স্মরণ- স্মৃতি অম্লান by এম শামসুর রহমান
বরেণ্য বিজ্ঞান লেখক, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীনের চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৩০ নভেম্বর। ১৯৯৮ সালের এই দিনে দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চিরতরে।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আল-মুতীর কর্মজীবন শুরু। অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে পরে তিনি অন্য সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং কালক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অধিষ্ঠিত হন। ড. আল-মুতী নানান শিক্ষামূলক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিজ্ঞানবিষয়ক বহু গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। পত্রপত্রিকায়ও লিখেছেন প্রচুর। বিজ্ঞানের ভাষাও যে হতে হবে প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সহজবোধ্য, তাঁর রচনায় এ বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষণীয়। বিষয়-বৈচিত্র্যে ও বিশ্লেষণের সূক্ষ্মতায় তাঁর প্রায় সব লেখাই পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।
মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও আল-মুতী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ গণিত অনুরাগী ব্যক্তি। ১৯৮০ সালের ৫-৭ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতির উদ্যোগে দ্বিতীয় গণিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান। সম্মেলনের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন ড. আল-মুতী। অধিবেশনের অন্যতম বক্তা হিসেবে সে সময়ই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়। ছিপছিপে গড়নের শান্ত প্রকৃতির এই মানুষটি ছিলেন নির-হংকার, অমায়িক ও মিষ্টভাষী। তাঁর ব্যক্তিত্বের আলো ও মাধুর্য আর আদর্শ চরিত্র মুগ্ধতায় ভরে দিত সবার মনপ্রাণ। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম। দেড় দশক পেরিয়ে এই দেশগৌরব শিক্ষাবিদের সঙ্গে ফের আমার একটা যোগসূত্র সৃষ্টি হয়ে গেল। বাংলাদেশ গণিত সমিতির মুখপত্র গণিতপরিক্রমার সম্পাদনার কার্যভার ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর। এখনো এ দায়িত্বে রয়েছি। পরিক্রমায় লেখার জন্য অনুরোধ জানালে ‘গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ’ শীর্ষক একটা লেখা পাঠিয়ে দেন তিনি। গণিতপরিক্রমা সপ্তম খণ্ড (১৯৯৭)-এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। মুখপাত্রটির উৎকর্ষ সাধনে ও বিকাশে তাঁর পরামর্শ ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য।
গণিতপরিক্রমা অষ্টম খণ্ডে আরেকটি লেখা প্রকাশ্যের প্রত্যাশায় ড. আল-মুতীর সঙ্গে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হতো। মাঝেমধ্যে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাতিরপুলের বাসায়ও সাক্ষাৎ করেছি। বলতে গেলে ১৯৯৭ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর যতবার তাঁর সাহচর্যে গিয়েছি, অতি আন্তরিকতার সঙ্গে ও খোলামেলাভাবে তিনি কথা বলেছেন। শেষের বিশেষ তারিখটি মনে পড়ে। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সাল। সেদিন তাঁকে খুবই প্রসন্ন মনে হচ্ছিল। কে জানত ওই দিনই হবে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ।
লেখার ব্যাপারে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি আমাকে টেলিফোন করতে বললেন। ২৫ সেপ্টেম্বর টেলিফোন করলাম। শুনলাম, তিনি অসুস্থ। পত্রিকার খবরে জানলাম ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পরে সুচিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সংবাদ: আবদুল্লাহ আল-মুতী ক্যানসারে আক্রান্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর রোগমুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করা হয়েছে। এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী সম্পর্কে এসব খবর পড়ে মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। ১৬ নভেম্বর ’৯৮ বেলা একটায় তাঁর বাসায় যাই। শয্যাশায়ী ও অচেতন অবস্থায় তাঁকে একপলক দেখলাম।
১৯৯৭ সংখ্যার আমাদের মুখপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আল-মুতীর প্রথম ও শেষ লেখা। গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ দিয়ে তিনি আমাদের ঋণী করে গেলেন। আর কোনো দিন লেখা পাব না তাঁর কাছ থেকে। ১৯৯৮ সংখ্যার পরিক্রমায় তাঁর আরেকটি লেখা প্রকাশ্যের আশা ত্যাগ করলাম। বরঞ্চ তাঁকে নিয়ে ওই সংখ্যায় ‘একজন লেখকের তিরোধান: আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শিরোনামে আমি লিখেছি।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালে আল-মুতী ইহলোক ত্যাগ করেন। আলো ছায়া মায়াময় পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ পেছনে ফেলে যে মানুষটি চলে গেলেন অমরলোকে, তাঁর চিরপ্রস্থান আমাদের বেদনার্ত করে। তিনি তেমন দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। কিন্তু জীবনসংগ্রামে জয়ী হন। জয়ী হয়েছেন বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসায় উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়।
চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আবদুল্লাহ আল-মুতীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। এই বড় মাপের, সুন্দর মনের মানুষটিকে আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তাঁর বর্ণাঢ্য ও কৃতিত্বপূর্ণ কর্মজীবন। আমাদের কাছে রইবে ড. আল-মুতীর স্মৃতি অম্লান।
এম শামসুর রহমান
সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মূলত পদার্থবিজ্ঞানী হলেও আল-মুতী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ গণিত অনুরাগী ব্যক্তি। ১৯৮০ সালের ৫-৭ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতির উদ্যোগে দ্বিতীয় গণিত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান। সম্মেলনের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন ড. আল-মুতী। অধিবেশনের অন্যতম বক্তা হিসেবে সে সময়ই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়। ছিপছিপে গড়নের শান্ত প্রকৃতির এই মানুষটি ছিলেন নির-হংকার, অমায়িক ও মিষ্টভাষী। তাঁর ব্যক্তিত্বের আলো ও মাধুর্য আর আদর্শ চরিত্র মুগ্ধতায় ভরে দিত সবার মনপ্রাণ। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম। দেড় দশক পেরিয়ে এই দেশগৌরব শিক্ষাবিদের সঙ্গে ফের আমার একটা যোগসূত্র সৃষ্টি হয়ে গেল। বাংলাদেশ গণিত সমিতির মুখপত্র গণিতপরিক্রমার সম্পাদনার কার্যভার ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর। এখনো এ দায়িত্বে রয়েছি। পরিক্রমায় লেখার জন্য অনুরোধ জানালে ‘গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ’ শীর্ষক একটা লেখা পাঠিয়ে দেন তিনি। গণিতপরিক্রমা সপ্তম খণ্ড (১৯৯৭)-এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। মুখপাত্রটির উৎকর্ষ সাধনে ও বিকাশে তাঁর পরামর্শ ছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য।
গণিতপরিক্রমা অষ্টম খণ্ডে আরেকটি লেখা প্রকাশ্যের প্রত্যাশায় ড. আল-মুতীর সঙ্গে প্রায়ই আমার যোগাযোগ হতো। মাঝেমধ্যে তাঁর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হাতিরপুলের বাসায়ও সাক্ষাৎ করেছি। বলতে গেলে ১৯৯৭ সালের মার্চ থেকে দেড় বছর যতবার তাঁর সাহচর্যে গিয়েছি, অতি আন্তরিকতার সঙ্গে ও খোলামেলাভাবে তিনি কথা বলেছেন। শেষের বিশেষ তারিখটি মনে পড়ে। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সাল। সেদিন তাঁকে খুবই প্রসন্ন মনে হচ্ছিল। কে জানত ওই দিনই হবে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ।
লেখার ব্যাপারে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি আমাকে টেলিফোন করতে বললেন। ২৫ সেপ্টেম্বর টেলিফোন করলাম। শুনলাম, তিনি অসুস্থ। পত্রিকার খবরে জানলাম ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পরে সুচিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সংবাদ: আবদুল্লাহ আল-মুতী ক্যানসারে আক্রান্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর রোগমুক্তির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করা হয়েছে। এই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী সম্পর্কে এসব খবর পড়ে মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হলো। ১৬ নভেম্বর ’৯৮ বেলা একটায় তাঁর বাসায় যাই। শয্যাশায়ী ও অচেতন অবস্থায় তাঁকে একপলক দেখলাম।
১৯৯৭ সংখ্যার আমাদের মুখপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আল-মুতীর প্রথম ও শেষ লেখা। গণিতের আদিযুগ: প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের ঋণ দিয়ে তিনি আমাদের ঋণী করে গেলেন। আর কোনো দিন লেখা পাব না তাঁর কাছ থেকে। ১৯৯৮ সংখ্যার পরিক্রমায় তাঁর আরেকটি লেখা প্রকাশ্যের আশা ত্যাগ করলাম। বরঞ্চ তাঁকে নিয়ে ওই সংখ্যায় ‘একজন লেখকের তিরোধান: আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শিরোনামে আমি লিখেছি।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালে আল-মুতী ইহলোক ত্যাগ করেন। আলো ছায়া মায়াময় পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ পেছনে ফেলে যে মানুষটি চলে গেলেন অমরলোকে, তাঁর চিরপ্রস্থান আমাদের বেদনার্ত করে। তিনি তেমন দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। কিন্তু জীবনসংগ্রামে জয়ী হন। জয়ী হয়েছেন বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসায় উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়।
চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আবদুল্লাহ আল-মুতীর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা। এই বড় মাপের, সুন্দর মনের মানুষটিকে আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তাঁর বর্ণাঢ্য ও কৃতিত্বপূর্ণ কর্মজীবন। আমাদের কাছে রইবে ড. আল-মুতীর স্মৃতি অম্লান।
এম শামসুর রহমান
সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments