দে বে শ রা য়ে র সা ক্ষা ৎ কা র- ‘আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে বাধা এলে সাহিত্যের বিরাট ক্ষতি হবে’- সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ফারুক ওয়াসিফ
বাংলা ভাষার এই সময়ের একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত হে উৎসবের আমন্ত্রিত লেখক ছিলেন তিনি। তখন সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
আলোচনায় এসেছে দেশ ভাগ, এপার বাংলা-ওপার বাংলার সাহিত্যসহ বিবিধ প্রসঙ্গ প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাহিত্য বলে আলাদা একটা সাহিত্যসীমা চিহ্নিত করার পক্ষে আপনিও বলছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশ-রাষ্ট্র-ইতিহাস বদলে গেলে সাহিত্যও বদলে যায় কি না। গেলে সেই বদলকে আমরা কোন কোন শর্ত দিয়ে চিনব?
উত্তর: এই প্রশ্ন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আমি আলোড়িত আছি। এ কারণে আলোড়িত আছি যে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আমার আগ্রহ ও পড়াশোনা বেড়েছে এবং আমি কতগুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, যার সঙ্গে এই প্রশ্ন ভীষণভাবে জড়িত। আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্য দুটোই বাংলা ভাষায় লেখা হলেও এক সাহিত্য নয়। এপার বাংলা ওপার বাংলা বা এক বাংলা এসব সেন্টিমেন্টাল কথা দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস নির্ধারণ হয় না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর, অর্থাৎ সুদীর্ঘ ষাট বছরে যে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দুটি দেশ অগ্রসর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এটাকে ভাবাবেগ দিয়ে বোঝা যাবে না। ভাবাবেগ বা সেন্টিমেন্টালিজম আসে দুই জায়গা থেকে। একটা যেমন, পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা মনে করেন তাঁরাই হচ্ছেন বাংলা ভাষার প্রধান দপ্তর। বাংলাদেশের লেখকেরাও লিখছেন ছোট ভাইয়ের মতো, তাঁদের উৎসাহ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের অনেক লেখকও ভাবেন, পশ্চিমবঙ্গের লেখক বা সমালোচকেরা স্বীকৃতি দিলেই তবে তাঁরা আসলে স্বীকৃতি পেলেন। এই দুটো প্রবণতাই ক্ষতিকর। কারণ কোনো রকম নির্ভরশীলতা বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সাহিত্য তৈরি হয় না। এই পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় স্বীকার করা যে দুটো দেশের সাহিত্য আলাদা সাহিত্য। আমি এই তুলনার মধ্যে যেতে চাইছি না যে একই ভাষায় পৃথিবীতে কত আলাদা আলাদা সাহিত্য তৈরি হয়েছে। যাচ্ছি না এ কারণে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা কারণ সক্রিয় থেকেছে। সুতরাং তুলনার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের জীবনযাপন, সমাজের জীবনযাপন, রাজনীতি, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনের রকমফের—এগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গল্প-উপন্যাসও বদলায়। কবিতার কথা বলছি না, তবে বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস আর পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
প্রশ্ন: তার মানে ধরে নিচ্ছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যে এমন কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যাকে বাংলাদেশি বলে চেনা যায়, আবার পশ্চিমবঙ্গেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যাকে পশ্চিমবঙ্গীয় বলে চেনা যায়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো কী? দুখানেই তো বিভিন্ন মত, ধারা ও দর্শনের লেখক আছেন। তাঁদের কাজকে এক থাকে ফেলার গড়করণ করছেন কী দিয়ে?
উত্তর: খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। কিন্তু আমি বিশদভাবে উত্তর করছি না। পশ্চিমবঙ্গ ভারত ইউনিয়ন নামক বিশাল উপমহাদেশতুল্য দেশের একটা ছোট রাজ্য বা প্রদেশ। তার প্রতিবেশিত্ব যেমন বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সঙ্গে, তেমনি তার প্রতিবেশিত্ব থাকা উচিত ভারতবর্ষের আরও অজস্র ভাষার সঙ্গে, সাংবিধানিকভাবেই যাদের সংখ্যা বাইশের ওপর। সরকার, গণতন্ত্র, সমাজ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মিউনিসিপ্যালিটির রাজনীতি, গ্রাম পঞ্চায়েত ইত্যাদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ভাষাভাষীদের দৈনন্দিন জীবন। দৈনন্দিন জীবন ছাড়া গল্প-উপন্যাসের আর কোনো বিষয় নেই। সেই দৈনন্দিন জীবনই যখন রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিচ্ছায়া হয়ে ওঠে, তখনই তা সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠে। এখন উভয় বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থা, উৎপাদনব্যবস্থা গত ষাট বছরে এতই আলাদা হয়ে গেছে, সেই আলাদাত্ব স্বীকার না করা সত্যের অপলাপ হয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাহিত্যে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা আসছে, বা আসছে কি না?
উত্তর: আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে লেখার দরকারে কতগুলো প্রশ্ন ও কতগুলো উত্তরের সামনে দাঁড়িয়েছি। সেগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দুটো পারস্পরিক সক্রিয়তা কাজ করছে। (এই কথাগুলো কিন্তু আমার কথা, সম্পূর্ণ ভুল হতে পারে)। সেটা হচ্ছে, কিছু বিষয়ের প্রতি বাধ্যতা এবং কিছু বিষয়ের অনিশ্চয়তা বা অনিষ্পত্তি। বাধ্যতাটা হলো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, বাংলায় আত্মতার সংকট। এটা সব সময় সব লেখককেই তাড়িত করে। বাংলাদেশে এই তাড়নাটা ব্যাপক। তাড়নাটা আছে বলেই বাংলাদেশের লেখালেখি এই পর্যায়ে উঠেছে। এই তাড়নাটা ছাড়া আসলে হয় না। এখন অনিষ্পত্তি হলো, যেমন গণতন্ত্রের চেহারাটা কী হবে? যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মসাপেক্ষতার মধ্যে সম্পর্কটা কী হবে? আমি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করছি না, কিন্তু নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের পক্ষে এই পরিমাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে জীবনযাপন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে সেই গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রও হতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষও হতে হবে; আবার আবশ্যিকভাবে ধর্মসাপেক্ষও হতে হবে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্র একটা জায়গায় পৌঁছেছে, কিন্তু সেই গণতন্ত্রও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ নয়। তাকে ধর্মসাপেক্ষ হতে হয় অর্থাৎ আচরণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয় সে ধর্মসাপেক্ষও বটে অর্থাৎ সে কোনো ধর্মের বিরোধিতা করছে না। আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে এই উপমহাদেশে ‘ধর্মসাপেক্ষ নয়’, এটুকু যদি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রমাণ করতে পারে, সেটুকুই আমার কাছে যথেষ্ট। অনিষ্পত্তি বা মীমাংসা হয়নি, এ রকম আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে জিহাদ এবং না-জিহাদ। মুসলিম সমাজ ও দেশ নির্লজ্জ বহিরাক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। সেই বহিরাক্রমণের সম্মুখীনতা তারা না চাইলেও তাদের বাধ্য করছে শরিয়া ইত্যাদি পালন করতে। বাংলাদেশে এই সমস্যাটা নিষ্পত্তি হয়নি। তবে এটাও বলব, মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই এর সবচেয়ে বেশি নিষ্পত্তি করতে পারছে। তৃতীয় যে সংকটের কথা বলছি, সেটা হলো পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক। আমরা কি একই সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভাগীদার। নাকি আমাদের ইতিহাসটা আলাদা?
প্রশ্ন: দুই বাংলার সাহিত্যের মধ্যে যে পার্থক্যরেখা, তাকে রাষ্ট্রবোধের ধরন বা ইতিহাসের ভিন্নতা দিয়েও বলা যায়। কিন্তু আপনার ভাষ্যে মনে হচ্ছে এই রাষ্ট্রবোধের মর্মে আছে মুসলিম সম্প্রদায়বোধ। একই কথা কি পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের বেলাতেও খাটে না?
উত্তর: খাটতে পারে। তবে সেখানে গণতন্ত্র একটা কাঠামো পেয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোক্ত হয়েছে। যা কিছুই আসুক তাকে এর ভেতর দিয়েই যেতে হয়। এমনকি বিজেপি বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারী মোদীকেও এর মধ্যে কাজ করতে হয়।
প্রশ্ন: মানুষের নিজস্ব বচন, অভিব্যক্তি, সমাজের অচেতন একটি দেশের সাহিত্যে আসে। এই বিচারে বাংলাদেশের সাহিত্যের কোনো বিশিষ্ট লক্ষণ দেখতে পান?
উত্তর: অনেক প্রত্যক্ষ, জোরালো ও শিল্পসমর্থভাবে সেসব লক্ষণ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে একটা খনি যেন খোঁড়াই হচ্ছে, খোঁড়াই হচ্ছে, শেষ হচ্ছে না। যেমন বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে তার প্রকৃতি, নিসর্গ এবং সেই নিসর্গস্থিত মানুষ, তার যে অস্তিত্বের সংকট আবার দৈনিক দিনযাপনেরও সংকট; গ্রামের বুনো হিউমারের তীব্র আঘাত, এগুলো একটা সাহিত্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়; সেই বিস্ফোরণটাই আমি দেখতে পাচ্ছি। সাহিত্যের বিস্ফোরণ তো আর সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। কিন্তু এটা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবেই বলে আমি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে এত আগ্রহী।
প্রশ্ন: মান ভাষা বনাম আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সম্প্রতি। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উত্তর: বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বাংলাদেশের সাহিত্যেও আরেকটি অনিষ্পন্ন বিষয় হলো ভাষা। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ভাষা হবে, নাকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের মতো মান ভাষা হবে। আমি মনে করি, মান ভাষা হলো উপনিবেশবাদী ধারণা। উপনিবেশ বিস্তারের প্রয়োজনে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের আয়ত্ত করায় সুবিধা হবে বলে বিচিত্র ও বিবিধ ভাষাকে একটা বাঁধা ছকে তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের যে ভাষাকে আমরা মান বলে মেনে নিয়েছি, সেই মান ভাষা পশ্চিমবঙ্গের এখনকার সাহিত্যের জন্য সেটা এক বড় বাধা। কারণ সেই ভাষার পুষ্টি কমে গেছে। ভাষার পুষ্টি আসে কৃষি থেকে, শ্রম থেকে। মানুষের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয় যে ভাষা, সেই ভাষা রক্তাল্পতায় ভুগবেই। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার এটাই বড় সংকট। সে জন্য সেই ভাষা ক্রমাগত যান্ত্রিক কৃত্রিমতায় ভুগছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় জোর এ জায়গায়: অজস্র জেলার অজস্র ভাষা এই ভাষাকে পুষ্ট করছে। আমার এই কথার বিরোধিতার মনোভাব বাংলাদেশের অনেক লেখকের মনে আছে। সেটা মেনে নিয়েই বলছি, বাংলাদেশ যদি কৃত্রিমভাবে কোনো মান ভাষা ব্যবহার করে সেটা বাংলাদেশের সাহিত্যের বেলায় বিরাট ক্ষতির কারণ হবে।
গল্প-উপন্যাসের ভাষা প্রশ্নে আঞ্চলিক, আঞ্চলিকতর আঞ্চলিকতম ভাষা ব্যবহারের যে সুযোগ বাংলাদেশে আছে সেই সুযোগ কোনোমতে বন্ধ করা উচিত নয়। লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভাষার বিভিন্ন স্তর। একটা ভাষায় যখন উপন্যাস লিখছি, তখন সেই ভাষার মধ্যে স্তরান্তর আনায় কথ্য ভাষা যে রকম সাহায্য করে, এ রকম আর কোনো কিছু করে না। আমার যদি ঘরের মধ্যে সেই সম্পদ থাকে, আমার কি উচিত তাকে অবহেলা করা?
প্রশ্ন: জনপ্রিয় সাহিত্য বিষয়ে ধরেন যেমন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এই প্রশ্নটা এখানে উঠছে যে, তাঁকে আমরা কোন মাপে ফেলব? জনপ্রিয় সাহিত্যই যদি তা হয়, তা নিয়ে কি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন নয়?
উত্তর: সাহিত্যকে জনপ্রিয় ও অজনপ্রিয় এভাবে বিভাজন করা আমার কাছে আপত্তিকর। আপত্তি করি না, এটা আপত্তিকর। এর মানে হচ্ছে অভিজাত আর অনভিজাত বলে ভাগ করা। এলিট লেখক বলে কিছু হতে পারে না। আমার প্রশংসা করতে গিয়ে যদি বলা হয় আমি বিশিষ্ট পাঠকের লেখক, তখন মন খারাপ হয়ে যায় আমার। আমি বিশিষ্ট পাঠকের জন্য তো লিখছি না। বিশিষ্ট পাঠক বলে কেউ আছে, তাও জানি না। পাঠক বিশিষ্টতা পায় বই পড়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সুতরাং জনপ্রিয় লেখকেরও বিশিষ্ট পাঠক থাকতে পারে।
যে মানুষ শুধু গল্প-উপন্যাস লিখে এত মানুষের মন জয় করতে পারেন, তাঁর লেখার মধ্যে সেই গুণ অবশ্যই থাকতে বাধ্য। আমাদের কাজ হলো সেই গুণ খুঁজে বের করা। আমার পক্ষে হুমায়ূনের বিপুল সাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করা অনুচিত, কারণ আমি সব পড়িনি। আমি শরৎচন্দ্রের লেখা খুব অপছন্দ করি, কিন্তু আমার পছন্দে-অপছন্দে কিছু আসে-যায় না। এক শ বছর ধরে তিনি বাঙালি ও ভারতীয় পাঠকের মন জয় করে চলেছেন; এর মধ্যে একটা সত্য আছে। আজকের পাঠক হিসেবে আমাকে সেই সত্যের কাছে পৌঁছাতেই হবে। আমি তার আঁচ পাচ্ছিও, চেষ্টা করছি পেতে। সেটা নিয়ে আমি লিখব। শেষ কাজগুলোর মধ্যে এই একটা কাজ বাকি আছে। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা তার বিশিষ্টতার ক্ষতি করেছে, নাকি তার বিশিষ্টতাই তার জনপ্রিয়তার কারণ? আমি তাঁর মিসির আলি নিয়ে আগ্রহী। আমার মনে হয়, আমি একটা কিছু খুঁজছি সেটা আমি সেখানে পেতে পারি।
দুই বাংলার সাহিত্য আলাদা হওয়ার একটা কারণ আমার মনে হয়, দেশের কল্পনাটা সম্প্রদায়গত এবং ভূগোলগত কারণে ভিন্নভাব ও চিত্র অবলম্বন করে আছে। সাহিত্যিক মাত্রই দেশের কল্পনা মানুষের কল্পনা করে নিতে হয়। শেষপর্যন্ত যদি দেশের কল্পনা আলাদা হয়ে যায় তাহলে সাহিত্যও আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য। রাষ্ট্রতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক পার্থক্য ছাড়াও দেশের ধারণা ও কল্পনা দিয়ে সাহিত্য আলাদা হওয়ার সৃষ্টিতত্ত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব কি না?
এক হাজার বার সম্ভব, আপনি আমার মূল জায়গাটা ধরেছেন। মানুষ তার নিজের পরিসরসংলগ্ন। একে আপনি দ্যাশ বলুন, স্পেস বলুন, বাড়ি বলুন, বাড়ির সেন্স বলুন, হোম বলুন। বলছে, পূজার সময় বাড়ি যাচ্ছি। অথচ থাকে মাত্র দুদিন। কিন্তু ওটা তার ‘হোম’, হোম অ্যাডড্রেস বলতে ওটা লেখে যদিও একটা চিঠিও আসে না। এটা এশীয় দেশগুলোর মূল লক্ষণ। এটাকে বলা যায় নিজের পরিসরের প্রতি মমতা। নইলে, বাড়িতে একটা পেয়ারাগাছ ছিল, ওদিকে একটা জামগাছ ছিল, এই স্মৃতি নিয়ে একটা মানুষ সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে কীভাবে? এটাকে যদি আপনি চটুল আবেগ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে এই জিনিস তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে না। পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু যখন পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বসতি করেছেন, তখন তারা এখানকার গ্রামের নামটা ওখানে বসিয়েছেন। তার কারণ গ্রাম কখনো মরে না। গ্রামের স্থানান্তর হতে পারে, তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামটাও চলতে থাকে। সেটা ভালো কি খারাপ সেটা বিচার্যই না, শিল্প-সাহিত্যের বিচার্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক আবেগ। এই আবেগটাকে বড় ঘটনা বড় রাজনীতি বড় তাৎপর্যের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারাই সাহিত্যের কাজ। আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যে খালটা গেছে সেই খালটা সপ্তসমুদ্রের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এই খাল দিয়ে পাকিস্তানি ফৌজ এল, সেই গ্রামে ঢুকল, সেই ফৌজের পেছনে আমেরিকানদের অস্পষ্ট একটা সমর্থন আছে—এসব মিলিয়ে যে ভুবন, সেই ভুবনের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু ওই সামান্য খালটা। সাহিত্যের কাজ সেটাকেই উদ্ধার করা।
প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কল্পনা হচ্ছে অবিদ্যমানের নিঃশ্বাস। দুই বাংলার সাহিত্যে এখন কি কল্পনার অভাব দেখতে পাচ্ছেন?
উত্তর: দুই জায়গায় মেলাবেন না। বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে কল্পনার বিশ্বটা অনেক বেশি প্রাণবন্ত। নাড়িটাকে ছোঁয়া যায়, যেন দপদপ করছে।
প্রশ্ন: অনেক সময় বিদেশি সাহিত্য বা সেসবের ফর্ম বা আকারে আচ্ছন্নতায় নিজস্ব কল্পনা ফিরে পেতে অসুবিধা হয় কিনা?
উত্তর: এগুলো কোনো স্থায়ী প্রভাব হতে পারে না। একটা হচ্ছে আমাদের কয় শতাংশ সাহিত্য পড়ে বা লেখে। সেহেতু অনেক সময় বাধ্য হয়ে বিদেশি সাহিত্য থেকে ঋণ নিতে হয়। অন্যদিকে, আমাদের এখানে আকারের যে বৈচিত্র্য, তাতে আমাদের কারও কাছে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নই আসে না। আমাকে কে শেখাবে বাইরে থেকে? আমি জন্মেছি এমন এক দেশে যেখানে প্রতিটি পা গল্পে গল্পে চলে। গল্প ছাড়া এখানে কথাই হয় না। গল্প ছাড়া হাহাকারও নেই, আনন্দও নেই। সেই দেশের মানুষ আমরা, আমাদের কেন গল্পের জন্য ফর্মের জন্য বাইরে হাত পাততে হবে? বড় বিষয় হলো দেশকল্পনা, সেটাকে খুঁজে পেতে হবে। বিদেশি চিনি না জানি না এমন একজন লেখক, যেহেতু পেঙ্গুইন বা হার্পারকলিন্স বের করেছে, সেহেতু পড়ছি। আমি আমাদের অনেক লেখকের কথা জানি, যারা ওই সব বিশ্ববন্দিত লেখকের চেয়ে ভালো লেখেন।
প্রশ্ন: তার মানে সাহিত্যের ওপর বাণিজ্যের প্রভাব আছে। এ প্রসঙ্গে হে ফেস্টিভ্যাল নিয়েও সমালোচনা উঠছে যে এর মধ্যে একটা ঔপনিবেশিক ছাপ আছে।
উত্তর: আমি এতটা বিধবার একাদশী করতে রাজি না। আমি এতটা দুর্বল লেখক না, কয়েকটা করপোরেট সাহিত্য নিয়ে বিনিময় করতে চাইলে আমি ভয় পাব। কারণ, আমি জানি সাহিত্যের মূল নিরিখে আমি ঠিক। সেহেতু আমি আমার কথা বলব, ওরা আমার কী করবে, আমাকে কী বদলাবে? বরং এসব বিনিময়ে সাহায্য হয়। প্রতিপক্ষ যখন আড়ালে থাকে, তখন তাকে বেশি শক্তিমান মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি পঞ্চাশ দশক থেকে লিখছেন। এ সময় দেশ, সমাজ, মানুষ সব মূলসুদ্ধ বদলে যেতে দেখছেন। এ রকম এক দুর্ভাগ্যের পৃথিবীতে লেখক কি বিষাদগ্রস্ত হন, দিশেহারা বোধ করেন?
উত্তর: সব মানুষ সুখে আছে, কোনো সংকট নেই, আরামে থেকে গল্প-উপন্যাস লেখা হবে—এটা গল্প-উপন্যাস লেখার পরিস্থিতি নয়। কেউ এ রকম জীবন যাপন করলে, সেটাও লেখক হওয়ার বাধা নয়। কিন্তু অনুপস্থিত সংকটও যদি তার চৈতন্যে উপস্থিত না হয়, তাহলে সে লেখকই নয়। লেখক হওয়ার নিয়তি যে বেছে নিয়েছে, তাকে এই নিয়তিও মেনে নিতে হবে যে তাকে এই দুর্ভার বোঝা বইতে হবে। এবং সব সময়ই একটা অন্ধকার নদীতে উজান স্রোতে বুক ঠেলে এগোতে হবে।
উত্তর: এই প্রশ্ন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আমি আলোড়িত আছি। এ কারণে আলোড়িত আছি যে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আমার আগ্রহ ও পড়াশোনা বেড়েছে এবং আমি কতগুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, যার সঙ্গে এই প্রশ্ন ভীষণভাবে জড়িত। আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্য দুটোই বাংলা ভাষায় লেখা হলেও এক সাহিত্য নয়। এপার বাংলা ওপার বাংলা বা এক বাংলা এসব সেন্টিমেন্টাল কথা দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস নির্ধারণ হয় না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর, অর্থাৎ সুদীর্ঘ ষাট বছরে যে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে দুটি দেশ অগ্রসর হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এটাকে ভাবাবেগ দিয়ে বোঝা যাবে না। ভাবাবেগ বা সেন্টিমেন্টালিজম আসে দুই জায়গা থেকে। একটা যেমন, পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা মনে করেন তাঁরাই হচ্ছেন বাংলা ভাষার প্রধান দপ্তর। বাংলাদেশের লেখকেরাও লিখছেন ছোট ভাইয়ের মতো, তাঁদের উৎসাহ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের অনেক লেখকও ভাবেন, পশ্চিমবঙ্গের লেখক বা সমালোচকেরা স্বীকৃতি দিলেই তবে তাঁরা আসলে স্বীকৃতি পেলেন। এই দুটো প্রবণতাই ক্ষতিকর। কারণ কোনো রকম নির্ভরশীলতা বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সাহিত্য তৈরি হয় না। এই পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় স্বীকার করা যে দুটো দেশের সাহিত্য আলাদা সাহিত্য। আমি এই তুলনার মধ্যে যেতে চাইছি না যে একই ভাষায় পৃথিবীতে কত আলাদা আলাদা সাহিত্য তৈরি হয়েছে। যাচ্ছি না এ কারণে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা কারণ সক্রিয় থেকেছে। সুতরাং তুলনার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের জীবনযাপন, সমাজের জীবনযাপন, রাজনীতি, পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনের রকমফের—এগুলোর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গল্প-উপন্যাসও বদলায়। কবিতার কথা বলছি না, তবে বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস আর পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
প্রশ্ন: তার মানে ধরে নিচ্ছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যে এমন কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যাকে বাংলাদেশি বলে চেনা যায়, আবার পশ্চিমবঙ্গেরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যাকে পশ্চিমবঙ্গীয় বলে চেনা যায়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো কী? দুখানেই তো বিভিন্ন মত, ধারা ও দর্শনের লেখক আছেন। তাঁদের কাজকে এক থাকে ফেলার গড়করণ করছেন কী দিয়ে?
উত্তর: খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। কিন্তু আমি বিশদভাবে উত্তর করছি না। পশ্চিমবঙ্গ ভারত ইউনিয়ন নামক বিশাল উপমহাদেশতুল্য দেশের একটা ছোট রাজ্য বা প্রদেশ। তার প্রতিবেশিত্ব যেমন বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সঙ্গে, তেমনি তার প্রতিবেশিত্ব থাকা উচিত ভারতবর্ষের আরও অজস্র ভাষার সঙ্গে, সাংবিধানিকভাবেই যাদের সংখ্যা বাইশের ওপর। সরকার, গণতন্ত্র, সমাজ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মিউনিসিপ্যালিটির রাজনীতি, গ্রাম পঞ্চায়েত ইত্যাদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ভাষাভাষীদের দৈনন্দিন জীবন। দৈনন্দিন জীবন ছাড়া গল্প-উপন্যাসের আর কোনো বিষয় নেই। সেই দৈনন্দিন জীবনই যখন রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিচ্ছায়া হয়ে ওঠে, তখনই তা সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠে। এখন উভয় বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থা, উৎপাদনব্যবস্থা গত ষাট বছরে এতই আলাদা হয়ে গেছে, সেই আলাদাত্ব স্বীকার না করা সত্যের অপলাপ হয়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সাহিত্যে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা আসছে, বা আসছে কি না?
উত্তর: আমি বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে লেখার দরকারে কতগুলো প্রশ্ন ও কতগুলো উত্তরের সামনে দাঁড়িয়েছি। সেগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দুটো পারস্পরিক সক্রিয়তা কাজ করছে। (এই কথাগুলো কিন্তু আমার কথা, সম্পূর্ণ ভুল হতে পারে)। সেটা হচ্ছে, কিছু বিষয়ের প্রতি বাধ্যতা এবং কিছু বিষয়ের অনিশ্চয়তা বা অনিষ্পত্তি। বাধ্যতাটা হলো আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, বাংলায় আত্মতার সংকট। এটা সব সময় সব লেখককেই তাড়িত করে। বাংলাদেশে এই তাড়নাটা ব্যাপক। তাড়নাটা আছে বলেই বাংলাদেশের লেখালেখি এই পর্যায়ে উঠেছে। এই তাড়নাটা ছাড়া আসলে হয় না। এখন অনিষ্পত্তি হলো, যেমন গণতন্ত্রের চেহারাটা কী হবে? যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মসাপেক্ষতার মধ্যে সম্পর্কটা কী হবে? আমি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনা করছি না, কিন্তু নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের পক্ষে এই পরিমাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে জীবনযাপন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে সেই গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রও হতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষও হতে হবে; আবার আবশ্যিকভাবে ধর্মসাপেক্ষও হতে হবে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্র একটা জায়গায় পৌঁছেছে, কিন্তু সেই গণতন্ত্রও সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ নয়। তাকে ধর্মসাপেক্ষ হতে হয় অর্থাৎ আচরণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয় সে ধর্মসাপেক্ষও বটে অর্থাৎ সে কোনো ধর্মের বিরোধিতা করছে না। আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে এই উপমহাদেশে ‘ধর্মসাপেক্ষ নয়’, এটুকু যদি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রমাণ করতে পারে, সেটুকুই আমার কাছে যথেষ্ট। অনিষ্পত্তি বা মীমাংসা হয়নি, এ রকম আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে জিহাদ এবং না-জিহাদ। মুসলিম সমাজ ও দেশ নির্লজ্জ বহিরাক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। সেই বহিরাক্রমণের সম্মুখীনতা তারা না চাইলেও তাদের বাধ্য করছে শরিয়া ইত্যাদি পালন করতে। বাংলাদেশে এই সমস্যাটা নিষ্পত্তি হয়নি। তবে এটাও বলব, মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই এর সবচেয়ে বেশি নিষ্পত্তি করতে পারছে। তৃতীয় যে সংকটের কথা বলছি, সেটা হলো পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক। আমরা কি একই সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভাগীদার। নাকি আমাদের ইতিহাসটা আলাদা?
প্রশ্ন: দুই বাংলার সাহিত্যের মধ্যে যে পার্থক্যরেখা, তাকে রাষ্ট্রবোধের ধরন বা ইতিহাসের ভিন্নতা দিয়েও বলা যায়। কিন্তু আপনার ভাষ্যে মনে হচ্ছে এই রাষ্ট্রবোধের মর্মে আছে মুসলিম সম্প্রদায়বোধ। একই কথা কি পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের বেলাতেও খাটে না?
উত্তর: খাটতে পারে। তবে সেখানে গণতন্ত্র একটা কাঠামো পেয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পোক্ত হয়েছে। যা কিছুই আসুক তাকে এর ভেতর দিয়েই যেতে হয়। এমনকি বিজেপি বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারী মোদীকেও এর মধ্যে কাজ করতে হয়।
প্রশ্ন: মানুষের নিজস্ব বচন, অভিব্যক্তি, সমাজের অচেতন একটি দেশের সাহিত্যে আসে। এই বিচারে বাংলাদেশের সাহিত্যের কোনো বিশিষ্ট লক্ষণ দেখতে পান?
উত্তর: অনেক প্রত্যক্ষ, জোরালো ও শিল্পসমর্থভাবে সেসব লক্ষণ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে একটা খনি যেন খোঁড়াই হচ্ছে, খোঁড়াই হচ্ছে, শেষ হচ্ছে না। যেমন বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে তার প্রকৃতি, নিসর্গ এবং সেই নিসর্গস্থিত মানুষ, তার যে অস্তিত্বের সংকট আবার দৈনিক দিনযাপনেরও সংকট; গ্রামের বুনো হিউমারের তীব্র আঘাত, এগুলো একটা সাহিত্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়; সেই বিস্ফোরণটাই আমি দেখতে পাচ্ছি। সাহিত্যের বিস্ফোরণ তো আর সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। কিন্তু এটা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবেই বলে আমি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস সম্পর্কে এত আগ্রহী।
প্রশ্ন: মান ভাষা বনাম আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে সম্প্রতি। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উত্তর: বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বাংলাদেশের সাহিত্যেও আরেকটি অনিষ্পন্ন বিষয় হলো ভাষা। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ভাষা হবে, নাকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের মতো মান ভাষা হবে। আমি মনে করি, মান ভাষা হলো উপনিবেশবাদী ধারণা। উপনিবেশ বিস্তারের প্রয়োজনে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের আয়ত্ত করায় সুবিধা হবে বলে বিচিত্র ও বিবিধ ভাষাকে একটা বাঁধা ছকে তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের যে ভাষাকে আমরা মান বলে মেনে নিয়েছি, সেই মান ভাষা পশ্চিমবঙ্গের এখনকার সাহিত্যের জন্য সেটা এক বড় বাধা। কারণ সেই ভাষার পুষ্টি কমে গেছে। ভাষার পুষ্টি আসে কৃষি থেকে, শ্রম থেকে। মানুষের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয় যে ভাষা, সেই ভাষা রক্তাল্পতায় ভুগবেই। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার এটাই বড় সংকট। সে জন্য সেই ভাষা ক্রমাগত যান্ত্রিক কৃত্রিমতায় ভুগছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় জোর এ জায়গায়: অজস্র জেলার অজস্র ভাষা এই ভাষাকে পুষ্ট করছে। আমার এই কথার বিরোধিতার মনোভাব বাংলাদেশের অনেক লেখকের মনে আছে। সেটা মেনে নিয়েই বলছি, বাংলাদেশ যদি কৃত্রিমভাবে কোনো মান ভাষা ব্যবহার করে সেটা বাংলাদেশের সাহিত্যের বেলায় বিরাট ক্ষতির কারণ হবে।
গল্প-উপন্যাসের ভাষা প্রশ্নে আঞ্চলিক, আঞ্চলিকতর আঞ্চলিকতম ভাষা ব্যবহারের যে সুযোগ বাংলাদেশে আছে সেই সুযোগ কোনোমতে বন্ধ করা উচিত নয়। লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভাষার বিভিন্ন স্তর। একটা ভাষায় যখন উপন্যাস লিখছি, তখন সেই ভাষার মধ্যে স্তরান্তর আনায় কথ্য ভাষা যে রকম সাহায্য করে, এ রকম আর কোনো কিছু করে না। আমার যদি ঘরের মধ্যে সেই সম্পদ থাকে, আমার কি উচিত তাকে অবহেলা করা?
প্রশ্ন: জনপ্রিয় সাহিত্য বিষয়ে ধরেন যেমন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর এই প্রশ্নটা এখানে উঠছে যে, তাঁকে আমরা কোন মাপে ফেলব? জনপ্রিয় সাহিত্যই যদি তা হয়, তা নিয়ে কি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন নয়?
উত্তর: সাহিত্যকে জনপ্রিয় ও অজনপ্রিয় এভাবে বিভাজন করা আমার কাছে আপত্তিকর। আপত্তি করি না, এটা আপত্তিকর। এর মানে হচ্ছে অভিজাত আর অনভিজাত বলে ভাগ করা। এলিট লেখক বলে কিছু হতে পারে না। আমার প্রশংসা করতে গিয়ে যদি বলা হয় আমি বিশিষ্ট পাঠকের লেখক, তখন মন খারাপ হয়ে যায় আমার। আমি বিশিষ্ট পাঠকের জন্য তো লিখছি না। বিশিষ্ট পাঠক বলে কেউ আছে, তাও জানি না। পাঠক বিশিষ্টতা পায় বই পড়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সুতরাং জনপ্রিয় লেখকেরও বিশিষ্ট পাঠক থাকতে পারে।
যে মানুষ শুধু গল্প-উপন্যাস লিখে এত মানুষের মন জয় করতে পারেন, তাঁর লেখার মধ্যে সেই গুণ অবশ্যই থাকতে বাধ্য। আমাদের কাজ হলো সেই গুণ খুঁজে বের করা। আমার পক্ষে হুমায়ূনের বিপুল সাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করা অনুচিত, কারণ আমি সব পড়িনি। আমি শরৎচন্দ্রের লেখা খুব অপছন্দ করি, কিন্তু আমার পছন্দে-অপছন্দে কিছু আসে-যায় না। এক শ বছর ধরে তিনি বাঙালি ও ভারতীয় পাঠকের মন জয় করে চলেছেন; এর মধ্যে একটা সত্য আছে। আজকের পাঠক হিসেবে আমাকে সেই সত্যের কাছে পৌঁছাতেই হবে। আমি তার আঁচ পাচ্ছিও, চেষ্টা করছি পেতে। সেটা নিয়ে আমি লিখব। শেষ কাজগুলোর মধ্যে এই একটা কাজ বাকি আছে। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা তার বিশিষ্টতার ক্ষতি করেছে, নাকি তার বিশিষ্টতাই তার জনপ্রিয়তার কারণ? আমি তাঁর মিসির আলি নিয়ে আগ্রহী। আমার মনে হয়, আমি একটা কিছু খুঁজছি সেটা আমি সেখানে পেতে পারি।
দুই বাংলার সাহিত্য আলাদা হওয়ার একটা কারণ আমার মনে হয়, দেশের কল্পনাটা সম্প্রদায়গত এবং ভূগোলগত কারণে ভিন্নভাব ও চিত্র অবলম্বন করে আছে। সাহিত্যিক মাত্রই দেশের কল্পনা মানুষের কল্পনা করে নিতে হয়। শেষপর্যন্ত যদি দেশের কল্পনা আলাদা হয়ে যায় তাহলে সাহিত্যও আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য। রাষ্ট্রতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক পার্থক্য ছাড়াও দেশের ধারণা ও কল্পনা দিয়ে সাহিত্য আলাদা হওয়ার সৃষ্টিতত্ত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব কি না?
এক হাজার বার সম্ভব, আপনি আমার মূল জায়গাটা ধরেছেন। মানুষ তার নিজের পরিসরসংলগ্ন। একে আপনি দ্যাশ বলুন, স্পেস বলুন, বাড়ি বলুন, বাড়ির সেন্স বলুন, হোম বলুন। বলছে, পূজার সময় বাড়ি যাচ্ছি। অথচ থাকে মাত্র দুদিন। কিন্তু ওটা তার ‘হোম’, হোম অ্যাডড্রেস বলতে ওটা লেখে যদিও একটা চিঠিও আসে না। এটা এশীয় দেশগুলোর মূল লক্ষণ। এটাকে বলা যায় নিজের পরিসরের প্রতি মমতা। নইলে, বাড়িতে একটা পেয়ারাগাছ ছিল, ওদিকে একটা জামগাছ ছিল, এই স্মৃতি নিয়ে একটা মানুষ সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে কীভাবে? এটাকে যদি আপনি চটুল আবেগ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে এই জিনিস তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে না। পূর্ববঙ্গ থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু যখন পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বসতি করেছেন, তখন তারা এখানকার গ্রামের নামটা ওখানে বসিয়েছেন। তার কারণ গ্রাম কখনো মরে না। গ্রামের স্থানান্তর হতে পারে, তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামটাও চলতে থাকে। সেটা ভালো কি খারাপ সেটা বিচার্যই না, শিল্প-সাহিত্যের বিচার্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক আবেগ। এই আবেগটাকে বড় ঘটনা বড় রাজনীতি বড় তাৎপর্যের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারাই সাহিত্যের কাজ। আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যে খালটা গেছে সেই খালটা সপ্তসমুদ্রের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এই খাল দিয়ে পাকিস্তানি ফৌজ এল, সেই গ্রামে ঢুকল, সেই ফৌজের পেছনে আমেরিকানদের অস্পষ্ট একটা সমর্থন আছে—এসব মিলিয়ে যে ভুবন, সেই ভুবনের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু ওই সামান্য খালটা। সাহিত্যের কাজ সেটাকেই উদ্ধার করা।
প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কল্পনা হচ্ছে অবিদ্যমানের নিঃশ্বাস। দুই বাংলার সাহিত্যে এখন কি কল্পনার অভাব দেখতে পাচ্ছেন?
উত্তর: দুই জায়গায় মেলাবেন না। বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে কল্পনার বিশ্বটা অনেক বেশি প্রাণবন্ত। নাড়িটাকে ছোঁয়া যায়, যেন দপদপ করছে।
প্রশ্ন: অনেক সময় বিদেশি সাহিত্য বা সেসবের ফর্ম বা আকারে আচ্ছন্নতায় নিজস্ব কল্পনা ফিরে পেতে অসুবিধা হয় কিনা?
উত্তর: এগুলো কোনো স্থায়ী প্রভাব হতে পারে না। একটা হচ্ছে আমাদের কয় শতাংশ সাহিত্য পড়ে বা লেখে। সেহেতু অনেক সময় বাধ্য হয়ে বিদেশি সাহিত্য থেকে ঋণ নিতে হয়। অন্যদিকে, আমাদের এখানে আকারের যে বৈচিত্র্য, তাতে আমাদের কারও কাছে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রশ্নই আসে না। আমাকে কে শেখাবে বাইরে থেকে? আমি জন্মেছি এমন এক দেশে যেখানে প্রতিটি পা গল্পে গল্পে চলে। গল্প ছাড়া এখানে কথাই হয় না। গল্প ছাড়া হাহাকারও নেই, আনন্দও নেই। সেই দেশের মানুষ আমরা, আমাদের কেন গল্পের জন্য ফর্মের জন্য বাইরে হাত পাততে হবে? বড় বিষয় হলো দেশকল্পনা, সেটাকে খুঁজে পেতে হবে। বিদেশি চিনি না জানি না এমন একজন লেখক, যেহেতু পেঙ্গুইন বা হার্পারকলিন্স বের করেছে, সেহেতু পড়ছি। আমি আমাদের অনেক লেখকের কথা জানি, যারা ওই সব বিশ্ববন্দিত লেখকের চেয়ে ভালো লেখেন।
প্রশ্ন: তার মানে সাহিত্যের ওপর বাণিজ্যের প্রভাব আছে। এ প্রসঙ্গে হে ফেস্টিভ্যাল নিয়েও সমালোচনা উঠছে যে এর মধ্যে একটা ঔপনিবেশিক ছাপ আছে।
উত্তর: আমি এতটা বিধবার একাদশী করতে রাজি না। আমি এতটা দুর্বল লেখক না, কয়েকটা করপোরেট সাহিত্য নিয়ে বিনিময় করতে চাইলে আমি ভয় পাব। কারণ, আমি জানি সাহিত্যের মূল নিরিখে আমি ঠিক। সেহেতু আমি আমার কথা বলব, ওরা আমার কী করবে, আমাকে কী বদলাবে? বরং এসব বিনিময়ে সাহায্য হয়। প্রতিপক্ষ যখন আড়ালে থাকে, তখন তাকে বেশি শক্তিমান মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি পঞ্চাশ দশক থেকে লিখছেন। এ সময় দেশ, সমাজ, মানুষ সব মূলসুদ্ধ বদলে যেতে দেখছেন। এ রকম এক দুর্ভাগ্যের পৃথিবীতে লেখক কি বিষাদগ্রস্ত হন, দিশেহারা বোধ করেন?
উত্তর: সব মানুষ সুখে আছে, কোনো সংকট নেই, আরামে থেকে গল্প-উপন্যাস লেখা হবে—এটা গল্প-উপন্যাস লেখার পরিস্থিতি নয়। কেউ এ রকম জীবন যাপন করলে, সেটাও লেখক হওয়ার বাধা নয়। কিন্তু অনুপস্থিত সংকটও যদি তার চৈতন্যে উপস্থিত না হয়, তাহলে সে লেখকই নয়। লেখক হওয়ার নিয়তি যে বেছে নিয়েছে, তাকে এই নিয়তিও মেনে নিতে হবে যে তাকে এই দুর্ভার বোঝা বইতে হবে। এবং সব সময়ই একটা অন্ধকার নদীতে উজান স্রোতে বুক ঠেলে এগোতে হবে।
No comments