমুখ দাড়িগোঁফ। মেহেদি করিয়েছেন দাঁড়িতে। মুখের ভাঁজে বয়সের রেখাচিত্র। এই কয় বছরে অনেকটাই পাল্টে গেছেন। কিন্তু একটুও পাল্টায়নি তাঁর সেই হাসি। হাসি দেখে এক পলকেই চিনে ফেলা যায়—মান্নান ভাই, আমাদের মান্নান ভাই!
রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রদের কাছে এই এক নামেই তিনি পরিচিত। ৫০ বছর ধরে এই স্কুলে চানাচুর-ঝালমুড়ি বেচে আসছেন। রংপুর জিলা স্কুলে প্রথম এসেছিলেন যখন, ছিলেন ৩০ বছরের টগবগে যুবক। ‘আমার আসল বাড়ি ঢাকার শরীয়তপুরে। বড় ভাই পরথম এইখানে কাপড়ের ব্যবসা করতে আসেন। আমিও আসি। তখন মনে হয় আইয়ুবের শাসন...নাহ্ ইস্কান্দর মির্জাই হইব। সালটা মনে আছে, ১৯৬২।’ জিলা স্কুলে নিজের প্রথম আগমনের বৃত্তান্ত জানান মান্নান ভাই।
সেই থেকেই আছেন এই স্কুলে। আর কোনো পেশা বেছে নেননি। নিতান্তই অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী না হলে স্কুলে আসবেনই। শুধু পেটের দায় নয়, এখন মিশে গেছে মনের দায়ও। ‘স্কুলে না আসলে ভালো লাগে না। যত ঝড়-তুফান হোক, আসবই। একজন ছাত্রও না আসলেও আমি আসি। বিশ্বাস না গেলে জিজ্ঞাস কইরা দেখতে পারেন।’ মান্নান ভাইয়ের এই কথার সত্যতার জন্য কোনো সাক্ষীর প্রয়োজন পড়ে না, তাঁর চোখে স্কুল নিয়ে ভর করা আবেগের প্রতিচ্ছবিটাই সব বলে দেয়।
স্কুলে সবচেয়ে বেশি হাজিরা দেওয়ার পুরস্কার থাকলে, কোনো ছাত্র নয়, নিঃসন্দেহে সেটা মান্নান ভাই-ই পেয়ে যেতেন প্রতিবছর! অবশ্য একটা সময় গেছে, অনেক দিন স্কুলে আসতে পারেননি। ১৯৭১ সালে! মান্নান ভাইয়ের কাছে শোনা গেল সেই সময়ের গল্প, ‘হেই সময় একদিন স্কুলে গাছের নিচে বইসা আছি। হুট কইরা আর্মির জিপ ঢুইকা গেল। এখন যেই পুরানা বটগাছটা আছে, সেইটার ভেতরে একটা ফোকরে ঢুইকা শুইয়া ছিলাম। পরে তো স্কুল বন্ধই হইয়া গেল। পরে স্কুলের এই রাস্তাতেই বসল চেকপোস্ট। আমারে এক পাঞ্জাবি জিগায়, “তোমহারা পাস মিঠাই হ্যায়?” আমি বললাম, “না, মিঠাই নাই।” খাবলা দিয়া চকলেট নিয়া কয়, “এই তো মিঠাই।” আমি বললাম, “ইয়ে মিঠাই নাহি, ইয়ে চকলেট হ্যায়।”’
রোজ এই চেকপোস্টে বখরা দিতে দিতে মান্নান ভাই বিরক্ত। আরেক দিন তাঁকে আটকিয়ে পাঞ্জাবি সেনা জিজ্ঞাস করল, ‘তুম কলেমা জানতা হায়?’ বিরক্ত মান্নান ভাই, দ্বিগুণ সাহস নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তুম জানতা হ্যায়?’ সেই স্মৃতি রোমন্থন করে ফিক করে হেসে দিয়ে আমাদের বললেন, ‘হেই ব্যাটা তো কলেমা জানে না। আমার প্রশ্ন শুইনা ছাইড়া দিল। আর কখনো আটকায় নাই।’
স্কুলকে যেমন ভালোবেসেছেন, স্কুলও তেমনি ভালোবেসেছে। ভালোবেসেছে স্কুলের ছাত্ররা। এখনো মান্নান ভাইকে কেউ ভুলতে পারে না। এমনি কজন ছাত্রের গল্পও শোনা গেল। অস্ট্রেলিয়া থেকে রংপুর জিলা স্কুলের এক ছাত্র স্থানীয় এক আইনজীবী বন্ধুর মাধ্যমে বেশ আগে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ‘আমি তো টাকা নিবই না। কিন্তু সেই উকিল বলল, আপনি না নিলে ও খুব মন খারাপ করবে। তখন নিলাম।’ সেই টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলেন। সেই গরু থেকে ১০টা গরুও হয়েছিল তাঁর।
আরেকবার এক সেনা কর্মকর্তা এসেছিলেন। ‘দেখি একজন আর্মির গাড়ি থেইকা নামল। আমি তো ভয় পায়া গেলাম। কিন্তু আইসা আমারে পাজার (জড়িয়ে) ধরল। কয়, আপনার হাতে ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্যই এত দূর আসছি’—মান্নান ভাইয়ের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে আবেগের জল!
এত দিনে তাঁর ভূমিকা একটু একটু করে পাল্টেছে দেখলাম। আমরা যেমন মান্নান ভাই বললাম, এখন অনেকেই তাঁকে বলে দাদু। একই সঙ্গে ভাই এবং এই নাতিদের নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। তবে বটগাছটার নিচে কেন বসেন না, সেই উত্তর দিলেনই না। একজনের কাছে শোনা গেল, বর্তমান প্রধান শিক্ষক নাকি অনুমতি দিচ্ছেন না। কিন্তু তিনি এ নিয়ে কোনো নালিশ করতে নারাজ, ‘আরে না। আপেল স্যার অনেক ভালো। তিনিও তো একসময় এখানকারই ছাত্র ছিলেন। আমার দোকানে তিনিও তো খাইছেন।’
বলতে বলতে কথা ফুরিয়ে আসে। মান্নান ভাইয়ের হাতে বানানো সেই বিখ্যাত, পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে ফিরে আসি। ফেরার পথেই মনে পড়ে, ‘আরে তাঁর পুরো নামই তো শোনা হলো না। এটা তো সাংবাদিকতার নীতির লঙ্ঘন।’ একবার মনে হলো ফিরে চাই। আবার ভাবলাম, কী দরকার! হোক না নিয়মের লঙ্ঘন। তিনি আমাদের মান্নান ভাই, মান্নান ভাই থাকুন!
No comments